আচ্ছা যা, দেখা যাবে।
আশ্চর্য লাগছে মোহিনীর। মানভূমের কোনো এক শালবনের ছায়া আর লালমাটির টিলা থেকে আমদানি হয়েছিল এই কালোকোলো হাবা মেয়েটা। ওর স্বাস্থ্য সুঠাম শরীর মোহিনীকে আকর্ষণ করেছিল, তাই বাগান থেকে তুলে এনে সোজা নিজের কাজে লাগিয়েছিল। এই ক বছরেই কী দ্রুত প্রগতি হয়েছে। আর শুধু ওরই-বা দোষ কী। অমলাও তো ঠিক তালে তালেই এগিয়ে চলেছে।
ক্রিং করে লাল সাইকেলের ঘণ্টির শব্দ। টেলিগ্রাম।
ক্ষিপ্রহাতে লেফাপা ছিঁড়ে টেলিগ্রাম পড়ল মোহিনী। কাল সন্ধ্যার ট্রেনে কলকাতা থেকে আসছে শঙ্করলাল, কানহাইয়ালালের ভাইপো।
ধড়মড় করে করে উঠে পড়ল সে। সকলকে এখনই ডাকা দরকার। কাগজপত্র, গুদাম সমস্তই রাতারাতি ঠিক করতে হবে। আর যে তিনশো বস্তা অতিরিক্ত চা গুদামে মজুত আছে, তাদেরও নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে ফেলতে হবে এক্ষুনি। খাতাপত্রে ওই তিনশো বস্তার হিসেব নেই কিছু।
সন্ধ্যায় বাংলোতে ফিরে মোহিনী দেখলে অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই কোথাও। আতিথেয়তার ব্যাপারে অমলা তাকে অনেক পেছনে ফেলে গেছে আজকাল। বেতের চেয়ারে, টেবিলে আর ফুলদানিতে সুন্দর করে সাজিয়েছে বারান্দাকে। আর এমনভাবেই প্রসাধন করেছে যে দেড় মাইল দূর থেকেই তার কসমেটিকের গন্ধ যেন মাথা ঘুরিয়ে দেয়। গলার খাঁজে পুরু পাউডারের আস্তর দিয়ে সেটাকে একেবারে সাদা করে ফেলবার একটা মর্মান্তিক দুশ্চেষ্টা করেছে অমলা।
অমলা বললে, ননসেন্স। এত দেরি করলে। ওদের যে আসবার সময় হয়ে গেল।
ক্লান্ত গলায় মোহিনী বললে, তুমি একাই তো যথেষ্ট।
ভ্রূ কুঁচকে অমলা বললে, মানে?
মানে কিছু নেই মোহিনী মন্থর অবসন্ন গতিতে ভেতরে চলে গেল। কেন কে জানে, আজকে অমলার এই অতি প্রসাধনটা তার ভালো লাগল না। মোহিনীর হাতের তৈরি পুতুলটা কার মায়াবলে জীবন্ত হয়ে উঠল? তার সৃষ্টি যেন তাকেই ছাড়িয়ে যেতে চায়। বড়ো বেশি এগিয়ে গেছে অমলা, এখন এক বার রাশ টানা দরকার।
বাথরুমের সামনে অনুজ্জ্বল নীল আলোতে দেখা গেল আয়াকে। মুখে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। মোহিনীকে দেখে মুহূর্তে সিগারেটসুদ্ধ হাতটাকে পেছনে লুকিয়ে ফেললে।
কী রে, গাউন পরবার আগেই সিগারেট ধরেছিস? আয়া অপ্রতিভ হয়ে গেল অনেকটা। বললে, না, ওরা দিলে তাই…।
কারা দিলে?
ওই… উত্তরটা অসমাপ্ত রেখেই আয়া দ্রুত প্রস্থান করলে।
মোহিনী চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল খানিক্ষণ।
সমস্ত চিন্তা চকিত আর সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। আজ সন্ধ্যায় সব কিছু বিরক্ত আর বিস্বাদ করে দিচ্ছে মনকে। অমলা আর আয়া দুজনেই বড়ো বেশি এগিয়ে গেছে, এত বেশি এগিয়েছে যে মোহিনী যেন আর তাদের নাগাল পাচ্ছে না। হয়তো এমন দিনও আসবে যখন দূর থেকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করবার থাকবে না মোহিনীর। নিজের তৈরি অস্ত্র আজ কি তার নিজের বুক লক্ষ করেই উদ্যত হয়ে উঠল?
হঠাৎ নিস্তব্ধ রাত্রির আকাশে গমগম করে বাঘ ডেকে উঠল। পাহাড়ে বাঘ ডাকছে। ক্ষুধিত বাঘ আজ আর স্বচ্ছন্দে নীচে নেমে আসতে পারে না মানুষের ভয়ে—তার অস্ত্রের ভয়ে। তাই দুর্গম পাহাড়ের জটিল লতাগুল্মের আড়ালে গর্জন করে অসহায় আক্রোশে। কচিৎ কখনো দু-এক বার নেমেও এসেছে, প্রাণ নিয়েছে মানুষের, তারপরে নিজের প্রাণ দিয়েছে। সোনাঝুরি চা-বাগানে সোনার শস্য দেখা দিয়েছে, প্রাচুর্যের সঞ্চয় মানুষের বিশ্বব্যাপী মুষ্টির ভেতর থেকে উপছে পড়ে যাচ্ছে, শুধু বাঘই বঞ্চিত। ওই গর্জনের ভেতর দিয়ে সে কি নিজের দাবিকেই জানাতে চায়?
বাইরে জিপ গাড়ি থামবার শব্দ। অমলার কলকণ্ঠ, পুরুষের মোটা গলা। এরোড্রোমের আমন্ত্রিতেরা এসে পড়েছে।
প্রায় পনেরো মিনিট পরে অনিচ্ছুক দেহ আর আড়ষ্ট মন নিয়ে মোহিনী বেরিয়ে এল বাইরের বারান্দাতে। আসর ভালো করেই জমে উঠেছে, তার অভাবে কোনোখানে এতটুকু ত্রুটি নেই কিছুর। এরোড্রোমের দুজন ভারতীয় কর্মচারী এসে আসর জাঁকিয়ে বসেছেন, একজন সিন্ধি আর একজন পাঞ্জাবি। সিগারের কড়া গন্ধ বাতাসকে ঘনীভূত করে তুলেছে। শুধু সিগারের গন্ধই নয়, মোহিনীর অভ্যস্ত নাক তার ভেতর মদের অস্তিত্বও অনুভব করল।
মোহিনীকে দেখবামাত্র খানিকটা অট্টহাসি বিদীর্ণ হয়ে পড়ল।
দ্য ম্যানেজার ইজ অলওয়েজ লেট।
ও, হি ইজ এ লেট লতিফ।
নট লতিফ বাট সিরকার।
আবার খানিকটা উচ্ছ্বসিত হাসি। পাঞ্জাবি আর সিন্ধির চোখের দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায় প্রকৃতিস্থ নেই ওরা। হাসির ধমকে পাঞ্জাবির প্রকান্ড শরীরটা দুলে উঠছে ঢেউয়ের মতো। সিন্ধির বাহুমূলে অভিজাত ইউনিফর্মের ওপরে জ্বলজ্বল করছে সোনালি ইগল। তাদের অত্যন্ত কাছ ঘেঁষে বসেছে অমলা। কী বুঝেছে কে জানে, তারও সমস্ত মুখ নির্বোধ হাসিতে উদ্ভাসিত। পাঞ্জাবির অনামিকায় জ্বলছে একটা হিরের আংটি। ওদের নেশার ছোঁয়াচ যেন রং ধরিয়েছে অমলার গালে, অমলার মনেও। পাঞ্জাবির চেয়ারের হাতল ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে আয়া, সেও হাসছে। পলকের জন্যে এক বার অমলা আর এক বার আয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল মোহিনী। কী-একটা জিনিস মুহূর্তের মধ্যে ওর মনের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল, এরা দুজনে যেন আজ পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী।
কুঞ্চিত করে মোহিনী চেয়ারে এসে বসল। চায়ের সঙ্গে চলতে লাগল উদ্দাম হাসি, অকারণ কৌতুক, সুলভ রসিকতা। অমলা যেন রাতারাতি বিলাতি ছবির নায়িকা হয়ে উঠেছে। আয়ার চোখেও যেন তারই প্রতিবিম্ব।