ফকিরের ইতিহাসের সঙ্গে ডাকাতে-কালীর ইতিহাস একই প্রাচীনতার ঐতিহ্যে গাঁথা। কোনো এক নামজাদা ডাকাত এখানে অমাবস্যার রাত্রে নরবলি দিয়ে বেরুত ডাকাতি করতে। এইখানে পঞ্চমুন্ডি আসন করে সাধনা করতেন রক্তচক্ষু এক মহাকায় তান্ত্রিক। অনেক নরবলির রক্ত এখানকার মাটিতে মিশে আছে, অনেক নরমুন্ড লুকিয়ে আছে এর মাটির তলায়। সুতরাং, এখানকার হিন্দুদের কাছে ডাকাতে-কালীর একটা নিশ্চিত ভয়ংকর মর্যাদা আছে। এই গ্রাম তাঁরই রক্ষণাধীনে এবং তাঁর কোপদৃষ্টি পড়লে দেখতে দেখতে সব কিছু উজাড় হয়ে যাবে।
সব চাইতে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, এত বড়ো মাঠের ভেতরে এঁরা দুজন পরস্পরের প্রতিবেশী। ফকির আর ডাকাতে-কালী এতকাল পরম নিশ্চিন্তে এবং নীরবে পাশাপাশি বসবাস করে আসছিলেন। এক কম্বলে দশ জন ফকিরের জায়গা হয়–এই প্রবন্ধটির জন্যেই বোধ হয় এতকাল ফকির কিছুমাত্র আপত্তি করেননি এবং এত কাছাকাছি যবনের আস্তানা থাকাতেও কালী জাত যাওয়ার আশঙ্কা রাখতেন না।
বেশ ছিল, কিন্তু সমুদ্রে ঝড় এল; প্রবাল-বলয় ভেঙে দোলা জাগিয়ে দিলে নিদ্রিত প্রবালদ্বীপে। মাইল-দেড়েক দূরে মাঝারি গোছের একটা মাদ্রাসা। মাঝখানে একদিন এক মৌলবি সেখানে এসে ওয়াজ করলেন। কী বক্তৃতা দিলেন তিনিই জানেন, কিন্তু পরের দিন থেকেই আবহাওয়াটা বদলে গেল একেবারে। তারও দু-দিন পরে মুসলমান পাড়ার ধলা মন্তাই এসে জগন্নাথ ঠাকুরকে জানিয়ে গেল, এবার ডাকাতে-কালীর থানে পুজো করা চলবে না।
কারণ?
কারণ ওখানে ঢাক-ঢোল বাজে, ওখানে ভূত পুজো হয়। তাতে সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত হয় ফকিরসাহেবের। জগন্নাথ ঠাকুর বোঝাতে চেষ্টা করলে–বরাবর ওখানে পুজো হয়ে আসছে। এতকাল ফকিরসাহেবের যদি কোনো অসুবিধে না-হয়ে থাকে, এবারেই-বা হতে যাবে কেন?
ধলা মন্তাই হাসল, বললে, তা হোক, অত বুঝি না। তবে এইটে বলতে পারি যে, এবারে ওখানে আর পুজো হতে দেওয়া যাবে না। এতে আমাদের ধর্মের অপমান।
কিন্তু আমাদের ধর্মেরও তো অপমান হচ্ছে।
ভূত পুজো আবার কীসের ধর্ম? ধলা মাইয়ের চোখে হিংসা চকচক করে উঠল, একটা কথা বলে যাই ঠাকুর। এ এখন আমাদের রাজত্ব। আমরা যা বলব তাই করতে হবে। এখন বেশি চালাকি করতে যেয়ো না, বিপদ হতে পারে।
গ্রামে দুজন মন্তাই। একজন রোগা আর কালো, নিরীহ নির্জীব লোক, সে শুধুই মন্তাই। ধলা মন্তাইয়ের রং ওরই ভেতরে একটু ফর্সা, লম্বা তাগড়া চেহারা, চিতানো বুক। মুসলমান পাড়ার সে সবচাইতে দুর্ধর্ষ ব্যক্তি, নামকরা দাগি। তাই ধলা মন্তাইয়ের শাসানো শুধু কথার কথাই নয়।
যা বললুম ভুলো না ঠাকুর। পরে গোলমাল হতে পারে। আর এক বার সাবধান করে দিয়ে দলবল নিয়ে ধলা মন্তাই চলে গেল।
তখনকার মতো জগন্নাথ ঠাকুর চুপ করে রইল। কিন্তু চুপ করে থাকা মানেই চেপে যাওয়া নয়। ঘা লাগল ব্রাহ্মণের আত্মমর্যাদায়, কুকুরের ল্যাজের মতো বেঁড়ে টিকিটা উত্তেজনায় খাড়া হয়ে উঠল শজারুর কাঁটার মতো।
নমঃশূদ্রদের গ্রাম। এমনিতেই জাতটা একটু সামরিক, চট করে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার মতো নয়। সমাজের সবচাইতে নীচের তলায় পড়ে থাকে বলেই ধর্মের ওপরে আস্থাটা বেশি। শূদ্রশক্তির বলিষ্ঠ সহজ সংস্কারে একবার যাকে মেনে নিয়েছে তার কাছ থেকে চূড়ান্ত অপমানের আঘাত পেয়েও তাকে ছাড়তে জানে না। যুগ-প্রবাহিত রক্তধারায় শম্বুকের নিষ্ঠা, একলব্যের দৃঢ়তা। সমাজের ওপরতলার মানুষদের মতো ধর্মটা ওদের অলংকার মাত্র নয়, একেবারে নীচের তলায় থেকেও ধর্মকে ওরা অহংকার বলে আঁকড়ে রেখেছে।
সুতরাং, নমঃ-র বামুন জগন্নাথ সরকার খেপে উঠেছে।
পুজো আমরা করবই। তার পরে যা হওয়ার হোক।
একজন বললে, তাহলে সড়কি-টাঙ্গিতে শান দিতে হয়।
জগন্নাথ সরকার হাঁটু চাপড়ে বললে, আলবাত। খুনখারাপি দুটো-একটা হয় তো হোক। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়া চলবে না। বেশি বাড়াবাড়ি করে তো ফকিরটকির সবসুদ্ধ উড়িয়ে দেব।
শ্রোতাদের মধ্যে উৎসাহী একজন উঠে দাঁড়াল। রক্তের ভেতরে চনচন করে উঠেছে নেশা —খুনখারাপির নেশা। হিংস্র জন্তুর চৈতন্যের ভেতরে যেন সাড়া দিয়ে উঠেছে আদিম অরণ্যের আহ্বান। সোজা দাঁড়িয়ে উঠে সে বিকট গলায় একটা হাঁক পাড়ল, জয় কালী মাইকি জয়।
সমবেত জয়ধ্বনি উঠল, কালী মাইকি জয়।
আর সঙ্গে সঙ্গে যেন দূরের মুসলমান পাড়া তার জবাব পাঠিয়ে দিলে, আল্লা-হো আকবর।
জগন্নাথ সরকারের নেতৃত্বে শেষ হল ওদের সভা, ধলা মন্তাইয়ের সভাপতিত্বে শেষ হল মুসলমান পাড়ার ওয়াজ। সমস্ত মুসলমান পাড়া আল্লার নামে কসম নিয়েছে, জান দেবে তবু এবার পুজো করতে দেবে না। ইসলামের ইজ্জত বাঁচাতে হলে যে করে হোক ওই ভূত পুজো বন্ধ করতে হবে।
আসন্ন ঝড়ের সংকেতে আকাশ থমথম করতে লাগল! মুসলমান পাড়ার যিনি আদত মাথা, তিনি হাবিব মিয়া। নধর গোলগাল চেহারা, টুকটুকে রং। শৌখিন মেজাজের মানুষ। দিল্লি থেকে প্রতি সপ্তাহে সুর্মা আসে তাঁর নিজের এবং তাঁর আদরের লালবিবির জন্যে। কানে থাকে আতরভরা তুলো এবং মুখ থেকে বেরোয় মশলা-দেওয়া পানের গন্ধ। পঞ্চাশ বছর বয়েস হয়েছে হাবিব মিয়ার, কিন্তু মনের তারুণ্য এতটুকু ফিকে মারেনি আজ পর্যন্ত। এ অবধি বারোটি বিবি তাঁর হাত ঘুরে গেছে। এখন যে-চারটি আছে তার প্রথমটি হচ্ছে আদি ও অকৃত্রিম, বাকি তিনটি আনকোরা নতুন। পুরোনো জিনিস বেশিদিন বরদাস্ত করতে পারেন না হাবিব মিয়া, কিন্তু বড়োবিবিকে তালাক দেবার কল্পনাও তিনি করতে পারেননি কখনো। আজ বত্রিশ বছর ঘর করে কেমন একটা মায়া বসে গেছে, তা ছাড়া ধান-পান গোরু-গোয়ালের নিপুণ তদারক করতে এমন আর একটি প্রাণী দুর্লভ।