দূরের সমুদ্রে ঝড়। কলকাতা, নোয়াখালি, বিহার, বোম্বাই, পাঞ্জাব আত্মঘাত আর অপঘাতের রক্তে লাল হয়ে গেল নীল সমুদ্রের জল। প্রবাল-বলয় ভেঙে পড়ল, লেগুনের নিস্তরঙ্গ জলে দেখা দিল মত্ততার আক্রোশ।
ব্রাহ্মণত্বের বিজয়গর্বে প্রায় আধ হাত খানেক একটা টিকি মাথার ওপরে গজিয়ে তুলেছে। জগন্নাথ সরকার। সেইটেই দুলিয়ে সে বললে, নাঃ, এর প্রতিবিধেন করতেই হবে। এমনভাবে চললে দু-দিন বাদে সব বাছাধনকেই যে কলমা পড়তে হবে সেটা খেয়াল রেখো।
তরণি মন্ডল বললে, তা লাঠি ধরতে হয়।
তাই ধরতে হবে। নিজের মান নিজে না রাখলে কে রাখবে তাই শুনি? গায়ে যতক্ষণ এক ফোঁটা রক্ত আছে, ততক্ষণ এ ঘটতে দেব না, পরিষ্কার বলে রাখলাম।
কুকুরের ছানার বেঁড়ে একটা ল্যাজের মতো জগন্নাথ সরকারের মাথার ওপরে টিকিটা নড়তে লাগল।
ব্রাহ্মণের অধিকার সম্বন্ধে একটু বেশি মাত্রাতেই সচেতন জগন্নাথ সরকার। খাঁটি ব্রাহ্মণদের কাছে স্বীকৃতিটা নেই বলেই নিজেকে আরও বেশি করে প্রমাণ করতে চায় সে, প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সমুদ্রের ওপারে একটা বিস্তীর্ণ মহাদেশ জুড়ে যেখানে ব্রাহ্মণত্বের বিজয়পতাকা উড়ছে, অস্পৃশ্য নমঃশূদ্রদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য গর্বিত জগন্নাথ সরকারের কোনো পার্থক্য নেই সেখানে। তাই নিজের ছোটো গন্ডিটির ভেতরে নিজেকে সে বশিষ্ঠ-যাজ্ঞবন্ধ্যের মহিমায় স্থাপিত করে রাখতে চায়। ক্ষার দিয়ে পরিষ্কার করে কাচা লালচে রঙের মোটা পৈতের গুচ্ছটা বাগিয়ে ধরে বলে, হেঁ হেঁ বাবা–খাঁটি কাশ্যপ গোত্র, রামকিষ্ট ঠাকুরের সন্তান। একটু তপ তপিস্যে বজায় রাখলে যাকে-তাকে ভস্ম করে ফেলতে পারতুম।
কিন্তু তপ-তপস্যাটা এখন আর হয়ে ওঠে না বলেই কাউকে আর ভস্ম করাটাও সম্ভব নয় রামকিষ্ট ঠাকুরের সন্তানের পক্ষে। আর মনু-পরাশরের সঙ্গে যতই আত্মীয়তা সে দাবি করুক না কেন, আসলে সে এখন অন্ত্যজ, সে নমঃশূদ্রের ব্রাহ্মণ।
কোন সাত না দশ পুরুষ আগে অক্ষত কৌলীন্য স্বনামধন্য রামকিষ্ট ঠাকুরের কোনো বৃদ্ধ প্রপৌত্র লোভ বা অভাবের তাড়নায় নমঃশূদ্রের যাজনা করেছিল। সেই থেকে তারা পতিত। হিন্দুত্বের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য সে-পতনকে ক্ষমার চোখে দেখেনি, বিচারও করেনি। একটু একটু করে দিনের পর দিন ঠেলে দিয়েছে পিচ্ছিল পথে, এখন তারা নমঃ-র বামুন।
পৈতে আছে, উপনয়নের ব্যবস্থা আছে, ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের ভাঙাচুরো অর্থহীন অসঙ্গতিগুলোও জড়িয়ে আছে জীবনের সঙ্গে। শিক্ষাদীক্ষা নামেমাত্র; জগন্নাথ সরকার নামটা কাঁচা হাতে সই করতে পারে, তাতে মাত্রা দিতে জানে না, লেখাটা দেখলে নাগরী বলে মনে হয়। চেহারায় ব্রাহ্মণের আর্যত্বের দীপ্তি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। রোদে-পোড়া কালো রং, লাঙল ঠেলে চওড়া চওড়া হাত দুটো লোহার মতো শক্ত আর কড়া পড়া, পিঠে খড়ি, তামাটে রঙের খাড়া খাড়া চুল, অনেকক্ষণ ধরে স্নান করলে যেমন হয় তেমনি লালচে আর ঘোলাটে বর্ণের চোখ। বড়ো বড়ো অসমান দাঁত, তার দুটো আবার হিন্দুস্থানিদের অনুকরণে রুপো-বাঁধানো। শুধু কুকুরের বেঁড়ে ল্যাজের মতো মাথার টিকিতে ব্রাহ্মণত্বের জয়গৌরব ঘোষিত হচ্ছে।
নমঃশূদ্রদের বিয়েতে, ক্ষেত্ৰপালের পুজোয় সে-ই মন্ত্র পাঠ করে। সে-মন্ত্র বিচিত্র। খাঁটি প্রাদেশিক বাংলার ঘাড়ে কতগুলো অনুস্বার-বিসর্গ চাপিয়ে সেগুলোতে দেবমহিমা আরোপ করা হয়। পিতৃপুরুষের কাছ থেকে যেটুকু পাওয়া গেছে প্রয়োজনমতো তার সঙ্গে নতুন মন্ত্রও জুড়ে নেয় জগন্নাথ সরকার। মোটের ওপর পসার আছে এবং সেজন্যে আত্মমর্যাদা সম্পর্কেও সে পুরোপুরি সজাগ।
আজ সেই আত্মমর্যাদায় ঘা লেগেছে।
বাইরের সমুদ্রে ঝড়। কলকাতা, নোয়াখালি, বিহার—সমস্ত দেশজোড়া একটা অতিকায় ছোরার ঝলক এখানকার আকাশেও বিদ্যুৎচমকের মতো খেলা করে গেল।
অনেক দিন আগে এখানে এক ফকিরের আবির্ভাব হয়েছিল। ফকির নাকি ছিলেন অদ্ভুতকর্মা; সমস্ত হুরি-পরি-জিন ছিল তাঁর আজ্ঞাবহ। হাতে একমুঠো ধুলো নিয়ে তিনি ফু দিতেন, সঙ্গে সঙ্গে সে-ধুলো হয়ে যেত খাসা কিশমিশ মনক্কা, কখনো কখনো একেবারে সেরা মোগলাই পোলাও। কতগুলো ঘাসপাতা একসঙ্গে জড়ো করে নিয়ে মন্ত্রপাঠ করতেন ফকির, দেখতে দেখতে সেগুলো হয়ে যেত চুনি-পান্না-হিরে-জহরত। সেসব হিরে-জহরতের শেষপর্যন্ত কী গতি হয়েছে ইতিহাসে তা লেখা নেই, তবে ফকিরের মহিমা লোকের স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে আছে। আর সবচাইতে যেটা উল্লেখযোগ্য সেটা এই যে, এহেন করিতকর্মা মহাপুরুষ কী মনে করে এই অজগর বিজেবনেই তাঁর দেহরক্ষা করলেন।
বেশ আড়ম্বরের সঙ্গেই গ্রামের লোক তাঁর শেষকৃত্য করলে। তাঁর সমাধির ওপর রচনা করলে ছোটো একটি গম্বুজ। এখন সে-গম্বুজ আর নেই, কয়েকখানা শ্যাওলাধরা ভাঙা ইট ছড়িয়ে আছে এদিকে-ওদিকে। কিন্তু তাই বলে ফকিরের মহিমার হ্রাস হয়নি বিন্দুমাত্রও। পুরোনো মদের মতো যতই দিন যাচ্ছে সে-মহিমা ততই অলৌকিক হয়ে উঠছে।
ফাঁকা মাঠের ভেতরে টিলার মতো একটুখানি উঁচু জমির ওপরে ফকিরের সমাধি। তা থেকে একটুখানি এদিকে সরে এলে একটা জংলা বট গাছ এলোমেলোভাবে জটা নামিয়েছে চারপাশে। বহুদিনের পুরোনো গাছ, হয়তো ফকিরের সমসাময়িক, হয়তো তার চাইতেও প্রবীণ। মোটা মোটা ডাল থেকে শিকড় নেমে ঢুকেছে মাটির নীচে, রচনা করেছে কতগুলো স্তম্ভের মতো। সব মিলিয়ে গম্ভীর থমথমে একটা আবহাওয়া। নিবিড় নীলাভ ছায়ার আচ্ছন্নতা, ভিজে ভিজে মাটি, কোটরে কোটরে প্যাঁচার আস্তানা। এইখানে ডাকাতে-কালীর থান।