রেডিয়োতে হিন্দি গান বাজে। বাচ্চাটা আবার পা ঠোকে তালে তালে। কানা এক চোখে তা দেখেও দেখতে পায় না। পাঞ্জাব—তার দেশ। অথচ সে দেশ কখনো দেখেনি। কে যেন তাকে বলেছিল হির-রনঝার গল্প, শুনিয়েছিল তার গান। রনঝাকে ভালোবেসে শেষে মহিষের রাখাল হতে হয়েছিল হিরকে, কী সে দুঃখ! কত কষ্ট!
হারামির জাত। বেকোয়াশ মহব্বত—বেফায়দা। সে তো নিজেই দুটোকে দেখল।
মাংসটা আরও জোরে কষতে কষতে কানা দাঁত কষকষ করে। কষা মাংসের গন্ধে আকুল হয়ে একটা কুকুর এসে দাঁড়িয়েছিল সামনে, একটুকরো কয়লা ছুড়ে মারে তার দিকে।
ভাগ হারামি কাঁহাকা!
কিন্তু সামনের ওই নীলটা মন খারাপ করে। সেই কালোকোলো উজ্জ্বল চোখ মেয়েটার কথা ভেবে মোচড় দিতে থাকে বুকের ভেতরে। যে-পাঞ্জাব সে কখনো দেখেনি, তার মেঘবরণ আকাশছোঁয়া গমের খেত ভেসে ওঠে সামনে। দেখতে পায় তাদের, কতকাল পরে আজও মহিষ চরাতে চরাতে যারা হির-রনঝার গান গায়।
এই বদমাশ।
গালাগালটা দেবে না ভেবেও সামলাতে পারে না, যেন মুখফসকে বেরিয়ে আসে। যে কাজটা নিজেই করা চলত, তার দায় চাপিয়ে দেয় বাচ্চাটার ওপর।
ঢালো, পানি ঢালো ইসমে।
ছেলেটা গরম জল ঢালতে থাকে মাংসের পাত্রে। কানা প্রতিমুহূর্তে আশা করে খানিকটা গরম জল উছলে পড়বে ছেলেটার পায়ে, ফোসকা পড়ে যাবে, ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচাতে থাকবে, যেমন তার হয়েছিল উনুনের পাশে শুতে গিয়ে একটুকরো গনগনে কয়লা পিঠের নীচে পড়বার পর। ছাই দিয়ে ঢাকা ছিল, বুঝতে পারেনি।
কিন্তু শেয়ালের মতো চালাক ছেলেটা। অসম্ভব হুঁশিয়ার, এক ফোঁটা জলও পড়ে না।
শালা হারামির বাচ্চা।
হঠাৎ ফুসে ওঠে ছেলেটা।
ঝুটমুট গাল দেতে কেঁও?
মারব এক থাপ্পর। ভাগ সামনে থেকে।
কানাইল সিং কিছুই শোনে না। এক হাতের মুঠোয় সাদা দাড়িটা চেপে ধরে খবরের কাগজ পড়ে যায়।
বেলা বাড়ে। মাংস নামে। ছেলেটা বেলে দেয়, কানা রুটি করতে থাকে। খদ্দেরদের আসবার সময় হয়ে এল। শব্দ করে একটা জিপ গাড়ি এসে থামে হোটেলের সামনে। টক টক করে লাফিয়ে পড়ে চার জন। ভারি জোয়ান চার জন শিখ। এক চোখে এক লহমা দেখেই কানা চিনতে পারে এদের। কোলিয়ারির লোক এরা—মালিকদের পোষা গুণ্ডা। মজদুরদের মধ্যে বেয়াড়াপনা দেখা দিলে এরাই দু-চার জনকে নিকাশ করে চালান করতে পারে কোনো পোড়ো খাদের অতলে, খুন করতে পারে দিনদুপুরে। এ ছাড়া ডাকাতি এদের বাঁধা ব্যাবসা। কখনো কখনো বিমা কোম্পানিকে ফাঁকি দেবার জন্যে এদের দিয়েই মালিক নিজের টাকা লুট করায়।
পুলিশে ধরে কখনো কখনো, আবার মালিকদের হাতের গুণে দু-দিনে ছটকে বেরিয়ে আসে। দরকার হলে দু-চারটে পুলিশকেও শেষ করে দেয়। একজন ফতে সিং, একজন ঠাকুর সিং, আর একজনের নাম জানে না; চতুর্থ জনও ঠিক তার মতো আসল নাম হারিয়ে ডালকুত্তা বলে বিখ্যাত।
ডালকুত্তাই বটে!
প্রকান্ড মাথা, প্রকান্ড মুখ। সারা মুখে কপালে চেচক-এর দাগ। অদ্ভুত চওড়া আর থ্যাবড়া নাক। জোড়া ভুরু দুটো এত মোটা যে প্রায় কপালের আধখানা জুড়ে গিয়েছে।
কথা কম বলে, কখনো হাসে না। আর আধবোজা মিটমিটে চোখে তাকায় ঠিক সাপের মতো। সে-চাউনিতে রক্ত হিম হয়ে যায়। এসব লোককে ভালো করে চিনিয়ে দিয়েছে কানাইল সিং নিজেই। নিজে ফৌজি হাবিলদার হয়েও সে ভয় পায় এদের। বলে, খুব হুঁশিয়ার, ডালকুত্তাকে কখনো ঘাঁটিয়ো না।
কার দায়, কে ঘাঁটাতে যাচ্ছে? বাচ্চাটা তো ওদের দেখলে ভয়েই সিঁটিয়ে যায়। আর কানা রান্না করে, খাবার সাজিয়ে দেয়। কানার হাতের মাংস খেলে খুশি হয় ওরা। যাবার সময় এক-আধটা থাবড়া আদর করে বসিয়ে যায় পিঠে। রোগা হাড়গুলো কনকন করে ওঠে তাতে।
ওদের ঢুকতে দেখে তটস্থ হয়ে উঠে দাঁড়ায় কানাইল সিং, আপ্যায়ন করে একগাল হেসে। অন্যদিন লোকগুলো খুশি থাকে, কুশল জিজ্ঞেস করে কানারও।
আজ আর ভালো করে জবাবও দেয় না। মুখগুলো কালো।
কেমন করে থাকব? বিরস মুখে জবাব দেয় ঠাকুর সিং, খবর ভালো না। জমানা বদলে যাচ্ছে।
কার জমানা, কেমন করে বদলাল, এসব নিয়ে কিছু ভাববার নেই কানার। তার জমানা তো এই কানাইল সিংয়ের হোটেলের চৌহদ্দিতেই ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু লোকগুলোর কথা শুনে কেমন ভয় পায় বুড়ো, চুপ করে ফিরে যায় নিজের জায়গায়।
এক কোনায় যেখানে একটা কালো পর্দা দিয়ে ঘেরার ব্যবস্থা আছে, সেখানে গিয়ে বসে চার জন। টেনে দেয় পর্দা। খাবারের হুকুম দেয় না। বাচ্চাটাকে বলে, দো সোডা মাঙ্গাও, আউর গিলাস।
বাচ্চা সোড়া আনতে ছোটে পাশের দোকানে। চাপা গলায় কী আলাপ করে ওরা, শোনা যায় না। রেডিয়োটার আওয়াজ কমিয়ে দিয়ে কানাইল সিং আবার ডুব দেয় খবরের কাগজে।
সোডা আসে, গেলাস যায়। বোতল খোলার শব্দ ওঠে।
হয়তো ডাকাতির মতবল ভাঁজছে, হয়তো খুনখারাপির। কিংবা পুলিশেই হুড়ো লাগিয়েছে হয়তো-বা। রুটি সেঁকতে সেঁকতে আবার কানার চোখ চলে যায় আকাশের দিকে। বাচ্চাটা বাইরে বেঞ্চিতে বসে থাকে চুপ করে। জিটি রোড দিয়ে গাড়ি ছোটে, ওধারে রেল আসা যাওয়া করে, সময় যায়।
আরও দুজন খদ্দের আসে। রুটি, আলু-মটর, জল খেয়ে পয়সা দিয়ে চলে যায় তারা। বাচ্চা টেবিল সাফ করে। বাইরে কাকের ডাক ওঠে। বেলা বাড়ে। সময় যায়।