ঝুমরো বাঁচিয়া উঠিল।
চন্দনের আনন্দের অবধি নাই। কিন্তু চন্দনের সময় নাই, সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ – ঝুমরোর প্রাণের বিনিময়ে, সে আত্মবিক্রয় করিয়াছে জহরের কাছে। এখন সে জহরের। ঝুমরোকে সে উত্তেজিত করুণ, ভগ্নকন্ঠে বলে, ‘তুই দূরে চলে যা ঝুমরো, আমার চোখের সুমুখে থাকিসনে–আমি তোর নই’।
যে তাহার প্রাণাধিক প্রিয়, একান্ত আপন, জীবনসর্বস্ব, তাহাকে সে চায় না। চন্দনের উদ্গত অশ্রু আর বাধা মানে না। কণ্ঠরোধ হইয়া আসে। অব্যক্ত যন্ত্রণায় হৃদ্পিন্ড যেন ছিঁড়িয়া যায়, তাহাকে তাড়াইয়া দিতে।
অদূরে দাঁড়াইয়া, জহর এই করুণ দৃশ্য দেখিতেছিল। যে কালীয়নাগ মন্ত্রবলে ফিরিয়া আসিয়া ঝুমরোকে বিষমুক্ত করিয়াছে, সে তখনও তাহার হাতে।
জহর একবার অদ্ভুত দৃষ্টিতে চন্দনের দিকে তাকাইল, একবার তাকাইল ঝুমরোর দিকে – জহর একবার মনে-মনে কী যেন ভাবিল।
অকস্মাৎ সে নির্বিকারভাবে সেই কালীয়নাগের দংশন নিজের বুক পাতিয়া গ্রহন করিল।
ঝুমরো চিৎকার করিয়া কহিল, ‘ওস্তাদ কী করিলে!’
চন্দন ও ঝুমরো দুজনেই ছুটিয়া জহরের কাছে গেল। জহর ক্রুদ্ধকন্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘ঝুমরো শিগগির একে নিয়ে চলে যা আমাদের সমুখ থেকে – আমি বিষ হজম করব, এই আমার শেষ সাপ – তারপর আমি মন্ত্র পড়ব। মেয়েমানুষের সামনে মন্তর নষ্ট হয়। ওকে এখান থেকে নিয়ে যা – এ জঙ্গল থেকে, এ দেশ থেকে নিয়ে যা।’ চন্দন আর ঝুমরো অগত্যা চলিয়া গেল। ওস্তাদ দেখিল তাহারা দূরে চলিয়া গেছে, কিন্তু নাগমন্ত্র আর সে উচ্চারণ করিল না। স্মিতহাস্যে আপন মনে সে বলিয়া উঠিল, “মন্তর, ও সাপের মন্তর আর নয় – এইবার আমার মন্তর –‘শিব-শম্ভু-শিব-শম্ভু!’!”
কালীয়নাগের বিষে তাহার সর্বশরীর ক্রমশ নীল হইয়া আসিতে লাগিল, চোখ দুইটি স্তিমিত নিস্তেজ হইয়া গেল; কিন্তু তাহার সমস্ত মুখের উপরে মনে হইল, কীসের যেন এক অপার্থিব আনন্দের ভাস্করদীপ্তি প্রতিফলিত হইয়াছে, তাহার বিক্ষুব্ধ আত্মার সমস্ত বিক্ষোভ যেন শান্ত হইয়া গিয়াছে, জীবনব্যাপী মর্মযন্ত্রণার যেন অবসান হইয়াছে।
সর্বশেষ সর্পের শ্রেষ্ঠ মন্ত্র-সাধনার পরিণামে সে সিদ্ধকাম হইল কি?