- বইয়ের নামঃ আখ্যান
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
সাপুড়ে (সংগীতাংশ)
এক
হলুদ-গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল,
এনে দে, এনে দে, নইলে রাঁধব না বাঁধব না চুল,
কুসমি রং শাড়ি চুড়ি বেলোয়ারি
কিনে দে হাট থেকে,
এনে দে মাঠ থেকে
বাবলা ফুল, আমের মুকুল।
নইলে রাঁধব না, বাঁধব না চুল॥
কুঙ্কুম পাহাড়ে, শাল-বনের ধারে
বসবে মেলা আজি বিকেল বেলায়।
দলে দলে পথে চলে সকাল হতে
বেদে-বেদিনি নূপুর বেঁধে পায়।
যেতে দে ওই পথে বাঁশি শুনে শুনে পরান বাউল॥
নইলে রাঁধব না বাঁধব না চুল॥
দুই
আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই,
ওই পাহাড়ের ঝরনা আমি ঘরে নাহি রই গো
উধাও হয়ে বই॥
চিতা বাঘ মিতা আমার,
গোখরো খেলার সাথি,
সাপের ঝাঁপি বুকে ধরে
সুখে কাটাই রাতি।
ঘূর্ণি হাওয়ার উড়নি ধরে নাচি তাথই থই॥
তিন
কলার মান্দাস বানিয়ে দাও গো,
শ্বশুর সওদাগর,
ওই মান্দাসে চড়ে যাবে বেউলা লখিন্দর,
কলার মান্দাস।
ওলো কুল-বালা নে এই পলার মালা,
বর তোর ভেড়া হয়ে রইবে মালার ভয়ে
ও বউ, পাবি না জীবনে সতিন জ্বালা॥
আমার বেদিনি গো, পাহাড় দেশের বেদিনি।
গলার ঘ্যাগ, পায়ের গোদ, পিঠের কুঁজ,
বের করি দাঁতের পোকা, কানের পুঁজ;
ঔষধ জানি লো, হোঁতকা স্বামীর
কোঁতকা খায় যে কামিনী॥
পেতনি পাওয়া মিনসে গো ভূতে-ধরা বউ গো।
কালিয়া পেরেত মামদো ভূত
শাঁখচুন্নি হামদো পুত
পালিয়ে যাবে, বেদের কবচ লও গো॥
বাঁশের কুলো, বেতের ঝাঁপি, পিয়াল পাতার টুকি।
নাও ওগো বউ, হবে খোকা-খুকি॥
নাচ, নাচ, নাচ–বেদের নাচ? সাপের নাচ?
সোলেমানি পাথর নেবে? রঙিন কাচ?
চার
দেখি লো তোর হাত দেখি।
হাতে হলুদ-গন্ধ, এলি রাঁধতে রাঁধতে কি?
মনের মতন বর পেলে, নয় কন্যা ছয় ছেলে।
চিকন আঙুল দিঘল হাত, দালান-বাড়ি ঘরে ভাত,
হাতে কাঁকল পায় বেঁকি।
ও বাবা! এ কোন ছুঁড়ি? সাত ননদ তিন শাশুড়ি।
ডুবে ডুবে খাচ্ছ জল, কার সাথে তোর পিরিত বল।
চোখের জলে পারবি তারে বাঁধতে কি?
পাঁচ
(কথা)কইবে না কথা কইবে না বউ
তোর সাথে তার আড়ি-আড়ি-আড়ি।
(বউ)মান করেছে, যাবে চলে আজই বাপের বাড়ি॥
বউ কসনে কথা কসনে এত অল্পে অধীর হস নে,
ও নতুন ফুলের খবর পেলে
পালিয়ে যাবে তোকে ফেলে,
ওর মন্দ স্বভাব ভারী॥
ছয়
মৌটুসি –পিছল পথে কুড়িয়ে পেলাম হিজল-ফুলের মালা।
কী করি এ মালা নিয়ে বল, চিকন-কালা॥
চন্দন – নই আমি সে বনের কিশোর,
(তোর) ফুলের শপথ, নই ফুল চোর,
বন জানে আর মন জানে লো, আমার বুকের জ্বালা॥
ঝুমরো –ঘি-মউ-মউ আম-কাঁঠালের পিঁড়িখানি আন,
বনের মেয়ে বন-দেবতায় করবে মালা দান।
লতা-পাতার বাসর-ঘরে রাখ ওরে ভাই বন্ধ করে,
ভুলিসনে ওর চাতুরিতে ওলো বনবালা॥
সাত
ফুটফুট ওই চাঁদ হাসেরে ফুল-ফুটানো হাসি
হিয়ার কাছে পিয়ায় ধরে বলতে পারি আজ যেন রে
তোমায় নিয়া পিয়া আমি হইব উদাসী॥
সাপুড়ে – কাহিনি
সভ্যজগতের সুসমৃদ্ধ জনপদ হইতে বহুদূরে, কখনও ঘননীল শৈলমালার সানুদেশে, ভীষণ নির্জন, দুর্গম অরণ্যের মধ্যে, কখনও বা তরঙ্গ-ফেনিল বঙ্কিম গিরি-নদীর তীরে, দিগন্ত বিস্তীর্ণ প্রান্তরে, যাযাবর সাপুড়ের দল তাহাদের ক্ষণস্থায়ী নীড় রচনা করে।
এমনই এক ভবঘুরে সাপুড়েদলের ওস্তাদ সে। নাম তাহার জহর। দলের সে বিধাতা, একচ্ছত্র অধিপতি। দলের প্রত্যেকটি লোক তাহাকে ভয় করে যমের মতো, ভক্তি করে দেবতার মতো। শুধু দলের একটি মাত্র লোক, তাহার এই অপ্রতিহত প্রভুত্বগৌরবে ঈর্ষার জ্বলিয়া পুড়িয়া মরে, মনে-মনে দারুণ অবজ্ঞা করে জহরকে, কিন্তু প্রকাশ্যে তাহার বিরুদ্ধাচরণ করিবার সাহসও তাহার হয় না। এই লোকটির নাম বিশুন, তাহারও দুই একজন অনুচর আছে।
মনে-মনে সে মৃত্যু কামনা করে জহরের, কখনও-বা কেমন করিয়া জহরকে চূর্ণ করিয়া একদিন সে সর্দার হইয়া উঠিবে, সেই কল্পনায় চঞ্চল হইয়া উঠে।
সেদিন নাগ-পঞ্চমী।
জহর পাহাড়তলিতে গিয়াছিল বিষধর সর্পের সন্ধানে। তাহার তুবড়ি বাঁশিতে, সে বাজাইতেছিল একটানা মোহনিয়া সুর – বাঁশির রন্ধ্রে রন্ধ্রে, গমকে গমকে, তীব্র মধুর উন্মাদনা কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছিল! সেই সুরে আকৃষ্ট হইয়া বনের ভিতর হইতে, একটি বিষধর কালীয়নাগ ফণা দুলাইতে দুলাইতে বাহির হইয়া আসিল। দারুণ উত্তেজনায়, জহরের চোখের তারা দুইটি জ্বলিয়া উঠিল। হঠাৎ হাতের বাঁশিটা সে দূরে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল এবং সেই কালীয়নাগের উদ্ধত ফনার সুমুখে তাহার অকম্পিত করতল পাতিয়া ধরিল। মুহূর্তে একটি তীব্র দংশন। দেখিতে দেখিতে জহরের সর্বশরীর সেই সাপের বিষে একেবারে নীল হইয়া গেল। দলের সমস্ত লোক সভয়ে, স্তম্ভিত বিস্ময়ে জহরকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। জহর কিন্তু নিষ্কম্প, নির্বিকার – উদ্বেগের চিহ্নমাত্রও তাহার মুখে ফুটিয়া উঠে নাই। ধীরগম্ভীরকণ্ঠে, সে মন্ত্র উচ্চারণ করিতে লাগিল এবং ধীরে ধীরে শীঘ্রই বিজয়ী বীরের মতো সগৌরবে বিষমুক্ত হইয়া উঠিল। বিমুগ্ধ, বিস্মিত জনতা সমস্বরে জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল। মুখ কালো করিয়া, বিশুন ধীরে ধীরে নীরবে সেখান হইতে সরিয়া গেল।
ঠিক এমনই করিয়া আজ পর্যন্ত, জহর নিরানব্বইবার নিজের দেহে সর্পদংশন করাইয়া, অবলীলাক্রমে বিষমুক্ত হইয়াছে। এইবার শততম এবং শেষতম সর্পদংশন। এই সর্বশেষ সর্পের বিষ, মন্ত্রবলে আপন দেহ হইতে টানিয়া বাহির করিতে পারিলেই, তাহার কঠোর ব্রত উদ্যাপিত হইবে; সে সর্পমন্ত্রে সিদ্ধকাম-হইবে। এই মন্ত্রে সিদ্ধ হওয়াই জহরের জীবনের পরমতম লক্ষ্য, একমাত্র মহাব্রত।