অন্য এক পুরাণে উল্লেখ আছে, জাবালি মুনির তপস্যা ভঙ্গ করতে ইন্দ্র গণিকা রম্ভাকে নিয়োগ করেন। রম্ভা ইন্দ্রের ষড়যন্ত্র সফল করেন। রম্ভার রূপ-যৌবনে কামমোহিত হয়ে জাবালি মুনির সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হন। এর ফলে মুনির ঔরসে রম্ভা এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। জাবালি এই কন্যার প্রতিপালন করেন। কন্যার নাম দেন ফলবতী। জাবালি মুনি বিশ্বামিত্রের মতোই অসংযমী হলেও বিশ্বামিত্রের মতো নিজ সন্তানকে প্রত্যাখ্যান করেননি। তবে বিশ্বামিত্রের সময়ে মেনকা যে কাজটি করেছেন, রম্ভাও সেই কাজ করেছেন। নিজ সন্তানকে ত্যাগ করে চলে যান। সেটাই স্বাভাবিক। তাঁরা গণিকাধর্ম পালন করেছেন, সন্তানের মা হতে নয়।
তিলোত্তমা : কালিকাপুরাণে আমরা গণিকা তিলোমাকে পাই। অপরূপা গণিকাদের মধ্যে অন্যতম। দৈত্যরাজ নিকুম্ভের দুই পুত্র সুন্দ ও উপসুন্দকে রূপের জালে ফাঁসানোর জন্য তিলোত্তমাকে নিয়োগ করা হয়েছিল। সুন্দ ও উপসুন্দ দুই ভাই ত্রিলোক বিজয়ের জন্য কঠোর তপস্যার মাধ্যমে ব্রহ্মার কাছে অমরত্ব প্রার্থনা করেন। কিন্তু ব্রহ্মা এঁদেরকে অমরত্ব দানে মোটেই রাজি নন। শেষপর্যন্ত অমরত্ব দিতেই হল, তবে তা কৌশল করেই। বলা হল, স্থাবর-জঙ্গমের কোনো প্রাণীই তাঁদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এ পর্যন্ত এটা একপ্রকার অমরত্ব বলেই ভ্রম হতে পারে। মৃত্যুহীন জীবনযাপন করতে পারবে তা কি হয়? অর্থাৎ এরপর সংযোজন করা হল–তাঁদের মৃত্যু তখনই হবে, যখন দুই ভাই পরস্পর পরস্পরের হাতে হত্যা করবে। সুন্দ ও উপসুন্দ দুই ভাইয়ের মধ্যে এত ভাব-ভালোবাসা ছিল যে, এঁরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি এক ভাইয়ের দ্বারা অন্য ভাইয়ের ন্যূনতম ক্ষতি হতে পারে। তাই অমরত্বের দাপটে স্বর্গলোকে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। ওঁরা স্বপ্নে কখনো ভাবতে না পারলেও বরদাতা ব্রহ্মা সেই ব্যবস্থা করে নিলেন, যাতে দুই ভাইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হল যৌন-আবেদনময়ী লাস্যময়ী নারীকে। এতটাই যৌন-আবেদনময়ী নারীকে ব্যবহার করা হল, তেমন নারী গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেও দেখা গেল না। তাই স্বয়ং ব্রহ্মা স্পেশাল নারী সৃষ্টি করলেন, যিনি স্বর্গীয় সুন্দরী তিলোত্তমা। যাঁকে দেখে পাথর পর্যন্ত গলে যাবে, আর সুন্দ ও উপসুন্দ তো রক্তমাংসের! ত্রিভুবনের সমস্ত উত্তম বস্তু তিল তিল করে সংগ্রহ করে ব্রহ্মা এই তিলোত্তমাকে সৃষ্টি করলেন। সুন্দ ও উপসুন্দকে নিকেশ করতে নিয়োগ করা হল তিলোত্তমাকে। পরমা সুন্দরী তিলোত্তমা দুই ভাইয়ের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন উপস্থিত হয়ে নৃত্য শুরু করে দিলেন। তিলোতমার ভুবনমোহিনী রূপ আর কামোদ্দীপক দেহবল্লরীর ঝাঁকুনিতে দুই ভাই বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। দুজনেই তিলোত্তমাকে কাছে পেতে চাইলেন। কিন্তু একজন নারীকে দুইজন কীভাবে পেতে পারে! তার উপর এইসব গণিকারা যত জনের সঙ্গেই যৌনমিলন করুক না-কেন, এঁরা পুনরায় কুমারীত্ব ফিরে পায়। এরা সসময়ই কুমারী। এ স্বাদের তো ভাগও করা সম্ভব নয়। অতএব যুদ্ধ, এক নারীকে পাওয়ার জন্য দুই ভাইয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যুদ্ধে দুই ভাইয়েরই মৃত্যু হল একে অপরের শাণিত অস্ত্রে। বোধহয়, স্বয়ং ঈশ্বর গণিকা সৃষ্টি করলেন কামুক পুরুষদের ধ্বংসের জন্য।
ঘৃতাচী : স্বর্গের আরও একজন গণিকার কথা না বললেই নয়। তিনি ঘৃতাচী। ইন্দ্রের হুকুমে ইনিও নিজের নগ্ন রূপ দেখিয়ে প্রচুর মুনি-ঋষিদের তপস্যাকর্মে জল ঢেলে দিয়েছেন। ঘৃতাচী এতটাই যৌন-আবেদনময়ী ছিলেন যে, তাঁকে দেখামাত্রই পুরুষদের বীর্যপাত হয়ে যেত। যেমন-তেমন পুরুষ নয় এমন মুনি-ঋষিদেরও একই হাল হত। ঘৃতাচীকে দেখে ভরদ্বাজ ঋষিরও বীর্যপাত হয়ে যায়। এই পতিত বীর্যেই দ্রোণের জন্ম হয়। ইনিই মহাভারতের দ্রোণাচার। অপরদিকে চ্যবন ও সুকন্যার পুত্র প্রমতির সঙ্গে ঘৃতাচী যৌনমিলন হয় এবং রুরুর জন্ম হয়।
একবার ব্যাসদেব সুমেরু পর্বত থেকে নিজ আশ্রমে ফিরে হোমের আয়োজন করছিলেন। সেসময় সেই হোম অনুষ্ঠানে গণিকা ঘৃতাচী এসে উপস্থিত হন। ঘৃতাচীকে দেখামাত্রই ব্যাসদেব কামাতুর হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় অনিবার্য ধর্ষণের আশঙ্কায় ঘৃতাচী পড়িমরি করে অকুস্থল থেকে পালিয়ে যান শুকপাখির রূপ ধরে। কিন্তু চরম কামোত্তেজনায় ব্যাসদেবের বীর্যপাত হয়ে যায়। সেই বীর্য অরণির (অরণি হল একপ্রকার কাঠ, যে কাঠের ঘর্ষণে আগুন জ্বলে) উপর ছিটকে গিয়ে পতিত হয়। ব্যাসদেব সেই অরণি মন্থন করতে শুরু করে দিলেন। মন্থনের ফলে এক শিশুপুত্রের জন্ম হয়। ঘৃতাচীকে স্মরণ করে সেই শিশুপুত্রের নাম রাখেন শুক। স্বর্গের সব গণিকাদের নিয়ে আলোচনা করাই যেত। কিন্তু তাতে কলেবর বৃদ্ধি হয়, লাভ কিছু হয় না। কয়েকজন গণিকার বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করলাম স্বর্গের গণিকাদের বিষয়ে কিঞ্চিত আভাস দেওয়ার জন্য। আর-একটু সংযোজন করি। এইসব অনন্তযৌবনা গণিকারা দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশে গুপ্তচরবৃত্তি ও গুপ্তহত্যার কাজে নিযুক্ত হতেন। রামায়ণেও প্রচুর গণিকার উল্লেখ আছে, যাঁরা গুপ্তচর বৃত্তির কাজে নিয়োজিত ছিল। রামচন্দ্রের অভিষেকের সময় প্রচুর গণিকা অংশগ্রহণ করেছিলেন। রামায়ণের যুগে বিশিষ্ট অভ্যাগতদের অভ্যর্থনায় রাজপরিবারের মানুষদের মৃগয়ায় গণিকাদের নিয়োগপ্রথার প্রচলন ছিল। গণিকা কর্তৃক ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির প্রলোভনের আখ্যান রামায়ণে সুখ্যাত হয়ে আছে।