মেনকা : মহাঋষি বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভাঙার জন্য গণিকা মেনকাকে নিয়োগ করা হয়েছিল। মেনকা নগ্ন হয়ে কামনামদির নৃত্য প্রদর্শন করে কামশৃঙ্গারে বিশ্বামিত্রকে বিচলিত করেছিল। তারই ফলস্বরূপ বিশ্বামিত্র গণিকা মেনকার সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য হন এবং শকুন্তলার জন্ম দেন। যেহেতু এই ধরনের সম্পর্ক এবং সম্পর্কের ফলে জন্মানো সন্তান সমাজ স্বীকৃত নয়, সেহেতু সেই সদ্যজাত শিশুকে মালিনী নদীর তীরে নিক্ষেপ করে মেনকা পালিয়ে যায়। পালাবেই না-কেন, মেনকা তো মা হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় জন্ম দেননি। তিনি আজ্ঞাবাহক মাত্র। ঋষির ধ্যান ভাঙতে সফল হয়েছেন, সেইসঙ্গে তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্যও শেষ হয়েছে।
হিন্দুধর্ম মতে, ব্রাহ্মণগণ কঠোর তপস্যার ফলে দেবতা পদে উন্নীত হতে পারতেন। বিশ্বামিত্র তেমনই একজন ব্রাহ্মণ, দোর্দণ্ডপ্রতাপ। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে যেমন সমীহ করতেন, তেমনি ঈর্ষাও করতেন। ভয়ও করতেন। ইন্দ্র সর্বদাই এক আতঙ্কে ভুগতেন, এই বোধহয় কেউ এসে তাঁর সিংহাসন ও পদ দখল করে নিল। ইন্দ্র আশঙ্কায় থাকতেন, ইন্দ্রের রাজ্যে বিশ্বামিত্র হানা দিতে পারেন। বিশ্বামিত্র তপস্যায় মগ্ন হলে ইন্দ্র বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভাঙার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। হাতিয়ার করলেন গণিকা মেনকাকে। বিশ্বামিত্রের ধ্যানভঙ্গের জন্য মেনকাকে নির্দেশ দিলেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই। সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানভাবে চলছে। আজও বিভিন্ন কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে নেতা-মন্ত্রী-ধনী-পুঁজিপতিরা গণিকাদের রূপ-যৌবনকে কাজে লাগায়। এমনকি সেনানায়কদেরও কুপোকাৎ করে গোপন নথি সরিয়ে ফেলা হয়। গণিকা নিয়োগের মাধ্যমে কত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে যাচ্ছে, তার হিসাব কে রেখেছে! খেলোয়াড়দের মনোযোগ নষ্ট করার জন্য নারীকে নগ্ন করিয়ে মাঠের মাঝখান দিয়ে দৌড় করানোর রেকর্ড তো আছেই। খেলোয়াড়দের নারীমাংসের আবেশে ভুলিয়ে রাখার জন্য কত গণিকা যে হোটেল পর্যন্ত হানা দেয়!
কালিকাপুরাণে আমরা মেনকাকে দক্ষকন্যা সতীর সখী হিসাবে পাই। মহাভারতেও মেনকাকে পাই গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসুর স্ত্রী হিসাবে। বিশ্বাবসু ও মেনকার মিলনে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। সেই কন্যাকে মহর্ষি স্থূলকেশের আশ্রমের পাশে বয়ে চলা এক নদীতীরে চলে যান। মহর্ষি সেই পতিত কন্যা দেখতে পেয়ে তাঁকে আশ্রমে এনে লালনপালন করতে থাকেন। নাম দেন প্রমদ্বরা। প্রমদ্বরা মহাভারতে উল্লিখিত বিখ্যাত রাজা রুরুর স্ত্রী।
উর্বশী : উর্বশী নাকি নারায়ণের উরু থেকে জন্ম নিয়েছেন। সে যেখান থেকেই জন্ম নিক, ইনি একজন স্বনামখ্যাত স্বর্গের পরমা সুন্দরী গণিকা। শতপথব্রাহ্মণে উর্বশী ও পুরূরবার প্রেমকাহিনি আছে। এই কাহিনি ঋগবেদেও কিছুটা পাওয়া যায়। সেই কাহিনি এখানে উল্লেখ করার প্রাসঙ্গিকতা নেই। পদ্মপুরাণে আছে, বিষ্ণু ধর্মপুত্র হয়ে পর্বতে তপস্যা করছিলেন। তাঁর এই তপস্যায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। অতএব বিষ্ণুর তপস্যায় বিঘ্ন ঘটাতে হবে। ভাবনার বাস্তবায়ন করতে ইন্দ্র কয়েকজন গণিকার সঙ্গে বসন্ত ও কামদেবকে চক্রান্তে নিয়োগ করলেন। তাঁদের পাঠিয়ে দিলেন বিষ্ণুর ধ্যানভঙ্গ করতে। বলা হয়েছে, সেই দল তপস্যা ভঙ্গে ব্যর্থ হলে স্বয়ং কামদেব অন্যান্য গণিকাদের উরু থেকে উর্বশীকে সৃষ্টি করলেন এবং বিষ্ণুর ধ্যানভঙ্গ করতে পাঠিয়ে দিলেন। এর কার্যসিদ্ধি হল। কার্যসিদ্ধি করলেন গণিকা উর্বশী ধ্যান ভাঙলে বিষ্ণু উর্বশীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। উর্বশী রাজি হয়ে যান। উর্বশীর পতন হল পরে। না, বিষ্ণুর কারণে নয়। উর্বশীর পতন হল মিত্র ও বরুণের অভিশাপে (পড়ুন নির্দেশে)। বিষ্ণুর কিছু পরে মিত্র ও বরুণ উর্বশীকে কাছে পেতে চাইলেন। উর্বশী তা প্রত্যাখ্যান করেন। সেই অপরাধে উর্বশীকে মনুষ্যভোগ্যা করে মর্ত্যলোকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কারোকে প্রত্যাখ্যানের অধিকার গণিকার নেই। তাই এই চরমতম শাস্তি।
রম্ভা : রম্ভা হলেন স্বর্গগণিকাদের মধ্যে অন্যতম। রম্ভা নামের মানে কলাগাছের মতো পুষ্ট যে নারীর উরু। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে উল্লেখ আছে, লঙ্কেশ্বর রাবণ পথে রম্ভাকে একা পেয়ে জোরপূর্বক যৌনসঙ্গম করেন। রম্ভা কুবেরের পুত্র নলকুবেরের কাছে অভিসারে যাওয়ার সময় রম্ভাকে দেখে কামদগ্ধ হয়ে পড়ে রাবণ। লঙ্কেশ্বর রাবণ সংযম হারিয়ে খোলা আকাশের নীচেই রম্ভাকে ধর্ষণ করেন। এরপর রম্ভা নলকুবেরের কাছে পৌঁছে সমস্ত ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেন। সেই অপরাধে নলকুবের রাবণকে অভিসম্পাত করেন–রাবণ যদি কখনো নারীকে বলপ্রয়োগ করে ধর্ষণ করবে, তখনই তাঁর মাথা সাত খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যাবে।
স্কন্ধপুরাণে উল্লেখ আছে, বিশ্বামিত্রের তপস্যায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র গণিকা রম্ভাকে নিয়োগ করেন। কিন্তু ইন্দ্র এই অপারেশন চরমভাবে ব্যর্থ হন, সেইসঙ্গে বিশ্বামিত্রের ক্রোধে বিশ্বামিত্রের আশ্রমে রম্ভা ১০০০ বছরের জন্য শিলায় পরিণত হন। বিশ্বামিত্রের আশ্রমে যেসময় রম্ভার শিলারূপে অবস্থান করছিলেন, সেসময় অঙ্গকার নামে রাক্ষুসী নানারকম উপদ্রব করছিলেন। সেসময় ওই আশ্রমে তপস্যারত শ্বেমুনি বায়ব্য অস্ত্রে ওই শিলারূপী রম্ভাকে দু-টুকরো করে রাক্ষুসীকে লক্ষ করে নিক্ষেপ করেন। রাক্ষুসীর মৃত্যু হয়। রম্ভা আবার নিজরূপ ফিরে পান। স্কন্ধপুরাণের অন্য এক কাহিনি বলছে, ইন্দ্রের সভায় নৃত্য পরিবেশনের সময় রম্ভার তালভঙ্গ হয়। ইন্দ্র ক্ষুব্ধ হন এবং রম্ভাকে স্পন্দনহীন বিকলাঙ্গ করে সভা থেকে বহিষ্কার করে ভূতলে নিক্ষেপ করেন। গণিকার ভুল হতে নেই যে। পরে অবশ্য ব্ৰহ্মর্ষি নারদের পরামর্শে শিবকে সন্তষ্ট করে ইন্দ্রলোকে ফিরে আসতে সক্ষম হন।