অধিকাংশ স্বৰ্গবেশ্যার স্বামী ছিলেন গন্ধর্বরা। তবে অপ বা জল থেকে উৎপন্ন হননি, এমন কিছু অতুলনীয় নারীকেও স্বৰ্গবেশ্যা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এঁদের মধ্যে স্বর্গের কিছু স্বাধীনা স্বৰ্গবেশ্যাও আছেন। এঁদেরকে সপ্তম মনু সৃষ্টি করেছিলেন বলে জানা যায়। এদের সংখ্যা প্রায় ৬০,০০০। এই ৬০,০০০ স্বৰ্গবেশ্যাদের অধিপতি ছিলেন কামদেবতা। এঁরা নৃত্যকলায় পারদর্শী ছিলেন। অধিকাংশ সময় গন্ধর্বদের সঙ্গে এঁরা ইন্দ্রের সভায় নর্তকী হিসাবে নৃত্য প্রদর্শন করতেন।
ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায় ৪৫-৫০ শ্লোকে পাওয়া যায়, ব্রহ্মা ভরতকে কৌশিকীনৃত্তির জন্য শিবের নৃত্য থেকে শৃঙ্গাররসের উপযোগী কোমল অঙ্গহার, আত্মা রস, ভাব ও ক্রিয়া নামক উপাদান দেন। এ সকল উপাদান নারী ছাড়া পুরুষ এককভাবে প্রয়োগ করতে পারে না। তাই ব্রহ্মা কিছু নিপুণ অপ্সরা তৈরি করলেন। এই অপ্সরা ছিলেন মঞ্জুকেশী, সুকেশী, মিশ্রকেশী, সুলোচনা, সৌদামিনী, দেবদত্তা, দেবসেনা, মনোরমা, সুদতী, সুন্দরী, বিদগ্ধা, সুমালা, সন্ততি, সুনন্দা, সুমুখী, মাগধী, অর্জুনী, সরলা, কেরলা, ধৃতি, নন্দা, সুপুষ্কলা ও কলভা। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিগুলোতে যে সমস্ত স্বৰ্গবেশ্যা বা অপ্সরার নাম পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন—অদ্রিকা, অরুণা, অর্জুনী, অলম্বুষা, অসিতা, উর্বশী, কলভা কেরলা, ঘৃতাচী, জানপদী, তিলোতমা, দেবদত্তা, দেবসেনা, ধৃতি, নন্দা, নাগদত্তা, পুঞ্জিকাস্থলা, বিদগ্ধা, বিদ্যুৎপর্ণা, বিশ্বাচী, পঞ্চচূড়া, পূর্বচিত্তি, মঞ্জুকেশী, মনোরমা, মাগধী, মিশ্রকেশী, মেনকা, রম্ভা, রুচিরা, সরলা, সুকেশী, সুদতী, সুনন্দা, সন্ততি, সুন্দরী, সুপুষ্কলা, সুবাহু, সুমধ্যা, সুমালা, সুমুখী, সুলোচনা, সোমা, সৌদামিনী, হেমা প্রমুখ। এঁদের মধ্যে মেনকা, উর্বশী, রম্ভা ও তিলোত্তমা হলেন অন্যতম। পুরাণে নানা রকম নারী আছে। স্বৰ্গবেশ্যা নারী, সতী নারী, ছলনাময়ী নারী, রহস্যময়ী নারী। পুরাণ থেকে নারী সরিয়ে দিলেই তা আর পুরাণ থাকে না।
খুব সুন্দরী মেয়েদের ‘অপ্সরা সুন্দরী’ বলার সময় কি কাদের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে সুন্দরীদের ভাবা হয়? সে যাই হোক, এইসব অপ্সরারা যে অতীব সুন্দরী ছিলেন, এটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। তাঁরা শুধু অতীব সুন্দরী ছিলেন, তা নয়। তাঁরা নৃত্য ও সংগীতেও পারদর্শিনী ছিলেন। ইন্দ্রের সভায় এঁদের গায়িকা ও নর্তকী হিসাবে পাই। এঁদের উপস্থিতিতে ইন্দ্রের সভা সর্বদাই ঝলমলে থাকত। স্বর্গের গণিকাদের অধিপতি ছিলেন স্বয়ং কামদেব। তাই কামদেব এইসব গণিকাদের যৌনপ্রতিমা করে গড়ে তুলেছিলেন। মোদ্দা কথা, গণিকা মানেই সাক্ষাৎ যৌনপ্রতিমা। যৌনক্রিয়ায় ইচ্ছাপূরণ দেবী যেন। তথাকথিত দেবতারা আসন্ন বিপদের ঘ্রাণ পেলেই সেই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে পরমা সুন্দরী গণিকাদের লেলিয়ে দিত। এই লেলিয়ে দেওয়ার কাজটি করতেন স্বয়ং ইন্দ্র। দেবরাজ ইন্দ্র প্রায়ই এঁদের পাঠিয়ে দিত মুনি-ঋষিদের প্ররোচিত ও প্রলোভিত করে ধ্যানভঙ্গ করার জন্য। কারণ তাঁদের ধ্যান সমাপ্ত হলে তাঁরা যদি প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে ওঁর ইন্দ্ৰত্ব (ইন্দ্রত্ব’ বিষয়টি আর কিছু নয়। ইন্দ্রত্ব একটি পদমাত্র। ইন্দ্রের পদ এবং ঐশ্বর্য ) দাবি করে বসে! গণিকারা ছলা আর কলায় তাঁদের বিভোর করে কাজ হাসিল করে নিত। এইসব গণিকারা মুনি-ঋষিদের ধ্যান ভাঙাতেন। কেন ধ্যান ভাঙাতেন? উদ্দেশ্য কী? কারণ বৈদিক যুগে কঠোর তপস্যার বলে কখনো-কখনো দেবতাদের চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর উঠতেন মুনি-ঋষিরা। যাতে তাঁরা দেবতাদের চেয়ে ক্ষমতাধর হয়ে না-পড়েন, সেই কারণেই গণিকাদের নিয়োগ করা হত। এমনকি অসুরদের কবজা করতেও এঁদের নিয়োগ করা হত।
পাঠকগণ, আলোচনায় দেবতা প্রসঙ্গে বিভ্রান্ত হবেন না। হিন্দুসমাজের দেবতা কোনো অশরীরী, অলৌকিক কোনো বিষয় নয়। কিছু নিছক কাল্পনিক হলেও বেশিরভাগই শরীরী, রক্তমাংসের অস্তিত্ব। দেবতাদের জন্ম আছে, পূর্বাপর-সম্বন্ধ আছে। এক দেবতা থেকে আর-এক দেবতার জন্ম আছে। প্রায় সব বিষয়েই মানুষের সঙ্গে দেবতাদের মিল দেখা যায়। তাই হিন্দুধর্মের দেবতাদের মধ্যে মানুষেরই প্রতিরূপ পাওয়া যায়। সেই কারণে পুরাণের বর্ণিত দেবতারা মানুষের মতো দোষেগুণে (ষড়রিপু = কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য) গড়ে উঠেছে। আবার অনেক দেবতা সাধারণ মানুষ থেকেও জন্মেছেন। তাই আহার-বিহার, যানবাহন, বসন-ভূষণ প্রভৃতি ব্যাপারে অনেক দেবতা মানুষের কাছাকাছি। ইতিহাস থেকে আমরা দুই ধরনের দেবতাদের পাই–(১) আর্য দেবতা এবং (২) অনার্য দেবতা। বস্তুত পুরাণ থেকে আমরা প্রচুর দেবতার কাহিনি পাই। বিভিন্ন অলৌকিক কাণ্ডকারখানার মধ্য দিয়ে এই দেবদেবীদের প্রকাশ। এত দেবদেবতার প্রাবল্য একমাত্র সনাতন ধর্মেই দেখা মেলে। তবে গ্রিস ও রোমেও দেবদেবতাদের আধিক্য দেখা যায় যাঁদের দেখতে অবিকল মানুষের মতোই। সনাতনী দেবতারাও মানুষের রূপধারী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষই দেবতায় উন্নীত হয়েছে সনাতন ধর্মে। আজও মানুষ দেবতায় উন্নীত হয়–ভগবান রজনীশ, ভগবান চন্দ্রস্বামী, ভগবান সাঁইবাবা, ভগবান আশারাম, ভগবান সারথীবাবা ইত্যাদি!!! ভগবান মনু রাজাদেরও দেবতা বা দেবতারূপী বলেছেন। বস্তুত প্রাচীন যুগে রাজা বা শাসকরাই ছিলেন স্বঘোষিত ভগবান। এঁরা পুজো পান। ভক্তদের কাছে অমিতাভ বচ্চনও দেবতা। কলকাতাতেই অমিতাভ বচ্চনের মূর্তি গড়ে মন্দির বানিয়ে পুজো দেওয়া হয়। আবার গুজরাটে গান্ধি হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকেও মূর্তি গড়ে মন্দির বানিয়ে পুজো দেওয়া হয়। আসুন, কতিপয় স্বৰ্গবেশ্যাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।