কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে গণিকা ও গণিকাবৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষীয় এক চিত্র পাওয়া যায়। কী বলছে অর্থশাস্ত্র? অর্থশাস্ত্র বলছে দেহ-ব্যাবসা একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসা। পুরোপুরি ঘৃণিত বা গোপনীয় নয়। কৌটিল্যের সময় দেহ-ব্যাবসা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয় বলে জানা যায়, যে শিল্পের নাম ছিল বৈশিক কলা। বিশেষজ্ঞরা এই শিল্পের চর্চা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন। অর্থশাস্ত্রের ২৭ অধ্যায়ে গণিকাধ্যক্ষেরও উল্লেখ আছে।এখানে মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়কার বহু পুরুষগামী বারাঙ্গনা নারীদের হাল-হকিকৎ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। বলা হয়েছে, গণিকাধ্যক্ষের কাজ ছিল রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গণিকাদের সংগঠিত করা ও দেখভাল করা। গণিকাধ্যক্ষদের নিযুক্ত করতেন দেশের রাজা। গণিকাধ্যক্ষের আর-একটা প্রধান কাজ ছিল গণিকাদের আয় ও ব্যয়ের হিসাবপত্র রাখা। কোন্ গণিকার দিনে কত খরিদ্দার আসছে, খরিদ্দার-পিছু পারিশ্রমিক কত, উপরি পাওনা বা বকসিস কী ও কত, তার ব্যয়ই-বা কত ইত্যাদি সবকিছুই সে জাবেদা খাতায় নথিভুক্ত করত। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, কোনো গণিকা যদি তাঁর বৃত্তি ছেড়ে চলে যায়, অথবা কোনো কারণে মারা যায়, তাহলে তাঁর মেয়ে বা বোন তাঁর বৃত্তি গ্রহণ করবে। এই কারণেই তাঁর ত্যাজ্য সম্পত্তিরও সে মালিক হবে। অথবা সেই মৃতা কিংবা বৃত্তিত্যাজ্যা গণিকার মা তাঁর শূন্যস্থানে অন্য কোনো যোগ্য মেয়ে দ্বারা পূরণ করতে পারবে। যদি সেই মৃতা কিংবা বৃত্তিত্যাজ্যা গণিকার মেয়ে বা বোন বা মাতৃনিযুক্ত প্রতিগণিকা না-থাকে সেক্ষেত্রে তাঁর ত্যাজ্য ধন রাজকোশে জমা পড়বে।
কৌটিল্যের সময় গণিকাদের তিনভাগে ভাগ করা হত। যেমন–কনিষ্ঠ, মধ্যম ও উত্তম। কোন গুণাবলি বিবেচনা করে এই বিভাজন? বিভাজন হত কোন্ গণিকার কীরকম রূপ, কীরকম শারীরিক গঠন, কীরকম বয়স–সব মিলিয়ে তাঁর পুরুষকে আকর্ষণ ও মনোরঞ্জনের ক্ষমতা কতখানি, এসব দেখে তাঁকে উত্তম বা মধ্যম বা কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকার স্বীকৃতি দেওয়া হত। এই স্বীকৃতি বা সার্টিফিকেট দেওয়ার ক্ষমতা ছিল একমাত্র গণিকাধ্যক্ষের। গণিকার শ্রেণিভেদে বেতন তথা পারিশ্রমিকও ছিল ভিন্ন। যেমন–কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকার বেতন ছিল ১০০০ পণ, মধ্যম শ্রেণির গণিকার ২০০০ পণ এবং উত্তম শ্রেণির গণিকার বেতন ছিল। ৩০০০ পণ। সেসময় কোনো রাজকুলে নিযুক্ত গণিকারা যদি রাজসেবা থেকে কোনো কারণে মুক্তি চাইত, তাহলে সেই গণিকাদের রাজার কোষাগারে ২৪,০০০ পণ মুক্তিমূল্য দিতে হত। এমনকি গণিকাদের সন্তানদের দাসত্ব (গণিকার সন্তানদের ‘দাস’ হিসাবে গণ্য করা হত) থেকে মুক্তি পেতে ১২,০০০ পণ নিষ্ক্রয় দিতে হত। গণিকাদের কাছ থেকে শুধুই নিঙড়ে নিত যাঁরা ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন, তাঁদের বলি–নিঙড়ে যেমন নিত, তেমনি নিরাপত্তার দিকটিও কঠোরভাবে দেখা হত। যেমন–কোনো কামনারহিত গণিকাকে কোনো পুরুষ (খরিদ্দার) তাঁর ঘরে আবদ্ধ করে রাখে, অথবা কোনো গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখে এবং তাঁর শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি করে, দাঁত দিয়ে তাঁর বিশেষ বিশেষ স্থানে আঘাত করে তাঁর রূপ নষ্ট করে–তাহলে সেই পুরুষপুঙ্গবটিকে ২৪,০০০ পণ এবং প্রয়োজনে ৪৮,০০০ পণ পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। এখানেই শেষ নয়, যে গণিকা রাজার ছত্র, ভৃঙ্গার (জল ছিটানোর ছিদ্রযুক্ত পাত্রবিশেষ) বহনের কাজে নিযুক্ত হয়েছে, তাঁকে কোনোরকম মারধর করলে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত পুরুষটিকে ৭২,০০০ পণ অর্থদণ্ড করা হত।
শুধু খরিদ্দার-পুরুষদের জন্যেই শাস্তি বা অর্থদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল, তা কিন্তু নয়। শাস্তি বা অর্থদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল গণিকাদেরও। যেমন–(১) রাজার আজ্ঞা বা আদেশ সত্ত্বেও যদি কোনো গণিকা কোনো বিশেষ পুরুষের সঙ্গে যৌনক্রিয়ায় আপত্তি জানায়, তাহলে সেই সংশ্লিষ্ট গণিকাকে ১০০০ বার চাবুক মারা হবে। কখনো-কখনো ৫০০০ পণ পর্যন্ত গুণগারি দেওয়ার রীতি ছিল। (২) যদি কোনো গণিকা কোনো পুরুষের কাছ থেকে যৌনক্রিয়া করার শর্তে অগ্রিম অর্থ নিয়ে দুর্ব্যবহার করে, তাহলে সংশ্লিষ্ট গণিকা অগ্রিম অর্থের দ্বিগুণ পুরুষটিকে ফেরত দিতে হত। (৩) যদি কোনো গণিকা কোনো পুরুষের কাছ থেকে যৌনক্রিয়া করবে এই শর্তে রাত্রিযাপনের কোনোরূপ আগাম অর্থ নিয়েও যৌনমিলন না করে, তাহলে উক্ত পুরুষ গণিকাটিকে যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করেছিল তার আট গুণ অর্থ ফেরত দিতে হত। (৪) কোনো গণিকা যদি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে কোনো পুরুষকে হত্যা করে, তাহলে সেই মৃত পুরুষের জ্বলন্ত চিতায় খুনী গণিকাকেও পুড়িয়ে মারার বিধান ছিল।
০৩. স্বর্গের বেশ্যা যাঁহারা = স্বৰ্গবেশ্যা
ভারতের প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে–বিশেষ করে পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতে প্রচুর গণিকার উল্লেখ আছে। এইসব গণিকাদের মধ্যে বেশ কিছু গণিকা ‘স্বৰ্গবেশ্যা’ হিসাবেই পরিচিতা। সংস্কৃত শব্দ অপ্ (বাংলা অর্থ জল) থেকে এঁদের উৎপত্তি, তাই ‘অপ্সরা’ বলা হয়। ঋগবেদে অপ্সরা হলেন গন্ধর্বের স্ত্রী। অপ্সরা আবার দুই ধরনের–লৌকিক ও বৈদিক। অপ্সরাদের সৌন্দর্য ও যৌন আবেদনের কথা সবসময়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, অপ্সরারা মায়ারূপিনী, তাঁরা শরীর বা দেহ পরিবর্তন করতে পারত, অর্থাৎ চূড়ান্ত ছলনাময়ী ছিলেন। অথর্ব বেদে উল্লেখ আছে, এঁরা পাশা খেলতে খুব ভালোবাসত। পারদর্শিতার সঙ্গে খেলত। দেবাসুরের সমুদ্রমন্থনকালে এঁরা সমুদ্র থেকে উত্থিত হয়েছিলেন। কথিত আছে, দেবতা ও অসুরের সমুদ্রস্নানের সময় গণিকারা সমুদ্রের ভিতর থেকে অসংখ্য নারীর সঙ্গে উঠে আসেন। কিন্তু এইসব গণিকাদের কী দেবকুল কী অসুরকুল, কেউই গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। তাহলে সমুদ্র থেকে উত্থিত এই নারীদের ভবিষ্যৎ কী? অতএব গ্রহণ করা না-গেলেও পণ্য করে নিতে কোনো বাধা নেই। প্রভাবশালী মানুষদের যৌন-বিনোদনের জন্য বিতরণ করা যেতেই পারে। একই সঙ্গে শরীরী ফাঁদ পেতে ধনী ও প্রভাবশালী পুরুষদের বিভ্রান্ত করাই হবে এঁদের কাজ।