আগেই বলেছি, প্রাচীনকালে বহুভোগ্যা নারীদের নানাবিধ নামে উল্লেখ করা হত গণিকাবৃত্তির চরিত্রানুসারে। কেন সেটা কিছুটা আন্দাজ করা যেতেই পারে। যদিও মোটিভেশন একই, সকলেরই পেশা শরীর বিক্রি করা। এখনকার মত প্রাচীনকালেও গণিকা বলতে বোঝাত বহুভোগ্যা নারীকেই।গণ বা দলবদ্ধ হয়ে যে নারী যাপন করে, তিনিই গণিকা। অনুরূপ বেশ্যা বলতে বোঝায় যে নারী বেশ বা সাজসজ্জা দ্বারা পুরুষদের প্রলুব্ধ করে, তিনিই বেশ্যা। যে নারীদের পণের বাজি রেখে সম্ভোগ করা হত, সেই নারীরা পণ্যাঙ্গনা। যে নারীরা যুগপৎ মন্দিরের সেবাদাসী বা রাজা বা অমাত্য মর্যাদার রাজকর্মচারীদের ভোগ্যা হতেন, সেসব নারী বারস্ত্রী। পরিচারিকা বা ক্রীতদাসী বা রক্ষিতারা ভূজিয়া বলে পরিচিত। যে নারীর চরিত্রের পতন হয়েছে, তিনি পতিতা। অনুমান করা হয়, প্রধানত ব্রাহ্মসমাজের প্রচারের দৌলতেই ‘পতিতা’ শব্দটি বেশ্যার সুভাষণরূপে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। ১৮৯৪ সালে লেখা ‘বিচারক’ গল্পে রবীন্দ্রনাথও দেখছি ‘পতিতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সাহিত্যিক সমর সেন অবশ্য গণিকা শব্দটিই ব্যবহার করতেন। প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তাঁর পত্রিকায় বারবার ‘বেশ্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সাম্প্রতিককালে গণিকা বা বেশ্যা শব্দের বিকল্পে ‘যৌনকর্মী শব্দটিও শোনা যাচ্ছে। যৌনকর্মী শব্দটি যেন একটু বেশি নগ্ন হয়ে ধরা পড়েছে। যৌনকর্মী শব্দটি যেন তাঁদের জীবিকার ধরনকে আরও প্রকট করে তুলেছে। যোনিক্ষেত্রকেই প্রকট করে এই ‘যৌনকর্মী’ সম্ভাষণ। এই সম্ভাষণ তাঁরা স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন। কারণ তাঁদের শ্লোগান–“গতর খাঁটিয়ে খাই, শ্রমিকের অধিকার চাই”, “যৌনকর্মীর অধিকার, নারী-আন্দোলনের হাতিয়ার”, “মে দিবসের অঙ্গিকার, যৌনপেশার পূর্ণ অধিকার”।
০২. গণিকা এবং চৌষট্টি কলার সমন্বয়
বর্তমানে ধাত্রীবিদ্যা, উদ্যানবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা ইত্যাদি যেমন নানাপ্রকারের বিশেষ শিক্ষা আছে, ঠিক তেমনই সেকালে গণিকাবিদ্যাও ছিল এমনই এক শিক্ষণীয় বিষয় এবং সেই শিক্ষা এক্কেবারেই নিন্দনীয় ছিল না। এই বিষয়ে পৃথক বিদ্যালয়ও ছিল। রীতিমতো পরিচর্যা, প্রশিক্ষণ এবং অনুশীলন দ্বারা আগামীদিনের হবু গণিকাদের এইসব বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হতে হত। নৃত্য-গীত-বাদ্য ছাড়াও চিত্রকলা, জ্যোতিষশাস্ত্র, অভিনয়, রন্ধনবিদ্যা, ভাষাশিক্ষা, লিখন, মার্জিত ভাষায় কথা বলা, মালা গাঁথা ইত্যাদি এরকম ৬৪ কলায় পারদর্শী করে তোলা হত। ৬৪ কলায় সুশিক্ষিতা, রূপবতী গণিকারাই জনসমাজে বা রাজদরবারে বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত হতেন, সমাদর পেতেন।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সংজ্ঞা বলছে–গণিকাবৃত্তি হল স্বামী বা বন্ধুকে ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে নগদ অর্থ বা অন্য কিছুর বিনিময়ে বাছবিচারহীন ভাবে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া। এই পণ্য-দুনিয়ায় নারী-মানুষকে পণ্য করার বা পণ্য হওয়ার নেটওয়ার্কগুলির জোয়ার ক্রমবর্ধমান। আজকাল প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন দিয়েই যৌনকর্মী নিয়োগ ও কাস্টমারদের আহ্বান করা হচ্ছে। জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে নিরাপত্তা সহ অন্যান্য সুবিধাগুলি। যৌন বাণিজ্যে এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মুনাফা।
বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্রম’ গ্রন্থের ‘বৈশিকাখ্যং’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে–“রুচি হইতে যে পুরুষগ্রহণপ্রবৃত্তি, তা স্বাভাবিক আর ‘অর্থাৰ্জনার্থ’ যে প্রবৃত্তি তা কৃত্রিম।” বাৎস্যায়ন উল্লিখিত ‘অর্থাৰ্জনার্থ’ এই কৃত্রিম প্রবৃত্তিই নিন্দাহ। এই গণিকাবৃত্তিই বর্তমান বিশ্বে পয়লা নম্বরের বাণিজ্য-উপজীব্য। এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নেতা, মন্ত্রী, পুঁজিপতি, সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারী ও পুরুষ। অনেক দেশের রাজকোশ উপচে পড়ে গণিকাবৃত্তির রাজস্বতে। কৌটিল্য বিভিন্ন কারণে যৌন-ব্যাবসাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছিলেন। অবৈধ নারীসংসর্গ বোঝাতে তিনি ‘বাহবিহার’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এই ‘বাহবিহার’-এর পক্ষে বা বিপক্ষে স্পষ্ট করে কিছুই তিনি বলেননি। বাৎস্যায়ন বলেছেন–গণিকা অথবা বিধবাদের সঙ্গে দেহসম্ভোগ সমর্থন করা হয় না, আবার নিষিদ্ধও নয়।
সমাজবিদ লেকির মতে, গণিকাবৃত্তি হল সমাজের মাত্রাতিরিক্ত যৌনকামনা বেরিয়ে যাওয়ার একটি সেফটি ভালভ। লেকি মনে করেন, নিজে মূর্তিমতী পাপীষ্ঠা হলেও পরিণামে পুণ্যের অধিকারিণী এই মেয়েরা। এরা না থাকলে সংখ্যাহীন সুখী পরিবারের প্রশ্নাতীত পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যেত।” তাহলে কি গণিকারা যুগের পর যুগ সমাজের বিষ-ক্লেদ কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠী হয়ে থেকে যাবে? উঁহু, গণিকারা লেকির সঙ্গে একমত নয়। গণিকারা মনে করে না, তাঁরা সমাজের সেফটি-ভালভ। তাঁরা মনে করেন গণিকা ছাড়াও এই সমাজে প্রচুর নারী-পুরুষ আছেন, যাঁরা গোপনে যৌন-বিনোদন দিয়ে থাকেন। গণিকারা মনে করে না, সেই কারণে তাঁরা পুণ্যের অধিকারিণী। গণিকারা মনে করে না, তাঁরা না-থাকলে সংখ্যাহীন সুখী পরিবারের প্রশ্নাতীত পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যেত। গণিকালয়ে গিয়ে প্রচুর গণিকাদের সঙ্গে কথা বলে আমার অন্তত সেটাই মনে হয়েছে।
নারীবাদী কলামিস্ট তসলিমা নাসরিন একটি ব্লগে লিখেছেন–ক্রীতদাস প্রথার সঙ্গে পতিতাপ্রথার মূলত কোনো পার্থক্য নেই। ক্রীতদাসরা যখন তুলো ক্ষেতে চাষের কাজ করত, দাসমালিকরা প্রায়ই সশরীরে উপস্থিত হয়ে কিছু ক্রীতদাসীকে যৌনকর্মের জন্য তুলে নিয়ে যেত। ত্বক যাঁদের একটু কম কালো, সাধারণত তাঁদেরকেই পছন্দ করত। বাজারে নিয়ে যৌন-ব্যাবসার জন্য ভাড়া খাটাত, নয়তো সরাসরি পতিতালয়েই নগদ টাকায় ক্রীতদাসীদের বিক্রি করে দিত। আঠারো-উনিশ শতকে যে প্রথাটিকে বলা হত ক্রীতদাস প্রথা, বিংশ একবিংশ শতকে সেই প্রথাকে বলা হচ্ছে পতিতাপ্রথা।” লেখিকা অনেক পুরোনো ধারণা নিয়ে লিখেছেন বোঝাই যাচ্ছে তাঁর বক্তব্য পড়ে। সময় বদলে গেছে অনেক। সব গণিকাই ক্রীতদাস নয়। এখন বহু সাধারণ মহিলারা স্বেচ্ছায় এই গণিকাবৃত্তিকে জীবিকা হিসাবে বেছে নিচ্ছেন আর পাঁচটা জীবিকার মতোই এবং স্বাধীনভাবেই জীবিকা করেন। বর্তমানে কোনো মেয়ে বা মহিলাকে জোর করে কোনো গণিকালয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া এত কাজ নয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব পরবর্তী কোনো অধ্যায়ে।