‘বেশ্যা’ বা ‘গণিকা’ শব্দটির সঙ্গে ‘বৃত্তি’ শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এটাকে ব্যবসাও বলে, যেমন–দেহ-ব্যাবসা। যিনি অর্থ বা অন্য কোনো সম্পদের বিনিময়ে যৌনক্রিয়া করে, সে বিক্রেতা। আর সেই নারীর কাছে গিয়ে যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে যৌনসুখ পেতে যে বা যাঁরা অর্থ বা সম্পদ প্রদান করে, সে ক্রেতা। যিনি অর্থ বা সম্পদের বিনিময়ে ক্রেতার সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হন, সে যৌনসুখ পেল কি পেল না তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু যিনি অর্থ বা সম্পদ প্রদানের মাধ্যমে কোনো নারীর সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে আসেন, তাঁর যৌনসুখ অবশ্যই চাই। যৌনসুখ ছাড়া সে অর্থ প্রদান করবে না। ক্রেতাকে চরম যৌনসুখ দেওয়াটাই বিক্রেতার একমাত্র কর্তব্য। বিক্রেতারা চাইবে ক্রেতাদের নেশাগ্রস্ত কামগ্রস্ত করে তুলতে, যাতে ক্রেতারা বারবার বিক্রেতাদের কাছে আসে। কারণ শরীরই যে তাঁর পণ্য। ভালো মোড়কে সুস্বাদু করে পরিবেশন করতে হবে তাঁকে। শরীর বাজারে বিক্রেতার অধিকার অর্থ (Money), আর ক্রেতার অধিকার নারী-শরীর, যৌনসুখ।
গণিকাবৃত্তির শুরুটা ঠিক কবে থেকে? গণিকাবৃত্তির প্রসঙ্গ উঠলেই সবাই বলে ‘আদিম পেশা। “আদিম’ মানে কী? “আদিম জাতি’ বলতে আমরা সেই সময়ের মানুষের কথা বুঝি, যে সময় মানুষ পোশাকের ব্যবহার জানত না, উলঙ্গ থাকত। তাহলে গণিকাবৃত্তির শুরু কি সেইসময় থেকেই? গণিকাবৃত্তি ঠিক তখন থেকেই সৃষ্টি হয়েছে বলে আমি মনে করি না। সম্ভবত গণিকাবৃত্তি শুরু হয়েছে মানুষের পোশাকের ব্যাবহার শেখার অনেক পরে। নাগরিক সভ্যতায় বিনিময় প্রথার প্রচলন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরীর বিক্রির প্রথা চালু হতে পারে। ক্রয়-বিক্রয় ব্যবস্থা চালু হলে শরীর বিক্রিও চালু হয়। নাগরিক জীবন শুরু হল বহির্দেশীয় মানুষদের আগমনের মধ্য দিয়ে। এই বহির্দেশীয়রাই ভূমিকন্যাদের যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করত। ক্রীতদাসী হিসাবে কিনে নিত বা দখল করত এবং যথেষ্ট ভোগ করত। সমাজের ধনশালী, বলশালী এবং তথাকথিত উচ্চস্তরের মানুষগুলো ভূমিকন্যা বা অনার্যদের সঙ্গে শারীরিকভাবে লিপ্ত হলেও স্বীকৃতি দেয়নি। অনার্য-কন্যাদের শারীরিকভাবে ভোগ করা যায়, কিন্তু গ্রহণ করা যায় না। প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে আমরা আর্য-অনার্যদের সংঘর্ষের কাহিনি পাই। মনুসংহিতায় এইভাবেই পেয়ে যাই হাজারো জারজ সন্তানের সংবাদ। ধর্ষণ করলে অনার্যদের শাস্তির বিধান ছিল, কিন্তু আর্যদের নয়। আর্যদের তুলনায় অনার্যরা সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে দুর্বল ছিল। তাঁরা আর্যদের মতো তির-ধনুক, বর্শা, ছোঁড়া, কুঠার ব্যবহার করলেও শিরস্ত্রাণের ব্যবহার জানত না। তাই অনার্যদের বারবার পরাজয় ঘটত। সেই পরাজয়ের ফলে পুরুষ অনার্যদের হয় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, নচেৎ দাসত্ব বা বশ্যতা মেনে নিতে হয়েছে। আর অনার্য নারীরা দখলীকৃত ভোগের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগ জুড়ে অঞ্চলে অঞ্চলে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকত ভূমিদখলের জন্য। যুদ্ধে যুদ্ধে বিধ্বস্ত পুরুষরা ক্রীতদাসে পরিণত হত, আর নারীরা যৌনদাসীতে পরিণত হত। এঁদেরই একটা বড়ো অংশ যৌনজীবিকার পথ বেছে নিয়েছিল। সেইসব নারীরা বুঝে নিয়েছিল, নারী-শরীরের প্রতি পুরুষদের তীব্র লালসা। তাঁদের এই লালসা মোচন কেন মাগনায় হবে? সমাজেরই ধণিক শ্রেণি সেইসব নারীদের মূল্য নির্ধারণ করে দিল। তৈরি করা হল সেইসব নারীদের নির্দিষ্ট আস্তানা। সেই সময় গণিকাগমনের অধিকার ছিল শুধুমাত্র ধনীদেরই। সমাজে যখন রাজতান্ত্রিকতার উন্মেষ ঘটেছিল, তখন এইসব নারীদের শরীরী-ছলনায় শত্রু নিধন এবং গুপ্তচর বৃত্তির কাজে লাগানো হত। আজও এই ব্যবস্থা চালু আছে। স্বার্থসিদ্ধির জন্য নারীকে ‘ভেট’ দেওয়ার রীতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। আজকাল তো শুনছি নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে টিকিট পেতেও ‘মেয়েমানুষ’ ভেট দিতে হয়! একথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই বিশিষ্ট অতিথি, অমাত্য এবং অপরাপর উচ্চধনীবর্গদের আবদার মেটাতে নারী-শরীর উপঢৌকন দেওয়ার রীতি আজও অব্যাহত আছে। ব্রিটিশ যুগেও এই বৃত্তি রাষ্ট্রের আনুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট হত। কলামিস্ট তসলিমা নাসরিন এই পেশা সম্বন্ধে এক লেখায় বলেছেন–“এটাকে পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশা বলে লোককে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা হয় বটে, আসলে কিন্তু প্রাচীনতম পেশা নয়, এটা বরং মেয়েদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর প্রাচীনতম নির্যাতন।”
প্রচলিত অর্থে বেশ্যা বা পতিতা বা গণিকা বলতে আমরা যেমনটাই বুঝি না-কেন, প্রাচীন ভারতে এইসব রমণীরা কিন্তু তেমনটা ছিলেন না। দেশের (দেশ বলতে সমগ্র ভারত বুঝবেন না। সে সময় দেশ বলতে সংশ্লিষ্ট রাজার শাসিত এক টুকরো ভূখণ্ড বা অঞ্চলকে বোঝাত।) রাজা স্বয়ং গণিকাদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বার্ষিক ১০০০ পণ বেতন দিয়ে রাজা তাঁর প্রাসাদে গণিকাদের নিয়োগ করতেন। গণিকাদের আয়ের একটা অংশ কর হিসাবে রাজাদের কোষাগারে সংগৃহীত হত। প্রাচীন ভারতে গণিকারা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হত। তদুপরি গণিকাদের ঘরে যেমন জ্ঞানী-গুণীদের আলোচনা সভা বসত, আবার এমন জ্ঞানী-গুণীদের এবং শিক্ষাব্রতীদের গণিকালয় ছিল প্রধান আখড়া। প্রাচীনকালে গণিকালয়ে যাতায়াত খুব একটা গোপনীয় বা লজ্জাকর বিষয় ছিল না। সে যুগের নাগরিকরা বসন-ভূষণে সজ্জিত হয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে দিনে-দুপুরেই গণিকালয়ে যাতায়াত করতে পারতেন।