এখন প্রশ্ন হল এই বাবু সমাজের সৃষ্টি এবং বাবু কালচারের উত্থান হল কেন? বাবুরা আকাশ থেকে পড়ল নাকি! না, হিন্দু বাঙালির অধঃপতন হল দীর্ঘ আটশো বছরের মুসলিম শাসনে নয়, অধঃপতন হল খ্রিস্টান শাসনের শুরুতেই। ১৭৫৭ সালে সিরাজের বিরুদ্ধে পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের মধ্য দিয়ে ইংরেজ ব্রিটিশরা বাংলার শাসন ক্ষমতা লাভ করে। খ্রিস্টান ইংরেজরা ক্ষমতা লাভ করেই তাঁদের প্রণীত শাসনব্যবস্থা ও ভূমিব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এর ফলে বাংলার গ্রাম্যসমাজের প্রচলিত কাঠামোটা ভেঙে পড়ল। ব্রিটিশরা বাংলার ক্ষমতা লাভের পর ক্রমাগত করের চাপে, দুর্ভিক্ষে গ্রামের দরিদ্র মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। অস্তিত্ব রক্ষায় তাঁরা একে একে গ্রাম ছেড়ে শহর কলকাতার আসতে শুরু করে দিল। কলকাতা শহর হয়ে উঠল এই সব ছিন্নমূল মানুষের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। খ্রিস্টান ইংরেজদের সৃষ্ট এইসব নিম্নবর্গের ছিন্নমূল এবং উচ্চবর্গের শোষকরা একসঙ্গে কলকাতা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করতে থাকল। সতেরো শতকের শেষদিকে ইংরেজদের দ্বারা কলকাতা নগরী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সতেরো শতকের শেষার্ধে খ্রিস্টান (ইংরেজ) শাসন স্থাপিত হওয়ায় রাতারাতি কলকাতার গুরুত্ব রাজধানী মুর্শিদাবাদকে ছাড়িয়ে গেল। গ্রাম থেকে কলকাতার নতুন নতুন মানুষের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন রঙ্গও জমে উঠছিল। বিনয় ঘোষ লিখেছেন—কলকাতা শহরে প্রথমে যে ইংরেজরা এসেছিল, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল অস্তগামী মধ্যযুগের উচ্ছিষ্টতুল্য প্রতিনিধি। নতুন শিক্ষা বা নতুন সভ্যতার অগ্রদূত তাঁরা ছিল না। তাঁরা দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হত, হিন্দুদের পুজোপার্বণে অংশগ্রহণ করত, তৎসহ হিন্দুদের মতোই তুকতাকে বিশ্বাস করত। উচ্ছিষ্টতুল্য প্রতিনিধিদের পিছন পিছন চুল পরিচর্যাকর, বাজিকর ইংরেজরাও এসেছিল। বাংলার জমিদারদের মতো খানাপিনা ও জীবনযাপন করাটাকেই তখন ইংরেজরা আভিজাত্য মনে করত।
বঙ্গদেশে খ্রিস্টান শাসন চালু হলে ছিন্নমূল মানুষের পাশাপাশি ইংরেজদের স্পর্শ পেয়ে প্রতাপশালী ‘বাবু’ নামে এক নতুন শ্রেণির উদ্ভব হল। প্রায় ২০০ বছর আগে থেকে শিক্ষিত, ধনী পুরুষদের নামের আগে ‘বাবু’ শব্দের ব্যবহার শুরু হয়। অবশ্য তখনও ‘বাবু’ শব্দের ব্যবহার মোটামুটি ধনী, শিক্ষিতদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। বাবু’ পদ পূর্বে নিজে থেকে কারও ব্যবহার করার অধিকার ছিল না। এটা ছিল মুসলিম নবাব প্রদত্ত উপাধি। সম্মানিত ধনাঢ্য ব্যক্তি ছাড়া নবাবেরা অন্য কাউকে এই উপাধি দিতেন না। কিন্তু ইংরেজ শাসনের অবসানের পর সকলেই যত্রতত্র ‘বাবু’ হয়ে গেলেন।
এ সময়ে পুরোনো ধনী সম্প্রদায় বিদায় নিলেন। আবির্ভাব হল এক নব্য ধনী সম্প্রদায়ের। এই নব্য ধনী সম্প্রদায়ই বাবু’। এঁরাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং কোম্পানির সাঙ্গোপাঙ্গদের আশীর্বাদে অল্পকালের মধ্যেই বেশ ধনী হয়ে ওঠেন। রাজা, মহারাজা উপাধি নিয়ে জুড়িগাড়ি, প্রাসাদোপম বাড়ি, মোসাহেব আর দাসদাসীদের নিয়ে কলকাতার জাঁকিয়ে বসেন। এর পাশাপাশি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ চালু হওয়ার পর বাংলায় নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয়। এঁদেরই একটি অংশ প্রজাদের যারপরনাই শোষণ করে নিঙড়ে নিয়ে প্রভূত বিত্তশালী হয়ে উঠছিলেন। হঠাৎ গজিয়ে ওঠা এই ধনিক এবং নতুন জমিদাররাই কলকাতার বসবাস করে ‘বাবু’ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে ওঠেন। গণিকাবিলাস সহ বিভিন্ন কিসিমের আমোদপ্রমোদই এই বাবুকুলের একমাত্র আরাধ্য ছিল। নানারকম পুজো উপলক্ষে বা কোনোরকম উপলক্ষ ছাড়াই নাচ, গান, যাত্রা, থিয়েটার, বুলবুলির লড়াই, হাফ-আখড়াই, কবিগানের আয়োজনে এই বাবুরা থাকত সদাব্যস্ত। কার আয়োজন সব থেকে জমকালো হল, তা নিয়ে রীতিমতো অলিখিত প্রতিযোগিতা চলত। জলের মতো অর্থ ব্যয় হত। ইংরেজরা নিমন্ত্রিত হত। ইংরেজরা বাবুদের তারিফ করত। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ধনী ও জমিদারদের উপাধি দিত। এই উপাধির লোভে নব্য ধনীরা উৎসবের আয়োজনে বহগুণ বৃদ্ধি করত। এ বলে আমায় দেখ, ও আমায় দেখ। বাবু’ নামের রম্যরচনায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন–“যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন, এবং পাঁঠার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু।”
ইংরেজরা ক্ষমতায় এসে প্রথম নিজেরাই জমিদার হল। তারপর নতুন একশ্রেণির জমিদার-তালুকদার সৃষ্টি করল এবং নিজেদের লুণ্ঠনের বকযন্ত্র চালু রাখার জন্য দালাল, গোমস্তা, মুৎসুদ্দি, দেওয়ান নিয়ে একপ্রকার এদেশি ‘জেন্টু’ গড়ে তুলল। জমিদার ও জেন্টু উভয় শ্রেণির হাতে যথেষ্ট পয়সা জমল, কিন্তু পয়সার কোনো সদগতি হল না। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের মতো এই মজুত পয়সা শিল্পবাণিজ্যের ক্ষেত্রে অবাধে নিয়োগ করা গেল না। সুতরাং হক্কের ধন ফক্কে উড়তে লাগল। বাঁদরের বিয়েতে ও বাপের শ্রাদ্ধে লাখ লাখ টাকা খরচ করে, বাইজি নাচে, টপ্পা খেউড়ে, বুলবুলির আর মেড়ার লড়াইয়ে, ইংরেজ প্রভুদের উপঢৌকন দিয়ে, উৎসব-পার্বণে বিদেশি প্রভুদের ও দেশি দরিদ্র নারায়ণের সেবা করে।