সর্বোপরি শরৎবাবুর ‘পতিতা’ চরিত্রগুলি পতিতা হিসাবে ততটা পরিস্ফুট হয়নি, যতটা হয়েছে নারীচরিত্র। সেখানে কোনো নারী সামাজিক অর্থে পতিতা না অ-পতিতা, তা সাহিত্যিকের কাছে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর বিষয়। জীবননাট্যলীলায় তাঁর ভূমিকাটি সাহিত্যিক সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে অঙ্কিত হয়েছে কি না, সেটাই সাহিত্যসমাজে বিবেচ্য বিষয়। শরত্যাবু অবিবাহিত বা বিবাহিত এই প্রশ্নের সমাধান না করেও বলা যায় যে, নারীর প্রতি তাঁর সহজ আকর্ষণ প্রবলতম। নারী-মন সন্ধানে শরত্যাবু নারীজগতের বহু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। শরৎচন্দ্র ব্ৰহ্মপ্রবাসকালে ‘বেঙ্গল সোসিয়াল ক্লাব’-এ স্বরচিত ‘নারীর ইতিহাস’ পাঠ করেন এবং সাতশত পতিতা নারীর জীবনকাহিনি সংবলিত একটি পুস্তক প্রণয়ন করেছিলেন। ঘটনার বিপর্যয়ে শরৎচন্দ্র প্রথম যৌবনে সমাজচ্যুত হয়েছিলেন। সেই অবসরে নারীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় সাধারণত সমাজের বাইরে।
সেসময়ের সাহিত্যিকদের সাহিত্যে যেমন গণিকারা স্থান পেয়েছিল, ঠিক তেমনইভাবে সাহিত্যিকদের জীবনেও গণিকারা স্থান পেয়েছিল। সুরাপান, গণিকাসক্তি ও রক্ষিতা-পোষণ সেকালে এক ধরনের সামাজিক স্বীকৃতি লাভই করেছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তো গণিকাঁচর্চা গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক হিসাবেও বিবেচিত হত। আঠারো-উনিশ শতকে কলকাতার নাগরিক জীবন এমনকি মফসসল শহরেও গণিকাঁচর্চা জীবনযাত্রার অনিবার্য প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ হয়ে ওঠে। ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায় নিকির নাচ দেখেই সন্তুষ্ট ছিলেন না, বাঁধা রক্ষিতাও ছিল তাঁর। এই যবনী রক্ষিতার গর্ভে একটি পুত্রসন্তানও ‘উপহার’ দিয়েছিলেন। গণিকা সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। মরমি কবি হাসন রাজা তো হর হামেশাই গণিকা-দর্শনে গণিকালয়ে যেতেন। কবি নজরুল ইসলামও বাদ যাননি, তিনি গণিকা কাননবালার ঘরে নিয়মিতই যেতেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে গণিকা ও বৈধতাও প্রশ্নহীন নয়। সাহিত্যিক জগদীশ গুপ্তও রক্ষিতা পুষতেন। রাজনারায়ণ বসু লিখছেন–“এক্ষণকার লো পানাসক্ত ও পূৰ্ব্বাপেক্ষা বেশ্যাসক্ত। যেমন–পানদোষ বৃদ্ধি পাইতেছে, তেমনি বেশ্যাগমনও বৃদ্ধি হইতেছে। সে কালে লোকে প্রকাশ্যরূপে বেশ্যা রাখিত। বেশ্যা রাখা বাবুগিরির অঙ্গ বলিয়া বিবেচিত হইত, এক্ষণে তাহা প্রচ্ছন্নভাবে ধারণ করিয়াছে, কিন্তু সেই প্রচ্ছন্নভাবে তাহা বিলক্ষণ বৃদ্ধি পাইতেছে। বেশ্যাগমন বৃদ্ধি পাইতেছে, তাহার প্রমাণ বেশ্যাসংখ্যার বৃদ্ধি। পূৰ্ব্বে গ্রামের প্রান্তে দুই এক ঘর দৃষ্ট হইত; এক্ষণে পল্লিগ্রাম বেশ্যার সংখ্যা বিলক্ষণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। এমনকি স্কুলের বালকদিগের মধ্যেও এই পাপ প্রবলাকারে ধারণ করিয়াছে।”
০৯. বাবুবিলাসীদের গণিকাযাপন
‘বাবু কালচার’ নিয়ে আলোচনা হবে আর গণিকা আসবে না, তা কখনো সম্ভব? তা না-হলে যে সানি লিওনকে ‘ভার্জিন’ বলার সামিল হবে! বাবু, অথচ তিনি গণিকা সঙ্গ লাভ করেননি বা সঙ্গ লাভের জন্য উতলা হননি, এমন ‘বাবু’ বিরল। পরে আসছি সে কথায়। ‘নববাবুবিলাস’ ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত একটি ব্যঙ্গকৌতুক নকশা। প্রকাশকাল ১৮২৫। প্রমথনাথ শর্মন ছদ্মনামে প্রকাশিত। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও আশুতোষ ভট্টাচার্য এটিকে প্রথম বাংলা উপন্যাস’-এর মর্যাদা দিলেও অধিকাংশ সমালোচক এটির উল্লেখ করেছেন একটি কৌতুক নকশা হিসাবেই পরে নববিবিবিলাস’ নামে ভবানীচরণ এই গ্রন্থের একটি দ্বিতীয় পর্বও রচনা করেন। ‘নববাবুবিলাস’ গ্রন্থের মূল উপজীব্য বিষয় উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতার উচ্চবিত্ত সমাজের বহুসমালোচিত বাবু’ সংস্কৃতির অন্ধকার দিক। বলা যায়, এটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত প্রথম বাংলা কথাসাহিত্য। গ্রন্থটি চারটি খণ্ডে বিভক্ত–অঙ্কুর খণ্ড, পল্লব খণ্ড, কুসুম খণ্ড ও ফল খণ্ড। অঙ্কুর খণ্ড, অর্থাৎ বাবুরূপ বৃক্ষের অঙ্কুর অধ্যায়ে সেকালের উদ্ধৃঙ্খল যুবসমাজের ও ঔপনিবেশিক শিক্ষাপ্রণালীর প্রতি কৌতুক কটাক্ষ নিক্ষেপ করা হয়েছে। পল্লবখণ্ড, অর্থাৎ বাবুরূপ বৃক্ষের পল্লব অধ্যায়ে নব্যবাবুদের কুসঙ্গে পড়ার চিত্র বর্ণিত হয়েছে। কুসুমখণ্ড, এই খণ্ডে বাবুদের অধঃপতনের চরম পর্যায়। বাবুর ‘নব্যবাবু’ নামধারণ, গণিকাগমন ও বিলাসব্যসন এবং ফল খণ্ড অর্থাৎ বাবুরূপ বৃক্ষের ফল অধ্যায়ে বাবুপত্নীর বিরহ, খেদোক্তি ও অবশেষে করুণ পরিণতি বর্ণিত হয়েছে।
ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে—‘বাবুর উপাখ্যান’ বা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যঙ্গ আখ্যানগুলি অর্ধশিক্ষিত ধনী সন্তানদের কুৎসিত আমোদপ্রমোদের কথা সাধুভাষায় বলা হলেও উদ্দেশ্যটি তত সাধু ছিল না। বাইরের দিক থেকে এসব নকশায় রঙ্গকৌতুক, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও গল্পের আমেজ থাকলেও ভিতরে ছিল ‘পর্নো’ (porno), কেচ্ছা-কেলেংকারি। সমাজের কুরীতি দেখিয়ে সভ্যভব্য মানসিকতা সৃষ্টি, এই জন্যই ভবানীচরণ ও অন্যান্য নকশাকারেরা কলম ধরেছিলেন। কিন্তু রোগের চেয়ে ঔষধই হয়েছিল প্রাণঘাতী। যাই হোক, উনিশ শতকের কলকাতার বাবু কালচারের একটি উলঙ্গ রূপ চিত্রিত করে বাংলা সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাসে এই গ্রন্থটি এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে।