গণিকা বা পতিতা বা বেশ্যা অথবা যৌনকর্মী যাই-ই বলি না-কেন–সম্মান বা মর্যাদায় কোনো আকাশপাতাল প্রভেদ দেখি না। যৌনকর্মী’ বলার মধ্যে একটা ‘কর্মী’ স্বীকৃতি পায় বটে, আসলে পেশার পরিচয়ে সব শব্দই সমান। তবে আমি ‘গণিকাপরিচয় দিয়েই লেখা এগিয়ে নিয়ে গেছি। তবে কোথাও কোথাও অবশ্য ‘যৌনকর্মী’ সম্বোধনও করেছি প্রয়োজনে।
যৌনকর্মী বা গণিকাদের বিষয় করে ইংরেজি ভাষায় প্রচুর বইপত্র বাজারে আছে। কিন্তু গণিকাদের নিয়ে বাংলা ভাষায় লেখা বইপত্র অতি বিরল। থাকলেও তা পূর্ণাঙ্গ নয়। সেই তাগিদ থেকেই ‘গণিকা-দর্শন’ বাংলা ভাষায় লেখা এমনই একটি বই। পাঠকের প্রাপ্তিও অনেক বেশি হবে। এটা পাঠকরা এই আশা করতেই পারেন। সেই আশা পূরণের চেষ্টা করেছি, যতটা সম্ভব। জ্ঞানপিপাসু এবং কৌতূহলী পাঠকদের কথা মাথায় রেখে প্রচুর তথ্য সংযোজন করা হয়েছে। বিভিন্ন সংযোজনের মাধ্যমে গ্রন্থের বিষয়কে আপ টু ডেট করা হয়েছে। আশা করি এ গ্রন্থটি সর্বস্তরে আগ্রহ ও গুরুত্ব সহকারে পঠিত হবে।
পরিশেষে বলি, দীর্ঘ ১৪ বছরের গবেষণার ফল এই গ্রন্থটি। গ্রন্থ হয়ে ওঠার পিছনে যে অসংখ্য মানুষের সাহায্যের হাত আমার হাত ছুঁয়েছে, যাঁরা আমার সুপ্ত স্বপ্নকে সাকার করেছে নানাভাবে তাঁদের ঋণ কখনোই শোধ যাবে না। কৃতজ্ঞতা রইল অফুরাণ। বিভিন্ন স্তরের সেইসব যৌনকর্মীদের কাছেও আমি ঋণী, যাঁরা তাঁদের মূল্যবান সময় থেকে আমাকে সময় দিয়েছেন। তাঁদের জন্য কৃতজ্ঞতা অফুরাণ। শেষ পর্যন্ত পাঠক পরিতৃপ্ত ও সমৃদ্ধ হলে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে। আমার এ লেখা পাঠকের চিন্তনে সামান্য আঁচড়ও যদি কাটতে পারে, তবেই আমি নিজেকে সার্থক বলে মনে করব।
০১. বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ
‘পবিত্র’ গণিকাবৃত্তি প্রাচীন প্রাচ্য দেশে বেশি মাত্রায় হত। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ানরা ধর্মীয় যৌনতার প্রতিটি সুযোগই কাজে লাগাত। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডটাস বলেন—ব্যাবলীয়ানদের সবচেয়ে খারাপ রীতি ছিল জীবনে একবার হলেও প্রত্যেক মহিলাকে বাধ্য করা হত আফ্রিদিতি মন্দিরে যেতে, যেখানে তাঁকে একজন অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে হত। যেসব মহিলারা ধনী ও বংশমর্যাদায় গর্বিত ছিলেন, তাঁরা মিলিত হতে চাইতেন না। তাঁদের তখন দড়ি দিয়ে বেঁধে আনা হত মন্দিরে। প্রচুর অনুগামী লোক ভিড় করত তখন। এভাবে বিপুল সংখ্যক মহিলাদের আনা হত। যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়ার আগে মহিলারা কখনোই বাড়িতে ফিরে যেতে পারতেন না। অপরিচিত কোনো লোককে অবশ্যই টাকা দিতে হত বন্দিনী মহিলার আঁচলে এবং তাঁকে আহবান করতে হত মাইলিত্তা দেবীর নামে। তাঁদের মন্দিরের বাইরে মিলিত হতে হত। টাকার পরিমাণ যাই হোক না-কেন, তা নিতে অস্বীকার করা পাপ মনে করা হত। এইভাবে সুন্দরী মহিলারা মর্যাদা খুঁইয়ে মুক্তি পেত অল্প দিনে। অসুন্দরীদের থাকতে হত দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত কোনো লোকের সঙ্গে যৌনমিলন হওয়া পর্যন্ত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৪ বছর আগে গ্রিসে জেনোফন নামের একজন অলিম্পিক বিজয়ী দেবীর মন্দিরে ১০০ জনের মতো তরুণীকে উপহার হিসেবে দান করে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ। করিন্থ নামক ওই শহরে দেবী আফ্রিদিতির মন্দির ছিল। রোমান যুগে ওই মন্দিরে প্রায় হাজারের উপর দেবদাসী ছিল।
“বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ”–বেশ্যাগণের পুরুষগ্রহণ প্রবৃত্তি বা পুরুষকে প্রলুব্ধ করা এবং অর্থাৰ্জন সেই সৃষ্টিকাল থেকে চলে আসছে। এহেন ব্যাখ্যাই বাৎস্যায়ন তাঁর ‘কামসূত্র’ গ্রন্থের চতুর্থ অধিকরণে অবহিত করেছেন। বাৎস্যায়ন তাঁর গ্রন্থের চতুর্থ অধিকরণটি বৈশিক বা বেশ্যাদের জন্যই বেশ গুরুত্ব সহকারে বরাদ্দ রেখেছেন। প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে ‘বেশ্যা’ বিশেষণের বেশ কিছু সমতুল প্রতিশব্দ পাওয়া যায় পেশার ধরন হিসাবে। যেমন–পতিতা, বারাঙ্গনা, দেহপসারিণী, দেহপোজীবিনী, রূপোপজীবিনী, রক্ষিতা, খানকি, ছিনাল, বারবনিতা, উপপত্নী, জারিণী, সাধারণী, মহানগ্নী, পুংলী, পুংশ্চল, অতীত্বরী, বিজর্জরা, অসোঙ, অতিষ্কদ্বয়ী, গণিকা, গণেরুকা, নটী, হট্টবিলাসিনী এবং হাল আমলের ‘যৌনকর্মী। আমি যেহেতু আমার গ্রন্থের নাম ‘গণিকা দর্শন’ রেখেছি, তাই গোটা গ্রন্থে যথাসম্ভব ‘গণিকা’ প্রতিশব্দটিই ব্যবহার করব। তবে ইংরেজিতে যেমন Domimonde, Public Women, Hatairai, Aspasia, Phrynes ইত্যাদি শব্দের মতো আদিম ও প্রাগৈতিহাসিক বিশেষণ আছে, ঠিক তেমনি আধুনিক বিশেষণগুলি হল–Prostitute, Call Girl, Escort Girl, Pornstar ইত্যাদি।
মোদ্দা কথা, অর্থ বা পার্থিব সম্পদের বিনিময়ে যে নারীরা একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন বা যৌনসুখ শরীর উলঙ্গ করে প্রদর্শনকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছে, তাঁকেই গণিকা (Prostitute) বলে। বলা হয়, এটি পৃথিবীর আদিম পেশা। বিশেষ এই পেশা মেয়েদের যে বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে, সেগুলির সবই পেশার রকমফেরের উপর ভিত্তি করে। সবকটি বিশেষণের ব্যাখ্যা দিয়ে কলেবর বৃদ্ধি করব না। তবে আমাদের কাছে ‘বেশ্যা’ বিশেষণ বা পরিচয়টি বেশি পরিচিত। ভিন্টারনিৎসের মতে, ঋগবেদের প্রথম মণ্ডলের ১২৬ তম সূক্তের অন্তর্গত পঞ্চম ঋকে যে ‘বিশ্যা’ শব্দটি আছে, তা থেকেই ‘বেশ্যা’ শব্দটির উৎপত্তি। ঋকটি এরকম–“সুবন্ধবো যে বিশ্যা ইব ব্রা অনস্বন্তঃ শ্রব ঐযন্ত পূজা”। ভিন্টারনিৎস ঠিক না বেঠিক, সে ব্যাপারে এই ভারতের কোনো বেদবেত্তা আপত্তি করেছেন বলে শুনিনি।