শরৎসাহিত্যে অবহেলিত, বঞ্চিত, দুর্ভাগা নারীরাই প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠেছে। মানবিক রূপ নিয়ে এসেছে পতিতা তথা গণিকাদের কথাও। শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের সময়ে পতিতা শব্দের অর্থও গেল বদলে। গণিকা বা পতিতা মানে কেবল দেহোপজীবিনীই নয়, দেহ ছাপিয়ে এই অপবাদ আরও বিস্তার করেছে নারীর জীবনে। শরৎসাহিত্যে গণিকারা হল ‘দেবদাস’-এর চন্দ্রমুখী, শ্রীকান্ত’-এর পিয়ারি বাইজি, ‘আঁধারে আলো’-র বিজলী।
শরবাবুর সময়ে ‘পতিতা’ শব্দটি সামাজিক অর্থে গৃহীত হয়ে গেছে। পতিতা হিন্দুসমাজের দৃষ্টিতে ‘সতী’ শব্দের বিপরীত অর্থবোধক। ভারতীয় নারীদের বিবাহমন্ত্রনির্দিষ্ট স্বামীই একমাত্র গ্রহণীয় পুরুষ। সুতরাং হিন্দুসমাজে নারী দেহ এবং মনে একজন মাত্র পুরুষকে সাধনা এবং কামনা করতে পারবে। অন্যথা সে পতিতা। সমাজের বিচারে স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষকে মনে মনে কল্পনা করলেও সে নারী পতিতা। পতিব্রতা নারীর মর্যাদা নষ্ট হয়। নারী পতিতা হয়। হিন্দুশাস্ত্রে শুধুমাত্র মনে মনে কোনো পরপুরুষকে কামনা করলেও সেই নারী পতিত হয়। রেণুকার কাহিনি সংক্ষেপে দু-চার লাইনে স্মরণ করতে পারি। ব্রাহ্মণ জমদগ্নির স্ত্রী ক্ষত্রিয় রেণুকা। পরশুরাম হলেন তাঁদের পুত্রসন্তান। যিনি স্বাভাবিকভাবেই ব্ৰহ্মক্ষত্রিয়। অন্য চারপুত্ররা হলেন—বসু, বিশ্ববসু, বৃহদ্ভানু ও বৃহৎকশ্ব। যাই হোক, যেটা বলতে চাই সেটা হল–একবার চিত্ররথ নামক এক রাজাকে সস্ত্রীক জলবিহার করতে দেখে পরশুরামের মা রেণুকা কামার্তা হয়ে পড়েন। ধ্যানযোগে এ দৃশ্য দর্শন করে পরশুরামের পিতা জমদগ্নি তাঁর পুত্রদের মাতৃহত্যার আদেশ দেন। বসু, বিশ্ববসু, বৃহদ্ভানু ও বৃহৎকৰ্থ–এই চারপুত্র পিতার আদেশ অগ্রাহ্য করলেও পরশুরাম তাঁর কুঠার দিয়ে মায়ে মাথা-ধড় আলাদা করে দেন। বাকি কাহিনি এখানে বলার প্রয়োজন নেই।
শরৎসাহিত্যে প্রথম পরিচিত গণিকা বা পতিতা হল দেবদাস গ্রন্থের চন্দ্রমুখী। যেভাবে দেবদাসের সঙ্গে চন্দ্রমুখীর প্রথম পরিচয় পর্ব বর্ণিত হয়েছে, তাতে মনে হয় শৌণ্ডিকালয় বা শুড়িখানায় প্রথম পরিচয়ের দ্বিধা, সংকোচ, সংস্কারের আঘাত ও বিবেকের তাড়না যেন লেখকজীবনের বাস্তব ঘটনা। শুধুমাত্র মানসচক্ষে বিচারবুদ্ধি দিয়ে চন্দ্রমুখীর চরিত্রায়ণ এমন জীবন্তভাবে মোটেই সম্ভব নয়। চন্দ্রমুখী শুধুমাত্র শরীরী টানেই দেবদাসকে মুগ্ধ করেনি, ব্যক্তিগত আকর্ষণ দেবদাসের জীবনে কম প্রভাব বিস্তার করেনি। চন্দ্রমুখীর সহৃদয় ব্যবহার, সমাহিত আলাপ, দেবদাসকে সুপথে নিয়ে যাওয়ার আন্তরিক চেষ্টা করেছিল। স্নেহবুভুক্ষু দেবদাসের মনে সবচেয়ে বেশি মোহ বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। দেবদাস যেমন চন্দ্রমুখীর শরীরকে কেন্দ্র করে পিচ্ছিল পথে নেমেছিল, তেমনই প্রেমেও পড়েছিল। যে চন্দ্রমুখী একদিন শুধুমাত্র শরীরের আবেদনে রূপের পসরা সাজিয়ে সমাজের বাইরে দাঁড়িয়েছিল, সেই নারী একসময় দেবদাসকে কেন্দ্র করে একনিষ্ঠ প্রেমের সন্ধানে সমস্ত বিলাস, বিভ্রম ও ঐশ্বর্যকে পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিল। হিন্দুঘরের বিবাহিতা নারী যেমন বিবাহের পর স্বামীর চরণে নিজেকে নিঃস্ব করে বিলিয়ে দেয়, ঠিক তেমনই চন্দ্রমুখীও দেবদাসকে দেবতার আসনে বসিয়ে নিজেকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল। তবুও চন্দ্রমুখীর মলিনত্ব ঘুচল না। কারণ সমাজ তাঁর দুঃখাভিশপ্ত কপালে কলঙ্কতিলক পরিয়ে দিয়েছে। সে তো আর কেউ নয়–গণিকা, বারাঙ্গনা, পতিতা।
শ্রীকান্ত গ্রন্থে এক বাইজিকে পাই, যার নাম পিয়ারী। দেবদাসে চন্দ্রমুখীর ঘরে ঢোকার সময় লেখকের যে জড়তা দেখেছি, শ্রীকান্তে এসে সেই জড়তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে সে। মজঃফরপুরে বন্ধু মহাদেবের ঘরে পিয়ারী বাইজির সামনে শ্রীকান্ত বেশ অপ্রকৃতস্থ। মাতলামি, মাতালের অর্থহীন প্রলাপ, লাম্পট্যের অভদ্র ইঙ্গিত এবং নর্তকীর বিলোল আভাস শ্রীকান্তকে আর বিভ্রান্ত করে না। পিয়ারি বাইজি সঙ্গে পরিচয়ও প্রগাঢ় হল। পিয়ারী বাইজি ওরফে রাজলক্ষ্মী ছিল শ্রীকান্তের বাল্যকালের খেলার সাথী, আজ সে যৌবনের অভিসারিকা। ব্রাহ্মণকন্যা ভদ্রঘরে জন্ম নিয়েও বিবাহিতা রাজলক্ষ্মী অবস্থার বিপর্যয়ে নর্তকী, গণিকা, দেহবিলাসিনী। পিয়ারী বাইজি আর রাজলক্ষ্মী এক দেহে পৃথক সত্তা। জীবিকার্জনে রাজলক্ষ্মীকে হতে হয়েছিল পিয়ারী বাইজি। দেহ ব্যাবসা নিজের দেহকে সে অপবিত্র করেছে। সমাজে চোখে সে হীনা, আত্মীয়স্বজনের কাছে রুদ্ধদ্বার। যদিও বারবিলাসিনী নর্তকীজীবনকে রাজলক্ষ্মী কখনো স্বচ্ছন্দ মনে গ্রহণ করেনি। তাই সমাজের বাইরে দাঁড়িয়েও রাজলক্ষ্মী কখনো সমাজবন্ধনকে পায়ে দলিত করতে চেষ্টা করেনি। শ্রীকান্ত নানাভাবে রাজলক্ষ্মীকে নিজের দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু রাজলক্ষ্মী তাঁর উচ্ছিষ্ট দেহ ধ্যানের দেবতাকে উৎসর্গ করতে পারেনি। নিজের অতীত জীবনের স্মৃতি প্রতিনিয়ত পীড়িত করত লজ্জা দিত রাজলক্ষ্মীকে।
‘আঁধারে আলো’ গ্রন্থে বিজলীও গণিকা। জমিদারপুত্র অনভিজ্ঞ সত্যেনকে বিজলী গঙ্গাতীরে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করছিল। সুন্দর দেহ বিনিময়ে সে বহুপুরুষকে আকর্ষণ করেছে। দক্ষ মৎস্যশিকারির মতো পুরুষ তুলতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। একদিন ছল করে বিজলী সত্যেনকে তাঁর ঘরে আহ্বান করে। সত্যেন বিজলীর ঘরে ঢুকে জানতে পারল সে এক গণিকার ঘরে উপস্থিত হয়েছে। বিজলী মনে করেছিল সত্যেন আর পাঁচজন পুরুষের মতো দেহলোলুপ। কিন্তু অতর্কিতে বিজলী প্রথম দেখল তাঁর দেহসীমা অতিক্রম করে সত্যেন দাঁড়িয়ে আছে। বিজলীও চন্দ্রমুখীর মতো অমৃতস্পর্শে জেগে উঠেছিল। বিজলী বাইজী পারিজাত স্পর্শে মরেছে। চন্দ্রমুখীও একদিন দেবদাসের স্পর্শে মরেছিল। দানে রাজলক্ষ্মী অতুলনীয়া, চন্দ্রমুখী ত্যাগে গরীয়সী, বিজলী কিন্তু সত্যেনের কাছে কোনোরূপ প্রতিদান প্রার্থনা করেনি। সেই নিস্পৃহ প্রেমই বিজলীকে মহীয়সী করেছে। মোটের উপর শরৎবাবুর তিনজন গণিকার পিছনে ছিল নারীর প্রচ্ছন্ন সত্তা এবং প্রচ্ছন্ন সত্তার বিশ্লেষণ করে তিনি গণিকার নতুন রূপ দেখিয়ে দিয়েছেন।