প্রাক্-আধুনিক যুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগে এসে সমাজ ও রাষ্ট্র (সেসময় রাষ্ট্র বলতে সমগ্র ভারত বোঝাত না) খানিকটা থিতু হয়ে এলে বাংলা সাহিত্যে পুনরায় জাঁকিয়ে প্রবেশ ঘটল গণিকাদের। প্রবেশ ঘটল বটে, তাঁদের হৃত সম্মান ফিরে এলো না। এ সময়ে গণিকারা ক্রমশ ঘৃণ্য ও প্রান্তিক হয়ে গেল। কী সমাজে, কী সাহিত্যে। তৎকালীন সমাজের গণিকাদের প্রতিচ্ছবিই সাহিত্যেও প্রতিফলন ঘটেছে। অথচ প্রাচীনকালে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ জুড়ে ছিল গণিকাদের মাথা উঁচু করে চলার অবাধ ও স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র। এখনকার মতো গোপনীয় ও বিপন্নতা ছিল না গণিকাজীবন ও বৃত্তি। সম্মান ও মর্যাদা ছিল সমাজের অন্য পেশার মানুষদের মতো। বরং বলা যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য পেশার মানুষদের চেয়েও বেশি সম্মান ছিল। গণিকাদের সমাজ ও জীবন ছিল বিশেষ মনোরম ও উপভোগ্য। এখনকার মতো মোটেই ক্লেদাক্ত জীবন ছিল। তবে প্রাচীন যুগে কখনো-সখনো নিয়মনিষ্ঠ শাস্ত্রকারেরা গণিকাদের সম্পর্কে কঠোর বাক্যবাণ প্রয়োগ করলেও বেদ, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই গণিকাদের গৌরবোজ্জ্বল, রাজকীয়, দৃষ্টিনন্দন পদচারণা অনুভব করা
আধুনিক যুগে এসে গণিকার কথা জানতে পাচ্ছি এক গণিকা কলমে। মানদাদেবীর কলমে। লেখিকা মানদাদেবী নিজে একজন গণিকা। মানদাদেবীর গ্রন্থের প্রথম পর্বে বর্ণিত হল তাঁর জীবনের কৈশোর পেরিয়ে কীভাবে তিনি গণিকা হলেন। এরপর পাই একজন শিক্ষিতা গণিকায় মুখে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা।এমন একটি নির্ভেজাল নির্মোহ গণিকার আত্মচরিত আগে কখনো পাওয়া যায়নি। সেই অর্থে বলা যায় এই দুর্লভ আত্মচরিত সেইসময়কার গণিকাদের জীবন সম্পর্কে আমাদের অনেকগুলো জানালা খুলে দিয়েছে।
আধুনিক যুগের লেখকদের লেখায় ফুটে উঠল গণিকাদের জীবনযাপন, তবে গণিকাদের প্রতি সমাজের ঘৃণ্য ও অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। অনেকক্ষেত্রেই সমাজ কলুষিত করছে এমন অভিযোগ গণিকাদের কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়েছে। গণিকারাও মানুষ, তাঁদেরও যে আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করার অধিকার আছে, স্বপ্ন আছে, সে বিষয়টি লেখকদের লেখায় প্রাধান্যই পায়নি। গণিকারা সমাজে অগ্রহণীয় হয়ে উঠল। গণিকাদের স্বাদ নেওয়া যায়, কিন্তু সমাজে গ্রহণ করা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা সংকলনে গণিকার চরিত্রায়ণ খুব একটা সুলভ নয়। যেটুকে এসেছে তাও সংস্কৃত ও পালি সাহিত্য চয়ন করা। তাঁর কাব্য ও নাট্যে শ্যামা, বাসবদত্তা নান্মী গণিকা চরিত্রগুলিরই পুনর্নির্মাণ লক্ষ করা যায়। তাঁর সমসাময়িক কোনো গণিকার কথা তাঁর সাহিত্যে উঠে আসেনি। রবীন্দ্র কথাসাহিত্যে গণিকাঁচরিত্রের স্বল্পতার কারণে তাঁর কাব্য-নাট্যে যে চরিত্রগুলি উঠে এসেছে তার আলোচনা প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবনের যে বিশেষ পর্যায়টি অতীতের দিকে মোহমুগ্ধ দৃষ্টিতে ফিরে দেখায়, সেই সময়পর্বে লেখা কবিতাগুলির কথা উল্লেখ করতে পারি। যেমন–অভিসার, পতিতা, পূজারিনী, পরিশোধ, অপমানবর ইত্যাদি। প্রাচীন সাহিত্য, বৌদ্ধজাতক ও অবদান সাহিত্য এবং ভক্তমাল থেকে বিষয়বস্তু গ্রহণ করে তিনি এই কাব্যগুলিতে গণিকা চরিত্রগুলির পুনর্নির্মাণ করেছেন বলা যায়। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আলোয় তিনি চিনতে চেয়েছেন দুঃখে-দ্বন্দ্বে-ক্রন্দনে সিক্ত গণিকাদের মনোজগৎটিকে। গণিকাদের তিনি শুধু নষ্ট মেয়ে হিসাবে দেখেননি, দেখতে চেয়েছেন আর পাঁচটা ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত সাধারণ নারী হিসাবে। প্রাচীন কাব্যে যে গণিকাদের পাওয়া যেত শাসকের হাতের পুতুল হিসাবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে পড়ে সেই গণিকাদের মধ্যে প্রকাশ পেল তাঁদেরই অন্তর্দ্বন্দ্ব, অনুশোচনা ও আত্মশুদ্ধি এক ব্যক্তিত্বময় অভিব্যক্তি। তিনি কেন প্রাচীন সাহিত্য থেকে আবিষ্কৃত গণিকাদের অন্যভাবে প্রকাশ করলেন, তার জবাব কবি নিজেই দিয়েছেন–“রমণী পুষ্পতুল্য, তাহাকে ভোগে বা পূজায় তুল্যভাবে নিয়োগ করা যাইতে পারে। তাহাতে যে কদর্যতা বা পবিত্রতা প্রকাশ পায়, তাহা ফুলকে বা রমণীকে স্পর্শ করে না–ফুল বা রমণী চিরপবিত্র, চির অনাবিল।… যে সহজ-পূজ্য তাহাকে ভোগ্যের পদবিতে যে নামাইয়া আনে সেও একটা আনন্দ পায় বটে, কিন্তু সে আনন্দ অতি নিকৃষ্ট শ্রেণির। পতিতা হইলেও নারীর স্বাভাবিক পবিত্রতা তাহার ভিতর প্রচ্ছন্ন থাকে। … পাপের অন্যায়ে সে তাহার আত্মাকে কলুসিত করিয়াছে বটে, কিন্তু তাহার আত্মা একেবারে বিনষ্ট হইয়া যায় নাই–তাহার আত্মা বাষ্পচ্ছন্ন দর্পণের ন্যায় ক্ষণিকের জন্য তাহার সহজ স্বচ্ছতা ও শুচিতা হারাইয়াছে।”
রবীন্দ্রনাথের ‘বিচারক’ গল্পে একজন গণিকার কথা পাওয়া যায়। গণিকা ক্ষীরোদা। ক্ষীরোদাই এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ক্ষীরোদার যে জীবনবৃত্তান্ত এই গল্পের উপজীব্য তাতে গৃহস্থ ঘরের মেয়ে কেন গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করে তার শেষ পরিণতি কী হয় সেই প্রসঙ্গই বিশ্লেষিত হয়েছে কবির কলমে। গল্পটির রচনাকাল উনিশ শতকের শেষ দশকে। উনিশ দশক জুড়ে গণিকা সম্পর্কে যে তাচ্ছিল্য ব্যঙ্গ ঘৃণা বর্ষিত হয়েছে, শেষ দশকে রচিত গণিকা ক্ষীরোদার চরিত্র তা থেকে আলাদা। আলাদা এই কারণে যে, পূর্ববর্তী লেখকেরা সমাজে গণিকাদের প্রবল উপস্থিতিকে স্বীকার করে নিলেও সাধারণভাবে তাঁদের প্রতি মোটেই সহানুভূতিশীল ছিল না। তাঁদের সামাজিক দৃষ্টিকোণ কিছুটা ভিক্টোরিয়ান শুচিতাবোধ, আবার কিছুটা গোঁড়া হিন্দু রক্ষণশীলতায় আচ্ছন্ন। রবীন্দ্রনাথ গণিকাদের দরদি হৃদয় দিয়ে বিশ্লেষণ করেন। এতদসত্ত্বেও রবীন্দ্র কথাসাহিত্যে গণিকা চরিত্র আর সৃজিত হয়নি। আশি বছরের দীর্ঘ জীবনের অর্ধাংশ রবীন্দ্রনাথ কাটিয়েছেন বিশ শতকের দ্রুত পরিবর্তিত আর্থ সামাজিক পরিবেশে। এমতাবস্থাতেও সময়ের প্রেক্ষাপটে গণিকা চরিত্র তাঁর কোনো গল্প-উপন্যাসে চিত্রিত হয়নি।