(৫) হৃতা : এই মেয়েদের মূলত চুরি করে আনা হত। নিরুদ্দিষ্টার সন্ধান পেত না সেই অঞ্চলের নগরকোটালও। সেই মেয়ে বহুদূর দেশে মন্দিরের অন্ধকূপে বন্দিনী হিসাবে থাকত।
(৬) অলংকারা : যে-কোনো শ্রেণির দেবদাসীই রূপ-গুণ নৃত্যগীত পারদর্শিতার বিচারে অলংকারা পদে উন্নীতা হতে পারে। ঐহিক বিচারে এই মেয়েরা শীর্ষস্থানীয় হলেও শ্রদ্ধা ও সম্মানের দিক থেকে ভক্তা শ্রেণির নিচে।
দেবদাসী প্রথা নির্মূল হয়ে গেছে বলে যাঁরা নিশ্চিন্তের ঢেঁকুর তোলেন। তাঁদের বলি, তুলবেন না সেঁকুর। খবর আছে। কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের কিছু মন্দিরে এখনও বিগ্রহের কাছে মেয়েদের বিসর্জন দেওয়া হয়। আজকের দেবদাসীরা আর দেবতার দাস নয় অনেকক্ষেত্রেই। মূলত তাঁরা লোলুপ পুরুষের লালসার শিকার। আর এই লালসা তৃপ্ত করতে এগিয়ে এসেছে যেসব মন্দিরের রক্ষক, সেগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ কর্ণাটকের ইয়েলাম্মা মন্দির। যেহেতু মন্দিরকন্যাদের বিয়ে হয় না, তাই তাঁদের বিনা বাধায় সম্ভোগ করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের পুরুষরা। যে পূজারী দেবদাসী অর্পণের কাজে লিপ্ত, তিনি মোটা অঙ্কের অর্থপ্রাপ্ত হন। যাঁরা এই প্রথাকে তাঁদের জাতিগত ঐতিহ্যের অংশ মনে করেন, তাঁরা বড়োই তৃপ্ত হন! তা ছাড়া ইয়েলাম্মা মন্দিরের মেয়েরা প্রকৃত অর্থে দেবদাসী নন। এঁরা না বোঝেন চৌষট্টি কলা, না কোনো ধনীব্যক্তির রক্ষিতা। একপ্রকার খোলাখুলিভাবেই দেহবিক্রিই তাঁদের কাজ।
মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের প্রান্তিক জেলাগুলি থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫০০০ হরিজন শ্রেণির মেয়েদেরকে ইয়ালাম্মার কাছে অর্পণ করা হয়। এই প্রথার পিছনে শুধু বহু যুগের বিশ্বাস এবং অজ্ঞতা আছে তা নয়–আছে আর্থিক কারণ, আছে পুরোহিতদের প্ররোচনা। প্রাচীন প্রথার এই দুঃসহ আধুনিকীকরণ সবচেয়ে বেশি প্রচলিত কর্ণাটকের বেলগাঁও, ধারওয়ার, বিজাপুর, গলবর্গা ও বেলারি জেলায়। অন্যদিকে মহারাষ্ট্রের সিতারা, কোলাপুর, শোলাপুর ও ওসমানাবাদ অঞ্চলে এবং তেলেঙ্গানাতে যথাক্রমে ১০,০০০ এবং ২৫,০০০ দেবদাসী আছে। বংশপরম্পরায় এই মেয়েরা পুরুষদের ভোগ্যা।
সর্বোপরি যেটা না বললে অন্যায় হবে, তা হল–দেবদাসীরা ভারত-সংস্কৃতিকে দিয়েছে অনেক সম্পদ। কথাকলি, ভারতনাট্যম, মোহিনী-আউম, কুচিপুড়ি–এ সবই দেবদাসী সংস্কৃতি। যুগে যুগে এঁর দেবদিন্নদের উদ্বুদ্ধ করেছে মন্দিগাত্র অলংকরণে–কোনারক, খাজুরাহো, বেলুড়, হালেবিড থেকে বাঁকুড়ার মন্দিরেই রয়ে গেছে শ্বাশত প্রমাণ। তাঁদের দান অক্ষয়, অমর।
দেবদাসী প্রথার বিরুদ্ধে বহুদিন ধরে সংগ্রাম চলছে। তা সত্ত্বেও জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ভাবনায় বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। ১৯২৯ সালে ডাঃ মুথুলক্ষ্মী রেডিড নামে এক মনস্বিনী মহিলার নেতৃত্বে দেবদাসী প্রথা উচ্ছেদের যে সংগ্রাম শুরু হয়, তার ফলে দেবদাসী প্রথা বিলোপের জন্য মাদ্রাজ বিধানসভায় আইন প্রণয়ন করে এই প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। বোম্বাই বিধানসভায় ডাঃ হরি সিং গৌরও অনুরূপ চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে দেবদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আক্ষেপ এই যে, ভারতে দেবদাসী প্রথা আজও বিলুপ্ত হল না। এখনও যেসব অঞ্চলে দেবদাসী বহাল তবিয়তে চলছে, সেগুলি হল–কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কেরলের একটা বড়ো অংশ। তাই দেবদাসী প্রথা বিলুপ্তির জন্য আন্দোলন থেমে যায়নি। ফলে আবার নতুন করে শুরু হয়েছে দেবদাসী-বিরোধী আন্দোলন। নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘দেবদাসী মুক্তি বাহিনী। নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কীভাবে দেবদাসী রমরম করে চলছে, সে ব্যাপারে স্থানীয়ভাবে কয়েকটি সমীক্ষা করা হয়েছে। সেই সমীক্ষায় উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। জানা গেছে, এই দেবদাসী প্রথার মাধ্যমে মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, চেন্নাই পতিতালয়গুলি সমৃদ্ধ করা হচ্ছে। কারা এই প্রথাকে জিইয়ে রাখতে চাইছে কীভাবে রাখতে পারছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।
০৮. প্রাক-আধুনিক ও আধুনিক সাহিত্যে গণিকা
প্রাক-আধুনিক যুগের সাহিত্যে এসে গণিকাদের প্রকটভাবে আর পাওয়া যায় না। প্রাক-আধুনিক যুগকে যদি চর্যাপদ ধরি, সেখানে গণিকাদের উপস্থিতি নেই। কেন নেই? হঠাৎ করে সমাজ বদলে যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। সে সময়কার মানুষের জীবনযাত্রা উল্লেখ করার মতো সংযত ছিল, এমন আভাস কোথায়! প্রকট না-হলেও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত কিন্তু মেলে। কিন্তু ব্রাহ্মণ প্রভৃতি উচ্চবর্ণের নাগরিকেরা যে মাঝেমধ্যে গোপনে রমণীদের সঙ্গে সম্পর্ক করতেন, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে এই পদগুলিতে–“টালত ঘর মোর নাহি পড়বেষী”, উঞ্চা উঞ্চা পাবত তহি বসহি সবরী বালী”, “নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহের কুড়িআ”। এইসব গণিকা-রমণীরা ছিল আর্থিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত, অস্পৃশ্য ও অবহেলিত। ব্যভিচারিতা বলা যায় না, বরং বলা যায় এটা ছিল হতদরিদ্র নারীদের এটাই ছিল জীবিকার্জনের অন্যতম পথ। বলা যায় এসময় থেকেই গণিকাদের মর্যাদার পতন শুরু। ঘৃণ্য হতে শুরু করল।
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের দ্বিতীয় খণ্ড বিদ্যাসুন্দরে জনৈকা হীরামালিনী, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বড়ায়িরা দূতী হিসাবে পরিচিত হলেও সংস্কৃত সাহিত্যে এঁরা গণিকা রূপেই অঙ্কিত। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে গণিকাদের উপস্থিতি যেভাবে প্রকটিত হয়েছিল, মধ্যযুগ তথা প্রাক-আধুনিক যুগে এসে অনেকটাই প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়। এহেন পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব হল? আসলে সেসময়টা ছিল নানবিধ উত্থান-পতনে জর্জরিত। গোটা মধ্যযুগ জুড়ে ছিল অস্থিরতা। শক, হুন, পাঠান, মোঘল, এমনকি বর্গি আর ঠগিদের দৌরাত্ম্যে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। চারিদিক যুদ্ধ, হানাহানি, হিংসা, আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণের মানুষের মানবিক মূল্যবোধ প্রায় তলানিতে। এহেন অস্থির পরিমণ্ডলে কবি-লেখকদের লেখনী প্রায় স্তব্ধ হয়ে যায়। সম্ভব হয়ে উঠছিল না মননশীল সাহিত্য রচনা। সেইসঙ্গে ব্রাত্য ও অপাঙক্তেয় হল গণিকা। সম্ভবত এই কারণেই প্রাক-আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তেমন একটা গণিকাঁচরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় না। সমগ্র মধ্যযুগের ভরকেন্দ্র ছিল ধর্ম, বিশেষ করে বঙ্গদেশে। সেসময় যতটা-না সামাজিক সাহিত্য রচিত হয়েছে, তার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি ধর্মাশ্রিত সাহিত্য রচিত হয়েছে। ফলে সে সময়ের অন্য সাহিত্যে গণিকাদের নিয়ে ভাবার অবকাশ লেখকেরা পাননি। তার মানে এই নয় যে, সেসময়ের সমাজে গণিকারা ছিল না। অবশ্যই ছিল, তবে ধর্মীয় অনুশাসনের বেড়াজালে নারীর জীবন প্রান্তিকায়িত হয়ে গেল।প্রাক্-আধুনিক যুগ ও তারও পরে গণিকাজীবন অবহেলিত থেকে গেল বাংলা সাহিত্যে।