রাজ্য জয় করে রাজারা যেমন গোরু-ছাগলের মেয়েদের মতো তুলে আনত, তেমনই সেইসব মেয়েদের ধরে ধরে দেবদাসী তথা গণিকায় পরিণত করত। আদতে এভাবেই দেবতাদের বউ বানানোর অছিলায় মেয়েদেরকে গণিকা বানিয়ে গণভোগ্যা বানিয়ে নিত সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। ১৮৬৭-৬৮ সালে জন শর্ট লন্ডনের অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সোসাইটিতে ভারতের দেবদাসীদের প্রসঙ্গে একটি বিস্ফোরক রিপোর্ট পেশ করেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে–মন্দিরে দেবদাসীদের কুমারীত্ব’ বহিরাগত ধনীদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করা হত। তারপর তাঁরা গণিকাবৃত্তিতে নিয়োজিত হত।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়, সব মেয়েকে যে জোর করে দেবদাসী বানিয়ে নেওয়া হত, তা কিন্তু নয়। দেবদাসী মাহাত্ম এমন পর্যায়ে প্রচার করা হয়েছিল যে, অনেকেই স্বেচ্ছায় দেবতার কাছে নিজেদের উৎসর্গ করে দিত। পুণ্যলাভের আশাতেও মা-বাবারা দেবতার সঙ্গে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিত। তবে এঁদেরকে মন্দিরে আত্মসমর্পণ করতে হত না, গণভোগ্যাও হতে হত না। অবশ্যই দেবতা বিয়ে করে দেবতার কাছে আত্মসমর্পণ করে সারাজীবন কাটিয়ে দিত। এমনই এক বিখ্যাত দেবদাসী মীরা তথা মীরাবাঈ। রাজস্থানের এক অভিজাতবংশীয় হিন্দু পরিবারের সন্তান। বাল্যকালে এক পরিব্রাজক সন্ন্যাসীর দ্বারা আরাধিত একটি কৃষ্ণমূর্তির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন এবং কৃষ্ণকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করেন। তাঁর মা তাঁর এই ভক্তিভাবের সমর্থক ছিলেন। শৈশবেই চিতোররাজ রানা সংগার জ্যেষ্ঠ পুত্র ভোজরাজের সঙ্গে মীরার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন তিনি শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। স্বামী ভোজরাজকে বলেন, তিনি মীরার শরীর পাবেন, কিন্তু মন পাবেন না। কারণ মীরা তাঁর মনপ্রাণ সব কৃষ্ণের পায়ে নিবেদন করেছে।
ভবিষ্যপুরাণে আছে–“বেশ্যাকম্বকং যস্তু দদ্যাৎ সূর্যায় ভক্তিতঃ সগচ্ছেৎ পরমং স্থানং যত্র তিষ্ঠতি ভানুমান”। মহাকবি কালিদাস তাঁর মেঘদূতে উজ্জয়িনী মহাকাল মন্দিরে চামরহস্তা দেবদাসীদের ‘বেশ্যা’ বলে পরিচিত করিয়েছেন। দেবদাসী সৃষ্টির পিছনে ছিল মানুষের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, ভুল ধারণা ও ধর্মান্ধতা। সাধারণ মানুষ মনে করত আত্মজাকে দেবদাসী করে দিতে পারলে শুধু দাতার নয় কন্যারও স্বর্গলাভের একটা পাকা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যে ভাবনা থেকে নবমবর্ষীয় কন্যাকে কুলীন বৃদ্ধের কাছে গৌরীদান করত ভারতীয় হিন্দু পিতামাতারা। যেমনভাবে বোঝানো হত মৃত স্বামীর সঙ্গে চিতায় উঠে সহমরণে গেলে সরাসরি স্বর্গের জমি নিশ্চিত। সতী হিসাবেও পুজো পাবে সেই অভাগা নারী। আসলে এমনই বোঝানো হত। বোঝাত হিন্দু সমাজের পুরোহিতকুল।
কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে দেবদাসীদের আলোচনা করেছেন। তবে তিনি দেবদাসী শ্রেণির আইনকানুন লিপিবদ্ধ করেননি। তিনি এটা অবশ্যই বলেছেন যে, এসব ব্যাপারে আইনকানুনের দায়িত্ব পুরোহিত তথা পুরোহিততন্ত্রের। অর্থাৎ মধ্যযুগ থেকেই দেবদাসীদের উপর ওই পুরোহিতকুলের অধিকার ইতিহাস স্বীকৃত। যাঁরা দূরদর্শনে ‘অগ্নিজল’ ধারাবাহিকটি চাক্ষুষ করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এতদিনে জেনে গেছেন দেবদাসী নিয়ন্ত্রণে পুরোহিতদের কী দাপট! পুরোহিতদের আধিপত্য এতটাই যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজাও ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত। রাজাদের তরফ থেকে দেবদাসীদের বিষয়ে কোনো ভালো-মন্দ পরামর্শই পুরোহিতরা গ্রহণ করত না। পুরোহিতরা নিজেরা যেসব আইনকানুন বা বিধিনিষেধ আরোপ করত, তা অতি যত্নে গোপন রাখা হত। পুরোহিততন্ত্র নিজেদের স্বার্থেই দেবদাসীদের লোকচক্ষুর আড়ালে রাখত চাইত। যা কিছু আড়ালে-আবডালে তাতেই মানুষের মোহবৃদ্ধি। এটাই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।
দেবদাসীদের মোটামুটি ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন–(১) বিক্রিতা, (২) ভৃত্যা, (৩) ভক্তা, (৪) দত্তা, (৫) হৃতা এবং (৬) অলংকারা। এই বিভাজন কেন? এই ভাগ-বিভাগ কেন? আসুন একটু বিস্তারিত জেনে নিই।
(১) বিক্রেতা : এই মেয়েদের অর্থের বিনিময়ে কিনে নেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা অত্যন্ত গরিব পরিবারের সুন্দরী মেয়ে। অধিক মেয়েদের পিতামাতারা অর্থের বিনিময়ে এরকম দু-একটি মেয়েকে তুলে দিত পুরোহিতদের মালিকানায়। দেবদাসীর গর্ভজাতা মেয়েও এই দলেই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এইসব মেয়েরা যৌবনপ্রাপ্তা হলে মন্দিরের পুরোহিত নিজে অথবা তাঁর প্রিয়পাত্রকে দিয়ে সেই মেয়ের কৌমার্য নষ্ট করে দেবদাসী হিসাবে নিয়োগ করতেন।
(২) ভৃত্যা : বিশেষণ পড়েই বুঝতে পারছেন এরা আসলে ভৃত্য বা চাকরানি শ্রেণির। তাই স্বাভাবিকভাবেই এরা পদমর্যাদায় ‘বিক্রেতা’ দেবদাসীর নিচে। যৌবনবতীদের কর্তব্য ছিল মন্দিরের অতিথিবর্গকে দেহদানের মাধ্যমে শরীরী-পরিসেবা দেওয়া।
(৩) ভক্তা : স্বেচ্ছায় কোনো মহিলা (কুমারী, সধবা, স্বামী পরিত্যক্তা যে কেউ) মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে যখন দেবদাসী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে, তাহলে সে ভক্তা। ভক্তিই এদের আধার। এরা অতি উচ্চ সম্মানের পদাধিকারী। তবে এদেরকে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে হত না।
(৪) দত্তা : কোনো ধর্মান্ধ পুণ্যলোভী পিতা মনোবাসনা চরিতার্থ করার জন্য, মানত রাখার জন্য, স্বেচ্ছায় নিজের মেয়েকে মন্দিরে দান করলে সেই মেয়ে দত্তা হয়।