ভরতের নাট্যশাস্ত্রে আমরা অপ্সরাদের পাচ্ছি নৃত্যগীতশিল্পী ও অভিনেত্রী হিসাবে, যাঁরা তথাকথিত দেবতাদের মনোরঞ্জনে ব্রতী হতেন। অপ্সরারা কোনো অলৌকিক বা কাল্পনিক অস্তিত্ব নয়, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে রক্তমাংসের মানবী মাত্র। নাট্যশাস্ত্রের শুরুতেই এইসব নাট্যকুমারীদের কথা এবং অপ্সরাদের কথা বলা হয়েছে। এই নাট্যকুমারীরা একটি বিশেষ গোষ্ঠীভুক্ত ছিল, একথাও উল্লেখ আছে। এঁদের যে-কোনোভাবে সংগ্রহ করে অতি সহকারে নৃত্যগীতবাদ্য শিক্ষা দিয়ে রঙ্গমঞ্চে হাজির করা হত, তার বিশদ বর্ণনা আছে ভরতের নাট্যশাস্ত্রে। প্রসিদ্ধ তামিল নাটক ‘শিল্পপ্পাদিকর’-এর কয়েকটি অধ্যায়ে দক্ষিণ ভারতীয় প্রাচীন সংগীত ও নৃত্যের উল্লেখ আছে। এই নৃত্য অবশ্যই দেবদাসী নৃত্য। ধনবানদের বিলাসকলার অন্যতম প্রধান উপকরণ ছিল নারী। আর নারীরা ছিলেন সুশিক্ষিতা, সুবেশা এবং অবশ্যই কামশাস্ত্রনিপুণা।
বঙ্গদেশে দেবদাসী প্রথার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় অষ্টম শতকে কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে, নর্তকী কমলার প্রসঙ্গে। বঙ্গদেশে পালযুগেও দেবদাসী প্রথার অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। গুপ্তযুগেও এইসব নর্তকীদের সম্বন্ধে বহু বর্ণনা পাওয়া যায়। বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তিও এই প্রথার ব্যাপকতার ইঙ্গিত মেলে। দেওপাড়া প্রশস্তির কবি উমাপতি ধর লিখেছেন–বিষ্ণুমন্দিরে উৎসর্গীকৃত দেবদাসীরা যেন রূপ ও সৌন্দর্যের দ্বারা কামদেবতাকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। ভট্ট ভবদেবের ভুবনেশ্বর প্রশস্তিও একই কথা বলেছে। দ্বাদশ শতাব্দীর সূচনায় কর্ণরাজের রত্নগিরি তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, তাঁর রানি কর্পূরশ্রী সলোনপুরের বৌদ্ধমন্দিরের দেবদাসী ছিলেন। কর্পূরশ্রীর মা মাহুনদেবীও দেবদাসী ছিলেন। কর্ণাটকে দ্বাদশ শতাব্দীর সূচনায় চালুক্যরাজ বিক্রমাদিত্য ইত্তাগিতে চণ্ডালেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন দেশ থেকে সুন্দরী নারীদের এনে সেখানে দেবদাসীরূপে নিয়োগ করেন। পহুবী লিপিগুলিতে দেবদাসীদের কথা উল্লেখ আছে। দেবদাসীদের নিয়ে আলাদা বর্ণনা পাওয়া যায় ‘মেঘদূত’ সহ বিভিন্ন কাব্যে।
সম্প্রতি “কর্ণাটক রাজ্যের দেবনগর জেলার উত্তরঙ্গমালা দুর্গা মন্দিরে রাতের বেলায় নারীদের দেবতার নামে উৎসর্গ করার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে”–এই মর্মে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এক বেঞ্চ রাজ্যের মুখ্যসচিবকে ওই অনুষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দেন। এই কুপ্রথা কার্যত নারীদের যৌনশোষণ, যা ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। আশা ছিল এর ফলে দেবদাসীদের সামাজিক যৌনশোষণ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। এখনও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, মহারাষ্ট্রে, ওড়িশায় এবং দেবতাকে উৎসর্গ করার নামে দেবদাসীদের প্রধানত দেহভোগের কাজেই ব্যবহার করা হয়। দেবতা বা মন্দিরে উৎসর্গ করার পর তাঁদের পরিচয় হয় দেবদাসী। কোনো কোনো অঞ্চলে তাঁদের বলা হয় যোগিনী।
প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন এই প্রথা ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর পিছনের বড়ো কারণগুলি হল চরম দারিদ্রতা, বর্ণবৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। গরিব ঘরের মা-বাবা তাঁদের কুমারী মেয়েদের রজস্বলা হওয়ার আগেই নিয়ে আসত মন্দিরে। প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়। তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উৎসর্গ করার নামে বিগ্রহের সঙ্গে কুমারী তথাকথিত ‘বিয়ে’ দিয়ে দেন। এর ফলে সেই মেয়ের কোনো পুরুষই স্বামী হতে পারে না। নিরাকার দেবতাই তাঁর একমাত্র স্বামী। খাওয়া-পরার বিনিময়ে মন্দিরের বাসিন্দা হয়ে তাঁদের সারাজীবন কাটিয়ে দিতে হয়। কায়িক পরিশ্রমের সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থেকে মন্দিরের অন্যান্য পুরুষদের সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে হত। এছাড়াও সমাজের উচ্চবর্গীয় ধনী কিংবা সামন্তপ্রভুদের রক্ষিতার ভূমিকা পালন করতে হয়। মন্দিরের পূজারী ব্রাহ্মণ এবং সামন্তপ্রভুদের যোগসাজসে কৃষক ও কারুশিল্পী বা কারিগরদের উপর ধর্মীয় প্রভাব খাঁটিয়ে দেবদাসীদের গণিকাবৃত্তিকে দেওয়া হয় ধর্মীয় সিলমোহর। উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের। আজব ব্যাপার, অন্য কোনো পুরুষকে নিজের স্বামী রূপে গ্রহণ করা যাবে না, কিন্তু যৌনমিলনে কোনো বাধা নেই! এই ধর্মীয় প্রথার উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে নানা কাহিনি, বিতর্ক এবং বিভিন্ন জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। দেবদাসীদের তথ্য ঐতিহাসিক বা পুরাতাত্ত্বিক বিভিন্ন মন্দিরের গাত্রে আজও উৎকীর্ণ আছে।
দক্ষিণের তিরুপতি মন্দিরে দেবদাসী সংগ্রহের প্রাচীন পদ্ধতি সম্পর্কে খ্রিস্টান মিশনারি অ্যাবে জে এ র্দুবা এক সমীক্ষায় লিখেছেন–“বছরের একটি বিশেষ দিনে এই মন্দিরের পুরোহিতেরা ভগবান বেঙ্কটেশ্বরের প্রতিমূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা বের করতেন এবং পথে যত সুন্দরী মেয়ে চোখে পড়ত তাঁদেরকে দেবদাসী করার দাবি জানাত। শুধু কুমারী মেয়েই নয়, সুন্দরী বিবাহিত মেয়েদেরও দাবি করত তাঁরা। এ থেকেই বোঝা যায়, দেবদাসী করার জন্য মেয়েদেরকে জোর করেই তুলে আনা হত।” দুবার এহেন মন্তব্য। গবেষক পণ্ডিত জি জি ফ্রজার পশ্চিম আফ্রিকায় দেবদাসী সংগ্রহের যে অভিনব উপায়ের উল্লেখ করেছেন, তা থেকে জানা যায়–মেয়েদের জোর করে তুলে এনে দেবদাসী থেকে গণিকা বানানো হত। ফ্রিজার লিখেছেন–“পুরোহিতরা একটা বিশেষ দিনে নগরের পথে পথে ঘুরে বেড়াত এবং সেদিন দুয়ারের বাইরে যত কুমারী মেয়ে পেত তাঁদের সবাইকে ধরে নিয় যেত মন্দিরে দেবদাসী করার জন্যে।”