নারীপণ্যের একটা বিশাল বাজারই হল মন্দির। মন্দিরে হত বলেই দেবদাসী, মন্দির ছাড়া অন্য কোথাও হলে ‘গণিকা’। ভারতীয় নারীসমাজ বহুকাল যাবৎ এই প্রথার কারণে অসম্মানিত এবং অত্যাচারিত। এই প্রথা কেন বিস্তার লাভ করেছে, অতীত ও বর্তমানের অবস্থা বোঝা ও জানা প্রয়োজন।
মিশর পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্য দেশ বলে পরিচিত। এই দেশেই আমরা দেখতে পাই প্রথম দেবদাসী বৃত্তির কথা। আমন, আমনের স্ত্রী মুট এবং তাঁদের পুত্রসন্তান খোন সু–এই তিন দেবতার প্রতিষ্ঠা করেন মিশরের রাজারা। খ্রিস্টজন্মের প্রায় ১৪০০ বছর আগে রাজা তৃতীয় আমেস হোটেপ থিবস নগরীতে মহাসমারোহে মন্দির নির্মাণ করেন। মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে ধনসম্পদ লুঠ করে এই মন্দির নির্মাণ এবং দেবতার ভোগের উপকরণের জন্য ব্যয় করেন। এই মন্দিরে দাসদাসীও প্রচুর মজুত ছিল। এই সময়ের একটি দলিল থেকে জানা যায়, তৃতীয় রামেসিস আমন মন্দিরের জন্য ৮৬,৪৮৬ জন দাসদাসী উৎসর্গ করেছিলেন। ‘Great Harris Papyrus’ নামে এই দলিলটি সম্ভবত মন্দিরে দেবদাসী নিয়োগের প্রামাণ্য দলিল।
রামেসিস বংশের শেষ রাজার মৃত্যুর পর মিশরের শাসনভার যুগ্মভাবে তানিসের ফারাও ও থিবসের প্রধান পুরোহিতের উপর ন্যস্ত হয়। তানিসের রাজকন্যারা থিবসের মন্দিরে আমনদেবের স্ত্রী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকেন। সমাজের উচ্চকোটি নারী থেকে ক্রীতদাসী পর্যন্ত মন্দিরের দেবদাসী হিসাবে অংশগ্রহণ করত। আসিরীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতার ইতিহাসে দেবী ইশরাতের সঙ্গিনীরূপে নারীরা মন্দিরে দেবদাসী হিসাবে নিযুক্ত হত। এসময় ব্যাবিলনের দেবতারা হলেন–মারডুক, শামাশ, তাম্বুজ ও ইশতার। প্রাচীন ব্যাবিলনে প্রতিটি বিবাহযোগ্যা নারী দেবী ইশতারের মন্দিরে বসে থাকবেন। প্রথমেই যে পুরুষ অভীষ্ট নারীর কোলে একটি রৌপ্যমুদ্রা ফেলবেন, সেই পুরুষের সঙ্গেই নারীটি যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হবেন। বিবাহ-পূর্ব বেশ্যাবৃত্তি এভাবেই শুরু হয়ে যেত। মন্দির-দাসীদের এই হল বেশ্যাবৃত্তির ইতিহাসের বাধ্যতামূলক সোপান।
আফ্রিকার উত্তর উপকূলে ফিনিশীয় মন্দিরগুলিতেও নর্তকী ও দেবদাসীর কথা জানা যায়। প্রাচীন গ্রিসের মন্দিরগুলোতেও দেবদাসী নিযুক্ত হত। Hierodule নামে এই দেবদাসীরা সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর মন্দিরে সর্বত্রই দেবদাসী থাকত। শুধু অ্যাপোলোর মন্দিরেই নয়, গ্রিসের অন্যান্য মন্দিরেও দেবদাসী মজুত থাকত যথেষ্ট সংখ্যায়। এদের কাজ ছিল নৃত্যগীত প্রদর্শন এবং বাধ্যতামূলক গণিকাবৃত্তি। কেবলমাত্র পুরোহিত, রাজা ও ক্ষমতাশালীদের কাছেই এরা ভোগ্যা ছিল। আর্টেমিসের মদিরা দেব বাছুজের মন্দিরে দাসীরা বাধ্য হত এক বিচিত্র জীবনযাপনে। এই দাসীদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হত। যেমন–Maenad, Amazon ইত্যাদি। Maenad নারীদের শিশু বয়স থেকেই দেবদাসীর উপযুক্ত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। Amazon নারীরা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিনী। তাঁরা এতটাই উৎসর্গীকৃত ছিল যে, ডান কাঁধে তূণ রাখতে যাতে বাধা সৃষ্টি না-হয়, সেজন্য ডানদিকের স্তনটি কেটে ফেলতেন। বস্তুত একস্তনী হয়ে যেতেন বলেই এঁদের নাম A-mazon। এঁদের যে সন্তানসন্ততি হত, তাঁর মধ্যে কন্যাসন্তানটিকেই বাঁচিয়ে রাখা হত এবং পুরুষসন্তানদের হত্যা করা হত, নতুবা দেশ থেকে বিতাড়িত করা হত। কন্যাসন্তানদের বাঁচিয়ে রাখা হত মানে এই নয় যে, সন্তান খুব আদরনীয় ছিল। আদরনীয় ছিল, তবে তা ছিল ভোগ্যবস্তু বানানোর জন্য।
রোমান সভ্যতাতেও দেবদাসী প্রথার সন্ধান পাওয়া যায়। দাসনির্ভরশীল এই রোমান সভ্যতার জিউস, জুনো ও ভেনাসের মন্দির সহ অন্যান্য মন্দিরগুলিতে প্রচুর দেবদাসীও নিযুক্ত থাকত। পুরোহিতদের মনোরঞ্জন করাই ছিল মূল কাজ। তবে রাজা ও রাজপুরুষদেরও ভোগ্য ছিল। মনে করা হত, দেবতার ভোগ আর রাজাদের ভোগ সমপর্যায়ের। দেবদাসীদের পাশাপাশি রাজনটী ও নগরনটীদেরও আবির্ভাব হয়েছিল এ সময়। এদের Hataera বলা হত। তবে এঁদের সম্মান-মর্যাদা ছিল বেশ। এঁদের মতামতেরও মূল্য দিতেন জ্ঞানীগুণীরা।
Hataera-দের মতো জাপানের Geisha-দেরও যথেষ্ঠ মর্যাদা ছিল। সুন্দরী শিক্ষিতা এই নারীরা শুরুতে আলাপাচারণে শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট করার কাজে নিয়োজিত হলেও পরে অবশ্য সরাসরি গণিকাবৃত্তিতে প্রবিষ্ট হতেন। তবে প্রাচীন জাপানে দেবদাসী ছিল কি না সে বিষয়ে কিছু জানা যায় না। ইনকা সভ্যতাতেও আমরা দেবদাসী প্রথার সন্ধান পাই। ইনকা সম্রাটদের সূর্যের সন্তান বলা হত। ইনকার সূর্যের মন্দিরের তত্ত্বাবধানের জন্য পুরোহিত ছিল। এই মন্দিরে নারীরা সূর্যকুমারী হিসাবে মন্দিরবাসিনী হত। মন্দিরবাসিনী এই নারীদের কাজ ছিল পুরোহিত ও রাজবংশীয়দের মনোরঞ্জন করা। দেবদাসী প্রথা ছিল আটজেক সভ্যতার ইতিহাসেও।
ভারতে দেবদাসী প্রথা নামে গণিকাবৃত্তি একেবারে জাঁকিয়ে প্রাচীন যুগে এবং মধ্যযুগে, যা বর্তমান যুগেও ফল্গুনদীর মতো বহমান। ভারতের দেবদাসী প্রথার সূচনার ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর এক গুহালিপি পাই। যে গুহালিপিতে সুতনুকা নামে এক দেবদাসীর কথা জানতে পারি। উল্লিখিত উত্তীর্ণ লিপিতে বলা হয়েছে–“সুতনুকা নাম দেবদাসিক্য তং কাময়িখ বালানশেয়ে দেবদিন্নে নাম লুপদকখে”। অর্থাৎ, সুতনুকা নামে দেবদাসী, তাঁকে কামনা করেছিল বারাণসীবাসী দেবদিন্ন (দেবদত্ত) নামে রূপদক্ষ। যোগীমায়া গুহা, সীতাবেন্দা ইত্যাদি নামে যে গুহার সন্ধান পাওয়া গেছে, লিপির সাহায্যে দ্বিধাহীনভাবে প্রমাণিত হয়েছে, এই গুহামঞ্চবাসীরা মূলত দেবদাসী শ্রেণির ছিল। পুরাণাদিতে আমরা যে স্বৰ্গবেশ্যা তথা অপ্সরাদের কথা জানতে পাই, তাঁরা ছিল আসলে হাই-প্রোফাইলের দেবদাসী।