সুলসা : সুলসাও বারাণসীর প্রসিদ্ধ গণিকা। গণিকা সুলসার কথা বৌদ্ধসাহিত্য ‘সুলতাজাতক’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। সে ছিল অত্যন্ত ধনসম্পদশালিনী এবং ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্না। গণিকা সুলসা এক দস্যুর প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু সুলসার প্রেম-বিভোরতার সুযোগ নিয়ে সেই দস্যু তাঁকে এক পাহাড়ের উপর নিয়ে যায়। দস্যুটা ভেবেছিল সুলসাকে পাহাড়ের উপর থেকে ঠেলে ফেলে দেবে এবং তাঁর সমস্ত অলংকার হাতিয়ে নেবে। কিন্তু সুলসা টের পেয়ে যায় দস্যুর অভিপ্রায়। বাঁচার শেষ চেষ্টায় সুলতা দস্যুকে জানাল শেষবারের মতো তাঁর প্রেমিককে বুকে নিতে চায়। দস্যুও সুলসার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে রাজি হয়ে যায়। সুলসা আলিঙ্গনের ভান করে হাত বাড়িয়েই দস্যুকে ধাক্কা দিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দেয়।
কালি : ‘তরীয় জাতক’-এ আমরা গণিকা কালিকে পাচ্ছি। এ কাহিনি থেকে আমরা জানতে পারি তৎকালীন সমাজে গণিকাদের অন্য এক অবস্থানের কথা। এ সময়ে গণিকার প্রাপ্য যে অর্থ লাভ সে লাভ করবে তার অর্ধেকটা সে নিজে নেবে, বাকি অর্ধেকটা সে খরচ করবে রসসন্ধানী প্রেমিকদের জন্য গন্ধদ্রব্য, পোশাক, ফুলের মালা ইত্যাদির জন্য। সে পুরুষপ্রবর নিজের পোশাক খুলে গণিকার দেওয়া দ্রব্যাদি ব্যবহার করবে এবং অবশ্যই গৃহ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সেইসব পোশাকাদি খুলে রেখে পুনরায় নিজ পোশাকাদি পরে যেতে হবে। গণিকা কালি ধনসম্পদশালী ছিল কি না জানা না-গেলেও তাঁর ভাই তুণ্ডল্ল যে খুবই গরিব ছিল সেটা এক কাহিনি থেকে জানা যায়। তুণ্ডল্লর দারিদ্রতা ঘোচাতে গণিকা কালির দেওয়া মহার্ঘ পোশাকাদি নিয়ম ভেঙে তুণ্ডল্লকে দিয়ে দেয়। এতে গণিকা কালি যারপরনাই অপমানিত বোধ করে। কালি উচিত শিক্ষা দিতে চায় সেই প্রেমিক-পুরুষকে। প্রেমিক-পুরুষটি তুল্লকে পোশাকাদি দান করে এসে যখন নিজের পোশাক কালির কাছে কামনা করে, তখন গণিকা কালি প্রত্যাখ্যান করে এবং তাঁর ভৃত্যদের সাহায্যে সেই প্রেমিক-পুরুষকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থাতেই ঘরের বাইরে বের করে দেয়।
আম্রপালী, বসন্তসেনা, শ্যামা, বাসবদত্তা প্রমুখ গণিকারা এমনই চারিত্রিক মহিমায় উদ্ভাসিত যে, তাঁরা একালের কবি-সাহিত্যিকের কাছে অনুপ্রেরণার বিষয়। এককথায়, প্রাচীন সাহিত্যের এই গণিকারা সুদীর্ঘকাল অতিক্রম করে একেবারে একালের আঙিনায় এসে ঠাঁই করে নিয়েছে এবং আগামী দিনেও হয়তো লেখকরা অনুপ্রাণিত হবেন নতুন সাহিত্য সৃষ্টিতে।
মোট কথা, প্রাচীন সাহিত্যে গণিকার উপস্থিতি নেই এমন কোনো সাহিত্যই নেই। যেমন ভোজদেব রচিত শৃঙ্গারমঞ্জরী কথা’, মহেন্দ্র সূরী রচিত ‘নিন্নয় সুন্দরী কথা’, সোমেশ্বর রচিত ‘মানোসসাল্লাস’, দামোদর গুপ্ত রচিত ‘কুট্টিনীমত’, কলহন মিশ্র রচিত ‘রাজতরঙ্গিনী’, দণ্ডি রচিত ‘দশকুমারচরিত’, গুণাঢ্য রচিত ‘বৃহকথা, বাসুদেব হিন্ডি রচিত শ্লোকসংগ্রহ’, কুমার ইলাঙ্গো আদিগল রচিত ‘শিলপ্লাদিকর’ প্রভৃতি গ্রন্থে ভিন্নধর্মী বহু গণিকার কীর্তিকলাপ সুগ্রথিত হয়েছে। এ সময় ব্যাবসা-বাণিজ্য, অর্থ-সম্পদ, বিলাস-ব্যসনে মনুষ্যজীবন সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছিল। আর কে না জানে জীবনে সার্বিক উন্নয়ন ঘটে গেলেই বিলাসিতার অঙ্গ হিসাবে গণিকা সঙ্গের প্রয়োজন হয়ে পড়ে! কায়ণ অর্থ-সম্পদ-শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের স্থূল কামনা-বাসনার তো জাগরণও ঘটতে থাকে। সে যুগে তো সর্বস্তরের মানুষের গণিকাপ্রীতি ছিল। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল শিল্প সাহিত্য-সংস্কৃতিতে। কে নেই, বৌদ্ধভিক্ষু থেকে শুরু করে নগররক্ষী, রাজা-মহারাজা থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পর্যন্ত সকলেরই গণিকাপ্রীতি বিস্ময়ের উদ্রেগ করে, বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়। সে সময় গণিকালয়গুলি এখনকার এঁদো-পুতিগন্ধময় ছিল না, গণিকালয় বা গণিকাগৃহগুলি ছিল সুরভিত, কুসুমাস্তীর্ণ, সুসজ্জিত এবং নান্দনিক–সবসময়। গণিকারাও সামাজিক মর্যাদার অধিকারিণী এবং ধনসম্পদশালী ছিল।
০৭. দেবদাসীর অন্য নাম গণিকা
দাসপ্রথারই একটা বিশেষ দিক এই দেবদাসী প্রথা। বিজয়ী জাতি বিজিত জাতিদের দাসে পরিণত করত। পুরুষ বন্দিরা দাস, নারীরা হত দাসী। দাসদের নিয়ে কী করা হত, সে বিষয়টি এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। তবে বিজিত বন্দি নারীরা হতেন ভোগের বস্তু। লালসা নিবৃত্তির যন্ত্র মাত্র। দাসত্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছেন নারী। অসম্মানিত হয়েছেন চরমভাবে। তাঁদের শরীর তাঁদের অধিকারে ছিল না। সেই অধিকার ছিল ভোগীদের। হাটে বিক্রি হত নারী। সেই হাটে নগ্ন করে দেখা হত নারী-শরীর। পছন্দ হলে ক্রেতারা ভোগের জন্য নিয়ে যেত। নারীদেহ চিরদিনই ভোগের সামগ্রী। বিংশ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে এসেও এই পণ্য ব্যাবসায় ভাটা পড়েনি। এখান থেকেই শুরু হল দেবদাসীর চর্চা। এটি একটি ঘৃণিত প্রথা। ধর্মের মোড়কে বেশ্যাবৃত্তির মহান স্বীকৃতি। এরা নিতান্তই ভোগসুখের উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হল মেয়েরা। রাজা, রাজপুরুষ মায় পুরোহিতদের যৌন-মনোরঞ্জন করাই হল এঁদের অবশ্য কর্তব্য। পুরোহিতদের পৌরোহিত্যেই এই পবিত্র’ প্রথা যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে। আর এই যৌন-মনোরঞ্জনের আয়োজন হয় মন্দির বা দেবালয়ে। দেবতার নামে চলে নারীমাংসের উৎসব। শুধু ভারতেই নয়, এই প্রথা সারা বিশ্বজুড়ে চলে নানা মুখোশে, নানা রূপে। তবে ভারতে এই প্রথা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল।