শ্ৰীমান উপগুপ্তের কাছে এ বার্তা পৌঁছোলে তিনি মনে মনে ভাবলেন—এটা প্রলোভন। এই প্রলোভনে জড়িয়ে পড়া মানে আত্মাহুতি দেওয়া। এই আত্মাহুতি তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। বৈরীহীন নৈম্যের বিদ্যমানে শত্রুবহুল কামাসক্তিতে কী প্রয়োজন? বাসবদত্তার মতিভ্রম হয়েছে। বাসবদত্তা কামান্ধা। অতএব এহেন পরিস্থিতিতে তাঁকে উপায়-কুশলতা অবলম্বন করতে হবে। শ্রীমান উপগুপ্ত দূতী তপতীকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন–“এখন তাঁর সঙ্গে দেখা করার সময় নয়। উপযুক্ত সময় হলে আমি নিজেই তাঁর সঙ্গে দেখা করে নেব।” এই কথা শুনে তপতীকে বিফল মনোরথেই ফিরে যেতে হয়।
মনোবাঞ্ছা পূরণ হল না, এটা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না বাসবদত্তা। মন অশান্ত হয়ে উঠল। রূপবান উপগুপ্তকে যে ভোলা যায় না! ধীরে ধীরে সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায়। কিন্তু বাসবদত্তা যে একজন গণিকা। গণিকামাত্রেই দেহ-ব্যবসায়ী। দেহই তাঁর পুঁজি। উপগুপ্তকে লাভ করা গেল না তাতে কী হয়েছে! সবাই তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবে কেন? বরং সকলে তাঁদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবে তাঁর শরীর ভোগ করে। তাই বাসবদত্তার চাই নতুন পুরুষ। উপগুপ্তের জন্য আর অপেক্ষা না করে এক অশ্ব-ব্যবসায়ীর বাহুলগ্না হল। সেই অশ্ব-ব্যবসায়ী অগ্রিম ৫০০ স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে তাঁকে পেতে চাইল। বাসবদত্তা প্রলুব্ধ হয়ে সেই ব্যবসায়ীকে নিজগৃহে ডেকে পাঠায়। ব্যবসায়ী এলেন বটে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু বাসবদত্তার হাতেই হল। ব্যবসায়ীর ধনরত্ন আত্মসাৎ করার লোভে তাঁকে হত্যা করে শৌচাগারে লুকিয়ে রাখে। এ খবর রাজার কানে পৌঁছে যায়। রাজা অপরাধের শাস্তিস্বরূপ বাসবদত্তার হাত-পা-নাক কেটে নগরের বাইরে শ্মশানে ফেলে আসার নির্দেশ দিলেন। মৃত্যুপথযাত্রিনী বাসবদত্তার সঙ্গে উপগুপ্তের শেষ দেখা হয়েছিল।
শলাবতী : বৌদ্ধসাহিত্যে ‘মহাবজ্ঞ’-এর এক জায়গায় শলাবতী নালী এক গণিকার কথা জানা যায়। সে রাজগৃহের প্রধানা গণিকা। যাঁর এক রাতের মূল্য ছিল ৫০০ কার্যপণ। সে একটা সময় গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় শলাবতী খরিদ্দারদের কাছে মিথ্যা কথা বললেন। বললেন–তাঁর শরীর খারাপ। কটাদিন তিনি বিশ্রাম চান। অবশেষে শলাবতীর সন্তান ভূমিষ্ঠ হল এবং সেই সন্তানকে আবর্জনার স্তূপে নিক্ষেপ করেন। সেই পতিত সন্তানকে আর-এক গণিকা আম্রপালীর পুর আভয় তাকে কুড়িয়ে নিয়ে লালনপালন করতে থাকে। পরে সেই পতিত সন্তান বড়ো হয়ে জীবক কুমারভৃত্য নাম ধারণ করে বিখ্যাত চিকিৎসক হিসাবে স্বীকৃত পেয়েছিল।
অদ্ধকাশি বা অর্ধকাশি : বৌদ্ধসাহিত্যে আর-এক গণিকা অদ্ধকাশিকেও পাচ্ছি। অদ্ধকাশি এতটাই রূপবতী ছিলেন যে সেই রূপের গর্বে তাঁর কাছে আসা পুরুষদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করত। তাঁর গুণমুগ্ধ পুরুষের সংখ্যা প্রচুর থাকলে ক্রমশ সেই সংখ্যা কমতে থাকল অদ্ধকাশির মাত্রাতিরিক্ত দাবি মেটাতে না পেরে। আয়ও ক্রমশ কমতে কমতে অদ্ধকাশি কপর্দকহীন হয়ে পড়ল। অবশেষে শেষ আশ্রয় হিসাবে বুদ্ধের শরণাপন্ন হল।
কাশিসুন্দরী : বৌদ্ধসাহিত্য ব্ৰতীবদানমালা’-য় গণিকা কাশিসুন্দরীকে পাই। কাশিসুন্দরী প্রথম জীবনে মহারাজ অজাতশত্রুর মন্ত্রী প্রচণ্ডকে প্রত্যাখ্যান করে। প্রচণ্ডের পরিবর্তে তিনি সুবর্ণকে পছন্দ করেন। কিন্তু সুবর্ণ গণিকা কাশিসুন্দরীকে পছন্দ করে না। কাশিসুন্দরীও নাছোড়বান্দা। সুবর্ণ একথা জানতে পেরে কাশিসুন্দরীকে এমন মার মারে যে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। অজ্ঞান কাশিসুন্দরীকে এক বিষধর সাপের কাছে ফেলে দেয়। সেই সাপের দংশনে কাশিসুন্দরীর মৃত্যু হয়। সুবর্ণর অবশ্য সেই অপরাধে রাজার আদেশে মৃত্যুদণ্ড হয়।
শ্যামা : বৌদ্ধসাহিত্যে ‘কানবের জাতক’ ও ‘মহাবস্তু অবদান’ গ্রন্থে শ্যামা নামে এক গণিকার কথা জানতে পারি। শ্যামা ছিল বারাণসীর শ্রেষ্ঠতম গণিকা। বসন্তসেনা ও বাসবদত্তাদের প্রচুর কাব্য-সাহিত্য-নাটক রচিত হলেও শ্যামা প্রায় উপেক্ষিতাই রয়ে গেছে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গণিকা শ্যামাকে মনে রেখেছেন তাঁর রচিত নৃত্যনাট্য শ্যামা’ এবং কবিতা পরিশোধ’-এর মধ্য দিয়ে। তক্ষশীলার বজ্রসেন নামে এক ঘোড়া ব্যবসায়ী ঘোড়া বিক্রি করতে আসে বারাণসীতে। কিন্তু কপালমন্দে তাঁকে নগররক্ষীরা চোর সন্দেহে রাজার কাছে ধরে নিয়ে যায়। চুরি করার অভিযোগে রাজা বজ্রসেনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বজ্রসেনকে বদ্ধভূমিতে নিয়ে যাওয়ার সময় গণিকা শ্যামার নজরে পড়ে যায়। রূপবান বজ্রসেনকে দর্শন করে শ্যামা মুগ্ধ হয়ে যায়। রূপবান বজ্রসেনকে যে শ্যামার চাই! মনে মনে তাঁকে যে প্রেমিক হিসাবে বরণ করে নিয়েছে। বজ্রসেনকে মুক্ত করতেই হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। নগররক্ষীদের প্রচুর ধনসম্পদ ঘুষ দিয়ে বজ্রসেনকে মুক্ত করে নিজগৃহের শয্যায় আহ্বান করে আনে। কিন্তু বজ্ৰসেন শ্যামার প্রেমের প্রতিদান দিতে পারেনি। সে যে প্রকৃতই তস্কর। শ্যামার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রচুর মদ্যপান করিয়ে শ্যামার সমস্ত ধনসম্পদ লুঠ করে পালিয়ে যায়। বেহুস শ্যামাকে বারাণসীর ঘাটে ফেলে রেখে যায়। এত কিছুর পরেও বজ্রসেনের প্রতি শ্যামার প্রেমের ঘোর কাটল না। বজ্রসেনকে সে যেনতেনপ্রকারেণ কাছে পেতে চায়, উপভোগ করতে চায়। অতএব শ্যামার ঘনিষ্ঠ এক ভিক্ষুণীকে তক্ষশীলার পাঠিয়ে দেয় বজ্রসেনকে ফিরিয়ে আনতে।