বসন্তসেনা : প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বসন্তসেনা’ কবিতায় লিখছেন–“তুমি নও রত্নাবলী, কিম্বা মালবিকা, রাজোদ্যানে বৃন্তচ্যুত শুভ্র শেফালিকা।/ অনাঘ্রাত পুষ্প নও, আশ্রমবালিকা,/ বিলাসের পণ্য ছিলে, ফুলের মালিকা’রঙ্গালয় নয় তব পুষ্পের বাটিকা, অভিনয় কর নাই প্রণয়-নাটিকা।/ তব আলো ঘিরে ছিল পাপ কুঙ্কুটিকা, ধরণী জেনেছ তুমি মৃৎ-শকটিকা!/নিষ্কণ্টক ফুলশরে হওনি ব্যথিতা।/ বরেছিলে শরশয্যা, ধরায় পতিতা।/কলঙ্কিত দেহে তব সাবিত্রীর মন/সারানিশি জেগেছিল, করিয়ে প্রতীক্ষা/বিশ্বজয়ী প্রণয়ের, প্রাণ যার পণ।/ তারি বলে সহ তুমি অগ্নির পরীক্ষা!”
বসন্তসেনাকে আমরা পাই খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর নাট্যকার শূদ্রকে মৃচ্ছকটিকে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে প্রদ্যোৎ সাম্রাজ্যের পতনকালে উজ্জয়িনী নামে একটি প্রাচীন ভারতীয় নগরের প্রেক্ষাপটে লেখা, যেখানকার রাজা ছিলেন পালক। চারুদত্ত নামের এক সম্ভ্রান্ত অথচ দরিদ্র ব্রাহ্মণ যুবককে কেন্দ্র করে, যিনি বসন্তসেনা নাম্নী এক গণিকা কর্তৃক প্রণয়াসক্ত হন। পারস্পরিক অনুরাগ সত্ত্বেও তাঁদের বাসস্থান ও ভালোবাসা দুই-ই পথে বসে সমস্থানিক নামে এক কামাতুর (বসন্তসেনার প্রতি) রাজসভাসদের চাতুর্যে। শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক নাটকে বসন্তসেনা একজন গণিকা। কিন্তু বসন্তসেনার শরীর ও মন দুইয়ের সমন্বয়ে এ নাটকে দেখানো হয়েছে। শ্ৰেষ্ঠী চারুদত্তকে ভালোবাসেন বসন্তসেনা। এই চারুদত্তের সংকটে বসন্তসেনা তাঁর সমস্ত গয়না সমর্পণ করেছেন। এটা শরীরের সম্পর্ক নয়, মনের সম্পর্ক।
আম্রপালী বা অম্বপালী : বৈশালীর রাজোদ্যান নামক স্থানে আমগাছের নিচে এক সদ্য জন্মানো মেয়ে শিশুর কান্নার আওয়াজ ওঠে। নগরের উদ্যান পালক শ্রীনাথ ও তাঁর পত্নী হরিবালা সেই শিশুকে উদ্ধার করে তাঁর ভরণপোষণের ভার গ্রহণ করেন। পালিভাষায় আমকে ‘অম্ব’ বলা হয়। আমগাছের নিচে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন বলে এই নামই রাখা হয়েছিল। আদান পালকের কন্যা বলেও তাঁর নাম হয় অম্বপালী বা আম্রপালী। পরিত্যক্ত কন্যাশিশুকে সেই দম্পতি নিজ সন্তানস্নেহে বড়ো করতে থাকেন। কিন্তু সেই বালিকা কৈশোরে পা দিতে না দিতেই নিদারুণ সমস্যায় পড়লেন বাবা ও মা। অসামান্যা সুন্দরী আম্রপালীকে নিয়ে বড় চিন্তায় পড়ে গেলেন তাঁর বাবা ও মা। আম্রপালীর রূপের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মরে যেতেও সুখ কামুক পুরুষরা। সবারই কাঙ্খিত নারী সে। গ্রামের মহাজন থেকে শুরু করে শহরের বণিক, জনপদের রাজা থেকে শুরু করে নগরের শ্রেষ্ঠী—কে নেই সেই তালিকায়! বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বীয় দেহের ক্রমবর্ধনশীল রূপ-যৌবনে টলটলে আম্রপালী নিয়ে যেন যুদ্ধ বেধে গেল।
বিশ্বের প্রাচীন গণতন্ত্রের মধ্যে বিখ্যাত বৈশালী। সেখানে রাজা নির্বাচিত হতেন নির্বাচনের মাধ্যমে। ছিল না পরিবারতন্ত্র, যোগ্য হলে তবেই নির্বাচিত হয়ে সিংহাসনে বসার সুযোগ মিলত। কথিত আছে, বৈশালীর এক রাজা মনুদেব হত্যা করেছিলেন আম্রপালীর বাল্যপ্রেমিক পুষ্পকুমারকে। সে রাতেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল আম্রপালী ও পুষ্পকুমারের। এরপর শুরু হয় তুমুল দ্বন্দ্ব, জনতার ইচ্ছার সভা বসে বৈশালী সংসদে। গণতন্ত্র বিধান দেয়, আম্রপালী কোনোদিনও বিয়ে করতে পারবেন না। কারণ এত রূপ-যৌবন নিয়ে তিনি কোনো একমাত্র পুরুষের ভোগ্যা হতে পারে না। আজব বিধান বইকি! গণতন্ত্রের শৃঙ্খলায় সেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। সুন্দরী হওয়ার অপরাধে আম্রপালী হয়ে গেলেন বৈশালীর গণিকা, বহু পুরুষের ভোগ্যা। আম্রপালী হলেন রাজ্যের সভানর্তকী। তিনি হলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী, অভিজাত আদবকায়দায় রপ্ত এক সুন্দরী। সকল পুরুষ নয়, কেবলমাত্র উচ্চবংশের পুরুষই পেতে পারবে তাঁর কাছ থেকে যৌনসুখ। আম্রপালী নিজেই নিজের সঙ্গী নির্বাচন করতে পারবেন ভোগের জন্য। জেনে বিস্মৃত হবেন, গণিকা আম্রপালীকে দৃষ্টান্ত রেখে সেই আমলে বৈশালীতে নতুন একটা আইনও তৈরি হয়ে গেল। কী সেই আইন? কোনো অনিন্দ্য সুন্দরী নারী কখনো বিবাহ করতে পারবে না। তাঁকে বহু পুরুষের ভোগ্যা হয়ে যৌনানন্দ বিলিয়ে দেওয়ার জন্য উৎসর্গীকৃত হতেই হবে। তবে রাজগণিকা হওয়ার সুবাদে আম্রপালীর জন্য বরাদ্দ হয়েছিল সুবিশাল উদ্যান, মর্মর অট্টালিকা। ক্রমে আম্রপালী হয়ে উঠলেন প্রভুতা ক্ষমতার অধিকারিণী।
যাই হোক, মগধরাজ বিম্বিসার আম্রপালীর রূপের সংবাদ পেরে সেই রূপের আগুনে একটিবার ঝাঁপ দিতে চাইলেন। কিন্তু কী উপায়ে আম্রপালীকে অঙ্কশায়িনী করা সম্ভব? বৈশালী আর মগধ রাজ্যের মধ্যে তো ছিল পরস্পরের ঘোর শত্রুতা। শত্রুপক্ষের গণিকার কাছে তো আর কামাতুর হয়ে যাওয়া যায় না, আবার শত্রুরাজার কাছে নতজানুও হওয়াও যায় না। অতএব যুদ্ধ। রাজ্য ও রূপবতী গণিকা–দুইয়েরই দখল নেওয়া যাবে। মগধরাজ বিম্বিসার বৈশালী আক্রমণ করলেন ছদ্মবেশে আম্রপালীর প্রাসাদে সোজা ঢুকে গেলেন। ছদ্মবেশী সঙ্গীতজ্ঞ বিম্বিসারের গুণে আম্রপালী যেন ভেসে গেলেন। কিন্তু আম্রপালী যখন জানতে পারল এই ছদ্মবেশী বিম্বিসারই সাজানো বৈশালী তছনছ করে দিয়েছে, আম্রপালী দৃঢ়ভাবে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। শুধু প্রত্যাখ্যান নয়, সেইসঙ্গে বিম্বিসারকে শর্ত দিলেন তাঁকে অঙ্কশায়িনী করতে হলে বৈশালীকে মুক্ত করে দিতে হবে। আম্রপালীর অনমনীয়তায় বিম্বিসার অবশ্যই বৈশালীকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই ব্যাপারটা বিম্বিসারের দুর্বলতা বলে ধরে নিয়েছিল শত্ৰুভূমি বৈশালীরাজ। ফলে দুই রাজ্যের দ্বন্দ্ব আটকানো সম্ভব হল না। বিম্বিসার আম্রপালীকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন আম্রপালী। তবে বিয়ে না হলেও বিবাহ-বহির্ভূত তাঁদের এক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। সেই সম্পর্কের জেরে তাঁদের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। এরপর তিনি ফিরে যান নিজের রাজ্য মগধে।