‘International Encyclopedia of Social’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে–সমাজ গণিকাবৃত্তিকে ঘৃণার চোখে দেখলেও এর বিলুপ্তির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। কারণ কতগুলো সামাজিক কাজ এটি করে থাকে। ফলে সমাজে ধর্ষণ প্রবণতাও হ্রাস পায়। বিবাহ ছাড়া যৌনক্ষুধার মতো মৌলিক ও জৈবিক চাহিদা পূরণের সুযোগ শুধু গণিকারাই দিয়ে থাকে। এভাবে যৌনকর্মীরা নিজের জীবনজীবিকার সঙ্গে সঙ্গে পরোক্ষ উপকারও করছে সমাজের। আসলে গণিকাবৃত্তি ছাড়াও অসংখ্য ‘নিকৃষ্ট’ পেশা আমাদের সমাজে টিকে আছে মানুষেরই স্বার্থের জন্যে। এইসব ইতিবাচক প্রভাব এবং সমাজের পরোক্ষ উপকারের জন্যই সমাজের ঘৃণিত প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও বিলুপ্ত করা হয়নি, হবেও না। তাই গণিকাবৃত্তির অনুমোদনে সরাসরি কোনো আইনের অস্তিত্ব না-থাকলে পরোক্ষভাবে গণিকাবৃত্তির অস্তিত্ব মেনে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মতো বেশ কিছু দেশে আবার ১৮ বছরের উপরের যুবতীদের এফিডেভিটের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় গণিকাবৃত্তি গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। থাইল্যান্ডের সরকার পর্যটন পরিকল্পনার আওতায় গণিকাবৃত্তিকে ‘জাতীয় শিল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার পর এমন হয়েছে যে, সেই দেশের সব মেয়েকেই মনে করা হয় যৌনকর্মী। ফলে রাস্তায় দাঁড়ানো যে-কোনো মেয়ের কাছে গিয়ে পর্যটকরা বলা আরম্ভ করল, তাঁর সঙ্গে মেয়েটি শোবে কি না!
নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, আর্জেন্টিনা, আর্মেনিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলিজ, লাটভিয়া, বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার কিছু অংশ আছে, যেখানে গণিকাবৃত্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত নীতিগুলি আরও উদার। সেসব দেশে বেশ কয়েকটি বৈধ গণিকালয়ও আছে। তবে উত্তর কোরিয়া, সুদান, ইরান এবং সৌদি আরবের মতো দেশও আছে, যেখানে গণিকাবৃত্তি একটি গুরুতর অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয় এবং যদি দোষী সাব্যস্ত হয়—শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তাই বলে সেখানে গণিকাবৃত্তি সেখানে বন্ধ আছে? গণিকাবৃত্তি বৈধকরণ সম্পর্কিত ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে কোনো মিল নেই। অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও গৃহযুদ্ধের কারণে সামাজিক ভাঙন এবং দারিদ্র্যের কারণে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে গণিকাবৃত্তি পরিচালিত হয়। গণিকাবৃত্তি ভারত, নেপাল, ভুটান এবং পাকিস্তানে অবৈধ, তবে এখনও বিভিন্ন ছদ্মবেশে চলছে। এশীয় দেশগুলির মধ্যে থাইল্যান্ডে যৌন পর্যটন বেশ জনপ্রিয়।
বিশ্বের বহু দেশেই গণিকাবৃত্তি বৈধ এবং সেখানে যৌনকর্মীরা নিয়মিত আয়করও দেন। হল্যান্ডে পর্যটকদের মূল আকর্ষণই এই ‘গণিকাপল্লি’, পুরোপুরি বৈধ। ইউরোপের এই দেশটির গণিকাপল্লি সত্যিকার অর্থেই বিশ্ববিখ্যাত। ওই ‘রেডলাইট জোন’ দেখতে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারো পর্যটক আসে আমস্টারডামে। নেদারল্যান্ডসের মতো ইউরোপের আর-এক দেশ বেলজিয়ামেও দেহ-ব্যাবসা সম্পূর্ণ বৈধ। জার্মানি এবং ফ্রান্সে বৈধ হলেও কঠোর, সেক্ষেত্রে যৌনকর্মীদের মানতে হয় কঠোর আইন। জার্মানির কিছু শহরে যৌনকর্মীরা রাস্তায় নেমে ক্লায়েন্টদের ডাকতে পারে না। ফ্রান্সেও ২০১৪ সালে এমন একটা আইন হয়েছে, যা মেনে যথেচ্ছ দেহ-ব্যাবসা করা খুব কঠিন। সুইডেন আর নরওয়েতেও নিয়ন্ত্রিত গণিকাবৃত্তি। ফ্রান্সের ২০১৪ সালের আইনটি প্রথম চালু হয়েছিল, সুইডেনে ১৯৯৯ সালে। এই কারণে আইনটি ‘সুইডিশ মডেল হিসাবে পরিচিত। এ আইনে যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষা করে দালালদের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ায় যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা বাধ্যতামূলক। তবে এই দুটি দেশে ১৯ বছর বয়স না-হলে কেউ দেহ-ব্যাবসায় আসতে পারেন না। যৌনকর্মীদের যাতে কোনো যৌনরোগ না-হয় কিংবা তাঁদের মাধ্যমে ক্লায়েন্টদের মধ্যে যাতে এইডস, সিফিলিস বা অন্য কোনো যৌনরোগ ছড়াতে না-পারে, তা নিশ্চিত করতে যৌনকর্মীদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে হয়। অবশ্য শুধু সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়াতে নয়, জার্মানিতেও ওই একই নিয়ম। গ্রিস ও তুরস্কেও গণিকাবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত। গ্রিস এবং তুরস্কেও গণিকাবৃত্তি পুরোপুরি বৈধ। তবে দেহ-ব্যাবসার আইন। খুব কঠিন। জার্মানির মতো এই দুটি দেশেও যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যবিমা করা বাধ্যতামূলক। এছাড়া যৌনকর্মীরা নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করায় কি না, তা সবসময় তদারক করা হয়। স্বাস্থ্যকার্ডেই লেখা থাকে স্বাস্থ্যপরীক্ষার সব তথ্য। দক্ষিণ আমেরিকায় অধিকাংশ দেশেই যৌন-ব্যাবসা বৈধ। তবে কিছু দেশে মাফিয়া এবং মানব পাচার বড়ো সমস্যা হয়ে ওঠায় এই ব্যাবসার উপর কড়া নজর এবং তদারকি বেড়েছে। দেহ-ব্যাবসাকে মাফিয়া চক্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখতে ব্রাজিল এবং মেক্সিকোতে আছে কঠোর আইন। তারপরও দেশ দুটিতে মাফিয়া চক্রের আধিপত্য থেকে গেছে। প্রতিবেশী হয়েও নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার আলাদা নিয়ম, নিউজিল্যান্ডে যৌন ব্যাবসা একেবারেই বৈধ। তবে প্রতিবেশী দেশ অস্ট্রেলিয়ার অনেক রাজ্যে এই ব্যাবসা এখনও অবৈধ। ২০০৩ সালে আইন করে সব প্রাপ্তবয়স্কের জন্য যৌন-ব্যাবসাকে বৈধ করে দেয় নিউজিল্যান্ড।
আমার এই ‘গণিকা-দর্শন’ গ্রন্থে বিশ্বদর্শনের যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি। সমাজের সব শ্রেণির যৌনকর্মীদের নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছি। তুলে আনার চেষ্টা করেছি গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণিকাবৃত্তির ইতিহাস ও বর্তমান বহমানতা। যৌনপেশা কারা করে? কেন করে? কারা যায় যৌনকর্মীর কাছে? কেন যায়? যৌনকর্ম কি বৈধ করা উচিত? কেন উচিত নয়? কেন অনুচিত? সমস্ত দূরহ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি এই গ্রন্থে। বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে গণিকাবৃত্তির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে। যৌনকর্মীদের অন্দরমহলের কথা উঠে এসেছে। উঠে এসেছে তাঁদের জীবন-যৌবন-অর্থের কথাও। চমকে যাওয়ার মতো অনেক তথ্য উঠেছে, যা আগে কখনো কেউ বলেনি। এই গ্রন্থ কেবলমাত্র তথ্যের ঘনঘটা নয়, এটি একট ওয়ার্কশপ। মাঠে নেমে সংশ্লিষ্ট মানুষের সঙ্গে কথা বলে তুলে এনেছি মানুষের কথাই। যৌনপল্লিতে ঘুরে ঘুরে শুধু অন্ধকার খুঁজিনি, খুঁজেছি আলোর রশ্মিও। যৌনপল্লিগুলির বাইরেও আছে দেহ বিক্রেতাদের বৃহৎ বাজার। সেখানেও পৌঁছে গেছি ছলে-বলে-কৌশলে। সহজ কাজ ছিল না। পৌঁছে যেতে পেরেছি পুরুষ। যৌনকর্মীদের কাছেও। সর্বোপরি এটা বলে রাখা প্রয়োজন, এই গ্রন্থটি শুধুমাত্র প্রাপ্তমনস্কদের জন্য পাঠযোগ্য বলেছি। তার কারণ এই গ্রন্থে এমন অনেক বর্ণনা আছে এমন অনেক বিষয় আলোচিত হয়েছে, যা কখনোই অপ্রাপ্তমনস্কদের পাঠ্য নয়।