গুপ্তসাধনতন্ত্রে বলা হয়েছে গণিকারা শক্তিরূপে পরিগণিত হওয়ার যোগ্য। তান্ত্রিক সাধনায় এই শক্তির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তন্ত্রসাহিত্যের সৃষ্টি মূলত এক ধর্মীয় গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করেই, সে ধর্মগোষ্ঠী সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য মদ্য, মাংস, মৎস, মুদ্রা ও মৈথুন–এই পঞ্চ ম-কারে বিশেষ প্রাধান্য দিত। এই সাধনা চলত গণিকাদের উপর। আদিরস বা যৌনক্রিয়াকলাপ ছিল তাঁদের প্রধান উপজীব্য। গুপ্তসাধনতন্ত্রে গণিকাদের পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে—(১) রাজগণিকা বা নাগরী, এঁরা শহর বা নগরে বিচরণকারী গণিকা, (২) গুপ্তগণিকা, এঁরা সম্মানিত পরিবারে থেকে গোপনে গণিকাবৃত্তি করে। (৩) দেবগণিকা, এঁরা মন্দির বা দেবালয়ে গণিকাবৃত্তি করে। এঁদের প্রচলিত পরিচয় ‘দেবদাসী’। এঁদের বিষয়ে পরে অন্য অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। (৪) ব্ৰহ্মগণিকা, তীর্থস্থানে ঘুরে ঘুরে গণিকাবৃত্তি করেন।
ধর্মীয় সংস্কার-আচার-প্রথাও পবিত্র পতিতা’-র জন্ম দিয়েছে। লোকজীবনে দেহসাধনায় নামে যে অবাধ যৌনাচার চলে আসছে, তাতে ভণ্ড পির, কামুক সাধু কিংবা বৈরাগী-বৈষ্ণবী আখড়াও বাদ যায় না। নিরুত্তরতন্ত্রে আবার গণিকাদের ছয়ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন–(১) গুপ্তগণিকা—এঁরা সাধারণত তন্ত্রসাধক বা তান্ত্রিকদের বংশজাতা হয়। এঁরা স্বভাবে নির্লজ্জ এবং অত্যধিক কামাসক্ত হন। এঁরা পশুভাবাপন্ন পুরুষই পছন্দ করেন। (২) মহাগণিকা—এঁরা স্বেচ্ছায় শরীরের পোশাক ত্যাগ করে গোপন অঙ্গ প্রদর্শন পুরুষকে যৌনকর্মে আহ্বান করে (৩) কুলগণিকা–এঁরা স্বামীসন্তান নিয়ে সংসারধর্ম করেন এবং পাশাপাশি গণিকাবৃত্তিও করেন। (৪) রাজগণিকা—এঁরা স্বাধীনভাবে শহরের ভিতর পুরুষের সন্ধানে বিচরণ করে এবং রাজার মতোই আচরণ করে। (৫) ব্ৰহ্মগণিকা এবং (৬) মহোদয়া। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে এইসব গণিকারা এক একটি তীর্থতুল্য। যেমন গুপ্তগণিকাদের বলা হয়েছে অযোধ্যা তীর্থতুল্য, মহাগণিকাদের বলা হয়েছে মথুরা তীর্থতুল্য, কুলগণিকাদের বলা হয়েছে মায়া তীর্থতুল্য, রাজগণিকারা দ্বারকা তীর্থতুল্য ও অবন্তী তীর্থতুল্য, ব্ৰহ্মগণিকারা দ্বারাবতী তীর্থতুল্য এবং মহোদয়া গণিকারা কালিকা তীর্থতুল্য।
নিরুত্তরতন্ত্রেই বলা বলা হয়েছে–“স্ত্রী পুংসো সঙ্গমে সৌখং জায়তে তং পরমং পদ”। অর্থাৎ, স্ত্রী ও পুরুষের যৌনমিলনে বা সঙ্গমে যে আনন্দ, তাই-ই পরমপদ বা ব্রহ্ম। সেই কারণেই তন্ত্রসাধনায় পঞ্চ ম-কারের এত আয়োজন। বলা হয়েছে–“বিনা পীত্বা সুরাং ভুক্কা মৎস্যমাংসং রজস্বলাং/যো জপে দক্ষিণাং কালীং তস্য দুঃখ পদে পদে”। অর্থাৎ, যে বিনা মদ্যপানে, বিনা মাছমাংসে, বিনা যুবতী সম্ভোগে যে দক্ষিণা কালীর আরাধনা করবে, তাঁর পদে পদে দুঃখ হবে।
ষষ্ঠ শতকের লেখক বিষ্ণুশর্মার পষ্ণতন্ত্রে বেশ কিছু কাহিনিতে তৎকালীন সময়ের গণিকাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। আছে দেবদাসীদের কথাও। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায় সে সময় গণিকারা প্রভূত ক্ষমতা ভোগ করত এবং প্রচুর সম্পদের অধিকারিণী ছিল। রবিচন্দ্রের অমরুশতকেও গণিকাদের কথা জানা যায়। অমরুশতকের কাহিনি ও চরিত্রের কাঠামো থেকেই অনুমিত হয় সে সময়ের গণিকাদের উপস্থিতি ছিল অবাধ। সপ্তম শতকে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে সভাকবি বাণভট্টের কাদম্বরী থেকে জানা যায় স্নানের পর রাজাদের গায়ে চন্দন, আতর, কুমকুম প্রভৃতি মাখিয়ে দিত গণিকারা। রাজাদের পোশাকও পরিয়ে দিতে হত। দ্বাদশ শতকের গ্রন্থ মৃন্ময়সুন্দরীকথাতে দেখি গণিকার আয়ের শতকরা পাঁচশো থেকে ত্রিশ ভাগ ছিল রাষ্ট্রের প্রাপ্য অর্থাৎ রাজস্ব। বৌদ্ধগ্রন্থে গণিকার ‘ভট্টি’ (সংস্কৃত ‘ভূতি’) অর্থাৎ বেতন এবং পরিব্বায়’ (সংস্কৃত পরিব্যয়ম) খরচের উল্লেখ পাই। মথুরার গণিকা বাসবদত্তার পারিশ্রমিকও অত্যন্ত উচ্চহারের ছিল। রাজগৃহের সালাবতী প্রতি রাত্রে একশো কার্যপণ উপার্জন করত।
শাস্ত্রের পাশাপাশি ইতিহাসের সাক্ষ্যও দুর্লভ নয়। বাংলার তাম্রশাসন আমলের লেখমালায় সংগীত ও নৃত্যপটিয়সী রাজনটী ওরফে রাজগণিকাদের পরিচয় মেলে। ধর্মীয় আচারের আড়ালেও আবার কখনো কখনো গণিকা ও গণিকাবৃত্তির জীবনযাপন করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। এমন আধুনিক ধর্মগুরু রাম রহিম, রামপাল, স্বামী চিন্ময়ানন্দ, স্বামী নিত্যানন্দ, আশারামের নাম সবাই আজ জেনে গেছেন। কালীঘাটের পটচিত্রে গণিকাসম্ভোগের দৃশ্য আছে, অনেক মন্দিরগাত্রেও উৎকীর্ণ টেরাকোটাতেও এমন দৃশ্য বিরল নয়।
অনেকে মনে করতে পারেন, গণিকারা এমনই সহজলোভ্য পণ্য, যে অর্থ দিলেই হাতের মুঠোয়। এই চিন্তা একালের গণিকাদের প্রযোজ্য হলেও সেকালের গণিকাদের অর্থের হাতছানি করতলগত করা অতটা সহজ ছিল না। এমনই একজন গণিকার নাম হল বসন্তসেনা। হৃদয়বত্তা, ত্যাগ এবং একনিষ্ঠতার সন্ধান যদি করতে হয়, তবে বসন্তসেনাই তার ধারক ও বাহক। বোধহয় এমন মহিমময় গণিকা যুগে যুগে দ্বিতীয়টি সৃষ্টি সম্ভব নয়, যার মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে একই সঙ্গে জায়া-জননী-প্রেয়সীর প্রতিরূপ। বসন্তসেনার নাম যখন উঠল, তখন। বৌদ্ধধর্মে উল্লেখিত গণিকাদের একটু খোঁজখবর নিতে পারি। বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থগুলি থেকে আমি নয়জন গণিকার কথা জানতে পাচ্ছি–বসন্তসেনা, আম্রপালী, বাসবদত্তা, শলাবতী, অদ্ধকাশি বা অর্ধকাশি, কাশিসুন্দরী, শ্যামা, সুলসা ও কালি। আলোচনা করব। তবে তার আগে বলি রামায়ণ ও মহাভারতের রাজঃন্তপুরে গণিকাদের উপস্থিতি লক্ষ করি, ঠিক তেমনি বৌদ্ধকাহিনিতে উল্লেখিত রাজঃন্তপুরে গণিকাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বৌদ্ধসাহিত্য বাত্তাক জাতক’ থেকে জানা যায়, গৌতম বুদ্ধের বিবাগি মনকে সংসারী করতে পিতা শুদ্ধোদন সুন্দরী গণিকাদের নিয়োগ করেছিল। এক কার্তিকের উৎসবে শুদ্ধোদন তাঁর পুত্রকে এক সুন্দরী গণিকার ঘরে পাঠিয়ে দেন। সেই গণিকা তাঁর হাজার ছলাকলা কলাকৌশলেও তাঁর ধ্যানভঙ্গ করতে ব্যর্থ হয় এবং তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে যায়।