সে যুগে গণিকাদের সেনাবাহিনীর সঙ্গেও পাঠানো হত, সেনারা যাতে আমোদ-প্রমোদে সময় অতিবাহিত করতে পারে। রামচন্দ্রের স্বতন্ত্র সেনাবাহিনী, কৌরব ও পাণ্ডবদের সেনাবাহিনীতেও যথেষ্ঠ পরিমাণে গণিকা মজুত রাখা হয়েছিল। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন সময়ে পাণ্ডব শিবিরে শত শত গণিকাদের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল স্বয়ং ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের। এমনকি কৌরব-পাণ্ডবদের যুদ্ধের প্রাক্কালে কৃষ্ণ আসছেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে দূতরূপে, এই সংবাদ পেয়ে ধৃতরাষ্ট্র দ্রুত নির্দেশ দিলেন–কৃষ্ণের অভ্যর্থনায় যেন কোনো ত্রুটি না হয়। অবিলম্বে হাজার হাজার গণিকাদের উত্তমোত্তর বেশভূষা পরিধান করে যেন কৃষ্ণকে আনতে যায়। অতএব স্বয়ং কৃষ্ণও গণিকাদের পেয়ে বিনোদিত হতেন। কাহিনি বিশ্লেষণে এটাই প্রমাণিত হয় যে, রামায়ণ ও মহাভারতের যুগে গণিকাবৃত্তি বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল। মহাভারতের যুগে গণিকাদের রাজকীয় সম্মানে সম্মানিত করা হত। তাঁরা রাজাদের সবসময়ের সঙ্গী। সে সময়ে রাজারা মৃগয়ায় গেলে গণিকাদেরও যেতে হত বিনোদনের জন্যে। সেকালে গণিকাদের যে সম্মান ও মর্যাদা ছিল, সেই সম্মান ও মর্যাদা একেবারে তলানিতে।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে গণিকাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের বর্ণনা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। আমরা এতক্ষণ যেসব গণিকাদের কথা জানলাম তাঁরা রাষ্ট্র-পৃষ্টপোষকতায় হলেও মোটামুটি স্বাধীন। কৌটিল্যের সময়ে এসে দেখতে পাচ্ছি গণিকারা কারোর অধীনে থেকে কাজ করছে। আমরা গণিকাধ্যক্ষের কথা জানতে পারছি, যাঁদের বর্তমান পরিচয় ‘মাসি’ বা ‘মক্ষীরানি’। কৌটিল্যের যুগেও বহু সংখ্যক গণিকা পিছু একজন করে। তত্ত্বাধায়ক বা গণিকাধ্যক্ষ থাকত। তাঁরাই গণিকা সংক্রান্ত নানাবিধ কাজ করত। কারা হতে পারত গণিকাধ্যক্ষ? না, এখনকার মতো বিগতযৌবনা গণিকাদের ‘মাসির মতো গণিকাধ্যক্ষ হতে পারত না। গণিকাধ্যক্ষ একটি রাজকীয় পদ। তাই গণিকাধ্যক্ষদের রীতিমতো রূপবতী, যৌবনবতী ও কলাসম্পন্না রমণী হতে হবে এবং অবশ্যই তাঁকে গণিকা বংশে উৎপন্না অথবা অগণিকা বংশেও হতে হবে। বেতন ছিল ১০০০ পণ। কৌটিল্য গণিকাদের গুণ-রূপ-কাজ অনুযায়ী ভাগও করেছেন। যেমন উত্তম শ্রেণির গণিকা, মধ্যম শ্রেণির গণিকা এবং কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকা। এঁরা সকলেই বেতনভুক্ত শ্রেণি। যেমন উত্তম শ্রেণির গণিকার বেতন ৩০০০ পণ, মধ্যম শ্রেণির গণিকার ২০০০ পণ এবং কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকার ১০০০ পণ। এই বেতন রাজা তথা রাষ্ট্র দিত।
এইসব রূপবতী গণিকাদের যৌবন হারালে কী হত? এখনকার মতোই, অন্যান্য গণিকাদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করতেন সবেতন। বৃত্তিতে থাকতে থাকতে কোনো গণিকার মৃত্যু হলে সেই গণিকার কন্যা বা বোনের গণিকাবৃত্তির অধিকার ছিল। আর গণিকাদের গর্ভে যদি পুত্রসন্তান জন্মত, তাহলে সেই পুত্রসন্তানকে রাজার কাছে দাস হয়ে সারাজীবন কাটাতে হত। কৌটিল্যের যুগে গণিকা এবং খরিদ্দারদের জন্য শাস্তি বা দণ্ডের ব্যবস্থাও ছিল। যেমন–কোনো পুরুষ যদি কোনো গণিকার কুমারীকন্যাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনমিলন ঘটাত, সেই পুরুষের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। রাজ-আজ্ঞা সত্ত্বেও কোনো গণিকা যদি কোনো বিশেষ পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলনে অনিচ্ছা প্রকাশ করত, তাহলে সেই গণিকার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান ছিল। কোনো গণিকাকে অকারণে কোনো পুরুষ যদি হত্যা করে বা গণিকার ঘরে রাত কাটাতে গিয়ে তাঁর অলংকার চুরি করে, তখন সেই অভিযুক্ত পুরুষকে শাস্তির মুখোমুখি হতেই হত। কোনো পুরুষের কাছ থেকে আগাম পারিশ্রমিক নিয়েও যদি কোনো গণিকা যৌনমিলন না করত, সেক্ষেত্রেও বিশেষ শাস্তি ভোগ করতে হত গণিকাদের।
খ্রিস্ট্রীয় পঞ্চম শতকের মহাকবি কালিদাস তাঁর মেঘদূত কাব্যে দুই প্রকারের গণিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে–একটি নগরনটী, অপরটি দেবদাসী। বিক্রমোর্বশীয়ম, নলোদয়, দ্বাবিংশপুত্তলিকা, ঋতুসংহারে কামুক পুরুষ ও গণিকাদের উল্লেখ আছে। দ্বাবিংশপুত্তলিকা কাব্যে মহাকবি কালিদাস মোট ৩২ জন গণিকার কথা বলেছেন। তাঁরা হলেন–মিশ্রকেশী, সুপ্রভা, ইন্দ্রসেনা, সুদতী, অনঙ্গনয়না, কুরঙ্গনয়না, লাবণ্যবতী, কমলিকা, চণ্ডিকা, বিদ্যাধরী, প্রজ্ঞাবতী, জনমোহিনী, বিদ্যাবতী, নিরুপমা, হরিমধ্যা, মদনসুন্দরী, বিলাসরসিকা, শৃঙ্গারকালিকা, মন্মথসঞ্জীবনী, রতিলীলা, মদনবতী, চিত্রলেখা, সুরতগহ্বরা, প্রিয়দর্শিনী, কামোন্মাদিনী, সুখসাগরা, শশিকলা, চন্দ্ররেখা, হংসগামিনী, কামরসিকা, উন্মাদিনী, প্রভাবতী ইত্যাদি। পাঠক, নামের ধরন দেখে বুঝে নিন এই নারীদের কাজ কী ছিল। মহাকবির লেখনীতে সরাসরি গণিকা না-বললেও নামের অর্থানুসারে অনুমান করাই যায় তাঁরা প্রত্যেকেই বারবিলাসিনী-কামনাময়ী। তবে গণিকাদের বর্ণনায় মহাকবি ছিলেন খুবই উদার। তিনি বর্ণনা দিয়েছেন–বিলাসিনীরা তাঁদের অর্থবান নাগরদের নানাভাবে গ্রীষ্মের তাপ নিবারণের আয়োজন করছে। এই সময় মেখলা শোভিত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বসনে তাঁদের নিতম্বের অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছিল। প্রায় খোলাখুলিভাবে সুউচ্চ স্তনমণ্ডলে তাঁরা নাগরদের দেখিয়ে দেখিয়ে চন্দন মাখছিল এবং চুলে সুগন্ধি দিচ্ছিল (নিতম্ববিম্বৈঃ সদুকুলমেখলৈঃ স্তনৈঃ সহারাভরনৈ সচন্দনৈঃ।/শিরোরুহৈঃ স্নানকষায় বাসিতৈঃ স্ত্রিয়ো নিদাঘাংশময়ন্তি, কামিনা”)। কালিদাসের কাব্যে গণিকাদের গতিবিধি ছিল অবাধ। কথিত আছে, মহাকবি কালিদাস স্বয়ং ব্যক্তিগত জীবনে জনৈকা বিশিষ্ট গণিকার সঙ্গে দিনযাপন করতেন।