জবালা এক বহুচারিণী বা গণিকার নাম। সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদ থেকে জানতে পাই জবালা ও সত্যকামের কাহিনি। সত্যকাম জানতেন না তাঁর পিতৃপরিচয়। পিতৃপরিচয় নেই বলে সত্যকাম কোনো গুরুগৃহে বিদ্যাশিক্ষার জন্য যেতে পারতেন না। বহুচারিণী জবালাও খুব স্বাভাবিকভাবেই জানতেন সত্যকামের প্রকৃত পিতা কে। পরে অবশ্য সত্যকামের বিদ্যাশিক্ষার উপর আগ্রহ অনুভব করে গুরু গৌতম শিক্ষাদান করেছিলেন। বেদের যুগেও আমরা গণিকাদের পাচ্ছি। ঋকবেদে গণিকাদের বলা হত ‘জারিণী” “হপ্তাশ্চ বভ্রবো বাচমত এমদেং নিষ্কৃতং জারিণী” (অর্থাৎ ভ্ৰষ্টা নারী উপপতির নিকট গমন করে)। ঋকবেদে গণিকাদের ‘দিধিষু’ ও ‘সাধারণী’ বলা হয়েছে। অথর্ব বেদে বলা হয়েছে মহানগ্নী’, ‘পুংশ্চলী’। তবে একথা বলতেই হয়, তৎকালীন বৈদিক সাহিত্যে গণিকাদের বিষয়ে সরাসরি কোনো আলোচনা না-হলেও এটা অনুমান করা যায় যে, তৎকালীন সমাজে গণিকাদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য।
বেদের যুগে গণিকা ও গণিকাবৃত্তি মহত্বপূর্ণ হলেও মনুসংহিতার যুগে এসে নিন্দিত হয়েছে। স্মৃতিকারেরা প্রবঞ্চক, জুয়ারী, তস্করদের সঙ্গে গণিকাদের একাসনে বসিয়ে দিয়েছেন। মনু স্পষ্টভাবে বলেছেন–ব্রাহ্মণ কিংবা গৃহস্থ ব্যক্তির পক্ষে গণিকাদের কাছ থেকে কোনো দান অথবা ভক্ষদ্রব্য গ্রহণ করা দূষণীর। ব্রাহ্মণ কখনোই গণিকাগমন করবে না। যদি যায় তাহলে তাঁকে কৃচ্ছসাধন করে পবিত্র হতে হবে। মনু বলছেন–ষড়দোষে (অধিক মদ্যপান, অসৎ পুরুষ সংসর্গ, স্বামীবিচ্ছেদ, ইতস্তত ভ্রমণ, অসময়ে নিদ্রা এবং পরগৃহে বাস) দুষ্ট রমণী ব্যভিচারিণী হয়ে থাকে (“ষট স্ত্রিয়া ব্যভিচারায়া দোষ জনকানি তস্মাদেতেভ্য এতা রক্ষণীয়াঃ”), এ থেকেই বোঝা যায় সে যুগে ব্যভিচারিণী বা গণিকার উপস্থিতি ছিল। মনু গণিকাদের অশালীন আচরণ করার অপরাধে নানা রকম শাস্তির বিধান দিয়েও গেছেন। মনুর যুগে বিশেষ কোনো গণিকার নাম উল্লেখ না থাকলেও তৎকালীন সমাজে প্রচুর গণিকার উপস্থিতি প্রমাণিত হয় স্মৃতিশাস্ত্রের বিভিন্ন উক্তি থেকে। গণিকাদের মনে করা হত মানুষের চলার পথে কণ্টক স্বরূপ (“প্রকাশলোক বঞ্চকার চাবৈর্জনীয়াৎ”)। সেই কারণেই এঁদের ধরার জন্য রাজার চরেরা ঘুরে বেড়াত। যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতায় গণিকাদের কথা জানা যায়। যাজ্ঞবন্ধ্যে গণিকাদের ‘স্বৈরিণী’ বলা হয়েছে। স্বৈরিণী হল তাঁরাই, যাঁরা স্বীয় স্বামীকে পরিত্যাগ করে ইচ্ছাপূর্বক কোনো পরপুরুষের আশ্রয় করে। যাজ্ঞবল্ক্য গণিকাদের জন্য কিছু নিয়মনীতিও ঠিক করে দিয়েছিলেন। যেমন–(১) কোনো গণিকা যদি খরিদ্দারের কাছ থেকে শুল্ক গ্রহণ করে বা অগ্রিম অর্থ নিয়ে পরে যৌনমিলনে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে গৃহীত অর্থের দ্বিগুণ খরিদ্দার পুরুষটিকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে। অন্যথায় গণিকার দেহদানের সমান অর্থ পুরুষটাকে ফিরিয়ে দিতে হবে–“গৃহীত বেতনা বেশ্যা নেচ্চন্তী দ্বিগুণং বহেৎ।/অগৃহীতে সমং দাপ্যঃ পুমাণপ্যেসেব চ”। (২) কোনো পুরুষ যদি গণিকাকে দেহদানের নিমিত্ত অর্থ দিয়েও তাঁর সঙ্গে যৌনসংসর্গ না-করে, তাহলে তাঁর দেয় অর্থ সেই গণিকার কাছ থেকে কোনোমতেই ফেরত পেতে পারে না–“অযৌন গচ্ছতো যেধাং পুরুষং বাপি মোহতঃ।/চতুর্বিংশতিকো দণ্ডস্তথা প্রব্রজিতাগমো”। শুধুমাত্র মনুসংহিতা বা যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতাতেই নয়, পরাপরসংহিতা ও বিষ্ণুসংহিতাতেও গণিকাগমন নিন্দনীয় গণ্য করেছে। বলা হয়েছে, গণিকাগমন হস্তমৈথুনতুল্যের মতো অপরাধ। হিন্দুধর্মে হস্তমৈথুন বা স্বমেহনকে পাপকাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে। গৌতমসংহিতায় সর্বসাধারণের ভোগ্যা নারীকে হত্যা করলে হত্যাকারীর কোনো শাস্তি হবে না বলেছে। গণিকার অনুগ্রহণও নিষিদ্ধ, বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের।
তা সত্ত্বেও আমরা দেখতে পাই, প্রাচীন ভারতে জীবনের অপরিহার্য অঙ্গই ছিল গণিকারা। কোনো মহৎ উৎসব অনুষ্ঠান গণিকাদের উপস্থিতি ছাড়া হতই না। রামায়ণে আমরা দেখতে পাই গণিকার লোভ দেখিয়ে বিভাণ্ডক মুনির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে অযোধ্যার যজ্ঞে আনা হয়েছে। ঋষ্যশৃঙ্গ লোকালয়ের আসা একদম পছন্দ করতেন না। যত জরুরি কাজ থাক না-কেন কখনোই তিনি লোকালয়ে আসতেন না। অতএব রাজা দশরথকে তাঁর অমাত্য সুমন্ত পরামর্শ দিলেন–“মহারাজ, মানুষ সর্বদা যা কামনা করে এবং যাতে চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে এমন ইন্দ্রিয়-ভোগ্য জিনিস জড়ো করে ঋষ্যশৃঙ্গকে আকৃষ্ট করে অযোধ্যায় আসা বাঞ্ছনীয়”–“ইন্দ্রিয়ার্থৈবাভমতৈৰ্ণরচিত্ত প্রমাতিথিঃ/পুরমানায়য়িষ্যামঃ ক্ষিপ্রং চাধ্যবসীবতা”। অমাত্য সুমন্ত সহাস্যে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়েছিলেন–সেই ইন্দ্রিয়ভোগ্য জিনিস হল লাবণ্যময়ী যুবতী গণিকা। রাজা দশরথের নির্দেশে পুরোহিত ও মন্ত্রীরা অবিলম্বে সুন্দরী গণিকাদের ব্যবস্থা করলেন। আদেশানুসারে সেই সুন্দরী গণিকারা ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আশ্রমের অভিমুখে যাত্রা করলেন। রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেককালেও প্রচুর গণিকাদের উপস্থিতির কথা জানতে পারি। অধিকৃত ব্যক্তিবর্গকে মুনি বশিষ্ঠ নির্দেশ দিয়েছিলেন–“মন্ত্রীগণ, সর্বত্র পতাকা উড্ডীন করে দাও। রাজপথে জলসিঞ্চন করো, যে পথে গণিকা সকল সুসজ্জিত হয়ে প্রাসাদের দ্বিতীয় কক্ষে অবস্থান করবে।” সুবৃহৎ সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারতেও গণিকাদের কদর ছিল। যৌন কেলেংকারীতে ভীমের হাতে মৃত্যু হয় বিরাটরাজের সেনাপতি কীচকের। সেনাপতির মৃত্যুর সুযোগ নিয়ে ত্রিগর্তের রাজা সুশর্মা কৌরবদের সাহায্য নিয়ে বিরাটরাজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিরাটরাজও পাণ্ডবদের সহযোগিতায় ত্রিগর্তের রাজা সুশর্মাকে পরাজিত করেন। সেই যুদ্ধজয়ের আনন্দে বিরাটরাজ এক উৎসবের আয়োজন করেন। সেই রাজকীয় উৎসবের একেবারে পুরোধায় সুন্দরী গণিকাদের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন বিরাটরাজ। গণিকাদেরই রণজয়ের ঘোষণা করতে আদেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং বিরাটরাজ।