এর পর থেকে সমগ্র ইউরোপে বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত নানা রকম পুরুষাঙ্গ-আচ্ছাদনী রোগ প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৬০৫ সালে রচিত ‘De iustitia et iure’ (বিচার ও আইন প্রসঙ্গে) নামে একটি ধর্মীয় গ্রন্থের বক্তব্য থেকে জানা যায়, এই জাতীয় বস্তুগুলি রোগ প্রতিরোধের বদলে জন্মনিয়ন্ত্রক হিসাবেই বেশি ব্যবহৃত হত। এই গ্রন্থের লেখক ক্যাথলিক ধর্মতত্ত্ববিদ লেওনার্দাস লেসিয়াস এগুলিকে অনৈতিক বলে বর্ণনা করেছেন। ১৬৬৬ সালে ব্রিটিশ বার্থ রেট কমিশনের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে এই সময় কন্ডোম ব্যবহারের ফলে জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। ক্ষৌমবস্ত্রের পাশাপাশি রেনেসাঁর যুগে অন্ত্র ও মুত্রাশয় নির্মিত কনডমের ব্যবহারও প্রচলন লাভ করে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে ওলন্দাজ বনিকেরা ভালো চামড়া’ নির্মিত কন্ডোম নিয়ে যায় জাপানে। এই অঞ্চলে পূর্বে ব্যবহৃত শিং-নির্মিত কন্ডোম শুধুমাত্র শিশ্নাগ্রভাগকেই ঢাকত। কিন্তু এই সমস্ত চামড়ার কন্ডোমে সমগ্র পুরুষাঙ্গকে ঢাকার সুবিধা পাওয়া যেত।
অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে আইনজ্ঞ, ধর্মতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসকদের একটি অংশ কন্ডোম ব্যবহারের বিরোধিতা করতে থাকেন। সেসময় তাঁরা যে আপত্তিগুলি তোলেন, সেগুলির অনেকগুলি এসময় আজও তোলা হয়ে থাকে। যেমন—কন্ডোম গর্ভাধান সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়, যাকে কেউ কেউ জাতির পক্ষে অনৈতিক ও অবাঞ্ছিত মনে করেন। এগুলি যৌনরোগ থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা করতে অক্ষম, অথচ এদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতায় বিশ্বাস রেখে মানুষ তাঁদের যৌন কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে থাকে। তা ছাড়া অনেকেই নানা ব্যবহায় সংক্রান্ত সমস্যা, চড়া দাম ও ব্যবহারের ফলে কামোদ্দীপনা কমে যাওয়ার জন্য কন্ডোম ব্যবহার এড়িয়ে চলেন। কিন্তু কোনো কোনো মহলের বিরোধিতা সত্ত্বেও কন্ডোমের বিক্রি বাড়তে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিভিন্ন মান ও আকারের কন্ডোম কিনতে পাওয়া যেত। এর মধ্যে যেমন রাসায়নিক মাখানো ক্ষৌমবস্ত্র নির্মিত কনডম ছিল, তেমনই ছিল ‘ত্বক’ ও (সালফার ও লাই মিশ্রিত নরম করা মুত্রাশয় বা তন্ত্র)। সমগ্র ইউরোপে ও রাশিয়ায় পাব, নাপিতের দোকান, ঔষধের দোকান, খোলাবাজার এবং নাট্যশালায় কন্ডোম বিক্রি হত। পরে এগুলি আমেরিকাতেও বিক্রি হতে শুরু করে। তবে সর্বত্রই চড়া দাম, সচেতনতা ও সঠিক যৌনশিক্ষার অভাবে কেবলমাত্র উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশের মধ্যেই কন্ডোমের প্রচলন সীমাবদ্ধ থাকল
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে জন্মনিরোধক পদ্ধতিগুলির সঙ্গে সমাজের দরিদ্র শ্রেণি পরিচিত হয়। এই সময়কার জন্মনিরোধক সম্পর্কিত লেখকেরা জন্মনিয়ন্ত্রণের অন্যান্য পদ্ধতিগুলিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এযুগের নারীবাদীরা বলতেন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি একান্তভাবেই নারীর হাতে থাকা উচিত। তাঁরা কন্ডোম জাতীয় সকল পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত জন্মনিরোধকের বিরোধী ছিলেন। অন্যান্য লেখকেরা লিখেছেন কন্ডোম ছিল দামী ও নির্ভরযোগ্যতাশূন্য। অভিযোগ ছিল এগুলি ছিদ্র হয়ে যেত, শরীরে বাইরে খুলে আসত বা ফেটে যেত)। তবে তাঁরা কতকগুলি ক্ষেত্রে কন্ডোমকে ভালো বিকল্প বলেছেন। যেমন রোগপ্রতিরোধের ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যবহার্য ছিল কনডম। অনেকে আবার অবাঞ্ছিত সন্তান ও যৌনরোগের ভয়ে যৌনসঙ্গম পরিত্যাগ করার পথ বেছে নিতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সামরিক বাহিনীয় কন্ডোম ব্যবহারকে সমর্থন করেনি; বরং এই জাতীয় পোস্টারের মাধ্যমে সবাইকে ব্রহ্মচর্য পালনকে উৎসাহিত করত।
অনেক দেশে কনডম উৎপাদন বা গর্ভনিরোধ ব্যবস্থার প্রসার রোধ করার জন্য আইন পাস করা হয়। কিন্তু এত বাধা সত্ত্বেও ভ্রাম্যমাণ ভাষণ ও সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনের কন্ডোমের কথা প্রচারিত হতে থাকে। যে সমস্ত অঞ্চলে এই জাতীয় বিজ্ঞাপন আইনত নিষিদ্ধ ছিল সেখানে শালীনভাবে কন্ডোমের কথা প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ঘরে কি করে কন্ডোম তৈরি করা হয় তার নির্দেশিকা বিলি করা হত। সামাজিক ও আইনি প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কন্ডোমই হয়ে ওঠে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি।
ঊনবিংশ শতাব্দীর পরার্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যৌনরোগীর সংখ্যা অকস্মাৎ অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিকরা এর জন্য আমেরিকার গৃহযুদ্ধের প্রভাব ও কমস্টক আইন কর্তৃক প্রচারিত প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলির প্রতি অজ্ঞতাকে দায়ী করেন। এই ক্রমবর্ধমান মহামারির সঙ্গে যুঝতে সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে প্রথম যৌনশিক্ষা পাঠক্রম চালু করা হয়। এই পাঠক্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন যৌনব্যাধি ও কেমন করে তা সংক্রমিত হয়, সেই সম্পর্কে পাঠদান দেওয়া হত। তবে যৌনব্যাধি নিয়ন্ত্রণে কন্ডোমের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হত না। কারণ সেযুগের চিকিৎসক মহল ও নৈতিকতার ধ্বজাধারীরা মনে করতেন, যৌনরোগ আসলে যৌন অসদাচারের শাস্তি। যৌনরোগে আক্রান্তদের প্রতি বিদ্বেষ এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, অনেক হাসপাতাল সিফিলিস রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা করতে অস্বীকার করে।
এদিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে জার্মান সামরিক বাহিনীতে সেনা জওয়ানদের মধ্যে কন্ডোম ব্যবহারকে উৎসাহ দেওয়া হতে থাকে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে মার্কিন সামরিক বাহিনী কর্তৃপক্ষ একটি পরীক্ষা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে কন্ডোম ব্যবহারের ফলে সেনা জওয়ানদের যৌনরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও (কেবলমাত্র যুদ্ধের সূচনাভাগে) ব্রিটেন যুদ্ধের সেনা জওয়ানদের মধ্যে কন্ডোম সরবরাহ বা কন্ডোম ব্যবহার উৎসাহিত করেনি, যুদ্ধের অংশগ্রহণকারী অন্যান্য সকল রাষ্ট্রই করেছিল।