বাৎস্যায়ন চৌষট্টি বা চতুঃষষ্টি কলায় সুশিক্ষিত গণিকাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন–“আভিরভূচ্ছিতা বেশ্যা শীলরূপগুণান্বিতা।/লভতে গণিকাশব্দং স্থানঞ্চ জনসংসদি৷৷” বাৎস্যায়নের সময় গণিকাদের বিয়ের মধ্যে এক অভিনব ব্যাপার ছিল। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়েদের মতো তাঁরাও বিয়ে-থা, সন্তান জন্মদান, ঘর-সংসার করতে পারত। তবে কোনো গণিকাকেই বিয়ের পর পুরোনো গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করত না। অবশ্য বিয়ের পর প্রথম একটা বছর স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করা নিষিদ্ধ ছিল। বিয়ের এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর গণিকাবৃত্তিতে আর কোনো বাধা ছিল না। তবে সেক্ষেত্রে শর্ত একটাই–এক বছর পর স্বামী যে রাতে তাঁকে যৌনমিলনের তাগিদে বিছানায় আহ্বান করবে সেই মুহূর্তে শত খরিদ্দার ত্যাগ করেও সেই রাতে তাঁকে স্বামীর সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হতে হবে (কামসূত্রম্ ৭/১/২২)। বাৎস্যায়ন শেষ করব গণিকাদের একটি বিপজ্জনক অপকর্ম দিয়ে। এইসব গণিকারা চতুরতার সাহায্যে মাঝমধ্যেই শাঁসালো ধনীর ছেলে খুঁজে তাঁর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করত। কীসের ক্ষতিপূরণ? গণিকারা তাঁর কোনো সখি বা দাসীর সাহায্যে তাঁর অক্ষতযোনি কন্যার যোনিদেশে সীসা-লৌহাদি নির্মিত কৃত্রিম লিঙ্গ প্রবেশ করিয়ে সতীচ্ছদ ছিন্ন করে ক্ষতের সৃষ্টি করত। এরপর ওই যযানি-বিধ্বস্ত মেয়েকে পাখি-পড়া পড়িয়ে মুখিয়ার দরবারে কিংবা বিচারালয়ে পূর্বে নির্দিষ্ট যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করত এবং বেশ মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিত (কামসূত্রম্ ৭/১/২০)।
বাৎস্যায়নের সময়ে সমাজের বিদ্বান ব্যক্তিরা দলে দলে গণিকালয়ে আড্ডা জমাতেন। শুধু মুখে আচ্ছা নিশ্চয় হত না। নারী থাকবে, অথচ সুরা থাকবে না তা কি কখনো হয়! অতএব ঢালাও মদের ব্যবস্থাও ছিল সেই আড্ডায়। কত ধরনের মদের সমাবেশ ঘটানো হত, তার তালিকাও বাৎস্যায়ন উল্লেখ করেছেন। বাৎস্যায়ন এটাও প্রমাণ করে দিয়েছেন, অন্য বৃত্তিধারী বা পেশাদার মানুষরা যেমন বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে, ঠিক তেমনই গণিকারাও নিজের বৃত্তি বা পেশায় টিকে থাকার জন্য নানারকম কৌশল অবলম্বন করে থাকত। আর পাঁচটা বিক্রেতাদের খরিদ্দার ধরে রাখার মতো গণিকারাও পুরুষ ধরে রাখার চেষ্টা করতেন, ধরে রাখার বিদ্যাটাও অতি যত্নে আয়ত্ব করতে হত। বলতে দ্বিধা নেই, বাৎস্যায়ন তাঁর ‘কামশাস্ত্রম’ রচনা করেছিলেন মূলত গণিকাদের জন্যেই। গণিকারা যাতে উৎকৃষ্ট ও সুখদায়ক কামকলা প্রদর্শন করতে পারে সেই শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যেই কামসূত্র। গণিকাদের যৌনক্রিয়ার পারদর্শিনী করে তুলতেই এই আকর গ্রন্থ।
০৬. প্রাচীন সাহিত্যে গণিকা
আগেই বলেছি সংস্কৃত সাহিত্যের বিভিন্ন সমাজে দেবতা ও মানুষের সঙ্গে সঙ্গে গণিকাদের সঙ্গেও সহাবস্থানের প্রমাণ মেলে।এই সময়কালে গণিকারা সাধারণের চোখে মোটেই ঘৃণিত ছিলেন না, বরং মর্যাদার সঙ্গে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ ও জীবনযাপন করতেন। প্রাচীন ভারতে ভারতের নাগরিক জীবনে গণিকারা বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। মোটের উপর প্রাচীন ভারতের সামাজিক জীবনে যে গণিকাদের গৌরবময় ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান ছিল তা তৎকালীন সাহিত্যই প্রমাণ দেয়। সেসময়ে গণিকাদের ডাক পড়ত উৎসব-অনুষ্ঠানেও। কারণ সেই সময়ের মানুষ মনে করত গণিকা-দর্শনে দিন ভালো যায়। এঁরা সৈন্যবাহিনীরও অনুচারিণী হত। ভিনদেশীয় কোনো রাজা এলে নগরের বাইরে গিয়ে গণিকারা তাঁদের অভ্যর্থনা করত। সংস্কৃত সাহিত্যের পাতায় পাতায় প্রচুর গণিকাদের বিবরণ পাওয়া গেলেও তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রসিদ্ধ ও সমাদৃত ছিল। কয়েকজনের নাম উল্লেখ করতে পারি–বসন্তসেনা, বাসবদত্তা, শ্যামা, আম্রপালী প্রমুখ। প্রাচীন সাহিত্যের এইসব গণিকারা সুদীর্ঘকাল অতিক্রম করে একেবারে হাল আমলের সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে। গণিকাদের বিচরণক্ষেত্র একালের মতো সেকালে শুধুমাত্র কামুক পুরুষদের জন্য ছিল না। বরং রাজ-সমীপে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে বেঁচেবর্তে থাকত।
মহাকবি কালিদাসের মহাকাব্যগুলিতে গণিকাদের উল্লেখ আছে। মেঘদূতে আমরা গণিকাদের কথা জানতে পারি। বিক্রমোঝশীয়ম্ নাটকে মহাকবি যে উর্বশীকে নায়িকা করেছেন তিনি একজন বহুভোগ্যা গণিকারমণী। অবশ্যই উর্বশী ছিলেন তথাকথিত ‘স্বৰ্গবেশ্যা’। “নীচৈরাখ্যং গিরিমধিবসেস্তত্র বিশ্রামহেতোস্তৃৎসম্পকাৎ পুলকিতমিব প্রৌঢ় পুষ্পৈঃ কদম্বৈ/যঃ পণ্য স্ত্রী রতিপরিমলোদগারিভিৰ্মাগরানামুদ্দামানি প্ৰথয়তি শিলাবেশ্মভিযোবনানি (মেঘদূতম্, পূর্বমেঘ, ২৫)। শুধু কালিদাস কেন, বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস গ্রন্থ থেকে জানা যায়–সেকালের গণিকাদের সঙ্গে রাজা ও সাধারণ মানুষের সম্পর্ক কাহিনি। সেকালের গণিকারা নানা বসনভূষণে অলংকৃত হয়ে রাজপথে কীভাবে শোভাবর্ধন করতেন, তারও উল্লেখ আছে। সপ্তম শতকের লেখক বাণভট্ট তাঁর কাদম্বরী গ্রন্থে লিখেছেন–সেকালে গণিকারা দেশের রাজাদের স্নান করাত। রাজাদের মাথায় আমলকী ঘষে দিত। স্নানের পর রাজাদের সারা শরীরে চন্দন, আতর, কুমকুম ইত্যাদি মাখিয়ে দিত। এমনকি রাজাদের পরনের যাবতীয় পোশাক গণিকারাই পরিয়ে দিতেন। নবম শতকে রচিত ‘কুট্টনীমত’ গ্রন্থে দামোদরগুপ্ত লিখেছেন–সেকালের বারাণসী নগরীতে মালতী নামে গণিকা বাস করত। সেই নারী গণিকা সংক্রান্ত নানা প্রয়োজনীয় উপদেশ নিতে বিকরবালা নামের এক বৃদ্ধা গণিকার কাছে যেতেন। কুট্টনীমত’ গ্রন্থটির উপজীব্যই হল সেই বৃদ্ধা গণিকার বিবৃত যৌনক্রিয়া সংক্রান্ত উপদেশাবলি। শ্রীধরদাস তাঁর ‘সদুক্তিৰ্ণামৃত’ গ্রন্থে তৎকালীন বঙ্গদেশের গণিকাদের বিবরণ দিয়েছেন। এখানে ‘তকালীন’ বলতে দ্বাদশ শতক বুঝতে হবে। শ্রীধরদাস বলেছেন–“বেশঃ কেষাং ন হরতি মনো বঙ্গ বারাঙ্গনানা”। ভবভূতির মালতীমাধব’ গ্রন্থে ব্রাহ্মণ মাধব সিংহলে বাণিজ্য করে প্রভূত সম্পদশালী হন। এরপর কুবলয়াবলি নামের এক সুন্দরী গণিকার প্রেমে পড়ে যান এবং যথারীতি যৌনমিলন কার্ব সম্পন্ন করেন। ব্রাহ্মণের মোহাবিষ্টতার সুযোগ নিয়ে সেই গণিকারমণী তাঁর সমস্ত সম্পত্তি হরণ করে চম্পট দেয়। পরে অবশ্য কুবলয়াবলিকে পাকড়াও করে এবং তাঁর নাক-কান কর্তন করে ছেড়ে দেন। এটাই মালতীমাধবের বিষয়। চারুদত্ত’ গ্রন্থে লেখক ভাসের কাহিনির উপজীব্য হল চারুদত্ত ও বসন্তসেনার প্রেম। বসন্তসেনা হলেন একজন গণিকা, যাঁর বিয়ে হয় চারুদত্ত নামের জনৈক ব্রাহ্মণ যুবকের সঙ্গে।এছাড়া শর্বিলক নামে এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে মদনিকা নামে এক গণিকার বিয়ের কাহিনিও আছে।