১৯৯৭ সালের ১৪ নভেম্বর কলকাতায় আয়োজিত এই সম্মেলনের শিরোনাম ছিল–Sex Work is Real Work : We Demand Workers Rights’। ২০০৫ সালে ‘Born into Brothels’ নামে তথ্যচিত্রটি তৈরি করে শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্র বিভাগে অস্কার ছিনিয়ে আনে। এই তথ্যচিত্রে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের সন্তানদের জীবনযাত্রা চিত্রিত হয়েছে। এতদিন যৌনপেশার পরিধি সীমাবদ্ধ ছিল মূলত দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিট এবং গৌরীশংকর লেনের মধ্যেই। এখন সোনাগাছির এলাকা ক্রমেই বাড়ছে, চারপাশ দিয়ে বাড়ছে। যৌনকর্মীরাও ছড়িয়ে পড়ছেন আশেপাশের অঞ্চলে।
দুর্বারের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের অন্যান্য কিছু এলাকায় যৌনকর্মীরাও তাঁদের নিজস্ব সংস্থা গড়ে তুলেছে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল–পঞ্চম (বিহার), সাভেরা (দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ ও বিহার), সেক্স ওয়ার্কার্স ফোরাম (কেরল), বেশ্যা এইডস মোকাবিলা পরিষদ (মহারাষ্ট্র), উইমেন্স ইনিশিয়েটিভ (তিরুপতি)। এছাড়াও সারা বিশ্বে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে নিরন্তর। বাংলাদেশের দুর্জয় নারী সংঘ, উল্কা নারী সংঘ, অক্ষয় নারী সংঘ ইত্যাদি।
ভারতের লক্ষ লক্ষ যৌনকর্মীদের পক্ষে সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের নানাবিধ অধিকারের দাবি করা এবং ইতোমধ্যে অতি অল্প হলেও তার কিছুটা আদায় করা তাঁদের নিজেদের কাছে বা অন্যদের কাছেও ১৫ বছর আগে প্রায় স্বপ্নেরও অতীত ছিল। অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের কিছু দেশে যৌনকর্মীরা বেশ কয়েক বছর হল তাঁদের নিজেদের কিছু দাবি-দাওয়া আদায় করতে পেরেছে। কিন্তু এইসব যৌনকর্মীরা ভারতের ও অন্যান্য অনুন্নত দেশের যৌনকর্মীদের মতো এত দরিদ্র, এত নির্যাতিত ও এত অসহায় কখনোই ছিল না। ভারতের যৌনকর্মীদের ক্ষমতায়নের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে তা আরও জোরালো হবে এবং অন্যান্য অনুন্নত দেশের যৌনকর্মীদের পক্ষে পথ-প্রদর্শক হিসাবে গণ্য হবে।
বস্তুত মানুষ হিসাবে আমরা সবাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পুঁজিবাদের বদ্ধভূমিতে বন্দি হয়ে পড়ছি ক্রমশ। ক্ষমতার লড়াই চলছে সর্বত্র। নারীও পিছিয়ে নেই, সেই লড়াইয়ে নারীও সামগ্ৰীক অংশীদার। সবাই জানে ক্ষমতায়নের প্রধান রসদ অর্থ। সেই অর্থ নিজের ঘরে মজুত করার জন্য ‘ভালো’ বা ‘মন্দ’ কোনোকিছুতেই দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই। তাঁরা সেই সারসত্য মেনে নিয়েছে–লজ্জা ঘৃণা ভয়, তিন থাকতে নয়। তাই এ কাজে পাপবোধ হয় না?” এমন প্রশ্নে জনৈক যৌনকর্মী সপ্রতিভ উত্তর দিলেন–“আরে ধুস। শরীরে যৌনাঙ্গ আছেই তো যৌনকর্ম করার জন্যে। শরীরটাও আমার। যৌনাঙ্গটাও আমার। সেই যৌনাঙ্গ দিয়ে কার সঙ্গে কতজনের সঙ্গে কীভাবে যৌনকর্ম করব, সবটাই আমি ঠিক করি। পাপবোধ হবে কেন? পাপবোধ তাঁদেরই হয়, যেসব মেয়েরা তাঁর শরীরের উপর পুরুষের একক মালিকানায় বিশ্বাসী।”
তাই বিশ্বায়নের নিত্যনতুন কৌশল মানুষের মগজ আর মননে জমা হচ্ছে পরতে পরতে। মৌলবাদ ও পুঁজিবাদ দুটোই মানুষের অস্তিত্বের জন্য চরম সংকটের। এ সংকট রাতারাতি মুক্ত হয়ে যাবে, এ আশাও আমি করি না। পুঁজিবাদী মূল্যবোধে ঠাসা মগজের কারফিউ কোনোদিন ভাঙবে কি না তাও জানি না।
২৫. গণিকাগমন এবং গনোরিয়া, সিফিলিস ও এইডস
আগের অধ্যায়ে আলোচনা করেছি ব্রিটিশ-ভারতে অনিয়ন্ত্রিত যৌনজীবনে কীভাবে মানুষের মধ্যে যৌনরোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সময় যৌনরোগের এতটাই প্রাদুর্ভাব হয়েছিল যে, সকলেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এই ধারা অব্যাহত ছিল ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। ব্রিটিশ আমলের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে কি অবস্থা ছিল ওই সময়। দেবাশিস বসুর ‘কলকাতার যৌনপল্লী’ থেকে জানা যায়—১৮৫৩ সালে কলকাতা শহরে ৪০৪৯ টি গণিকালয় ছিল, যাতে বাস করছিলেন ১২,৪১৯ জন যৌনকর্মী। ১৮৬৭ সালে ছিল ৩০,০০০ জন। ১৯১১ সালের আদশুমারি অনুযায়ী ১৪২৭১ জন। ১৯২১ সালের আদমশুমারিতে অনুযায়ী ১০,৮১৪ জন যৌনকর্মী ছিল কলকাতায়। প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আরও বেশি হবে। বিনয় ঘোষ তাঁর কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’-এ লিখেছেন—কলকাতায় খুবই রমরমা ছিল গণিকাদের জগৎ। গৃহস্থের বাড়ির পাশে গণিকা, ছেলেদের পাঠশালার পাশে গণিকা, চিকিৎসালয়ের পাশে গণিকা, মন্দিরের পাশে গণিকা। বিশেষ করে রামবাগান, সোনাগাছি, মেছোবাজার, সিদ্ধেশ্বরীতলা, হাড়কাটা, চাঁপাতলা, ইমামবক্স এগুলো ছিল গণিকাদের আখড়া। এমনকি কিছু গণিকা শহরে প্রকাশ্য রাজপথে নৃত্য পর্যন্ত করত। সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছে আবেদন করা সত্ত্বেও এর কোনো প্রতিকার হয়নি। কারণ কলকাতায় পুলিশ ধনীদের তৈরি গণিকালয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করতে সাহস পেত না। শুধুমাত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতায় একটি এলাকাতেই ৪৩টি গণিকালয়ের মালিক ছিলেন।
অবাঞ্ছিত, অনিয়ন্ত্রিত যৌনজীবন অতিবাহিত করার ফলে যে যে যৌনরোগ ছড়িয়ে পড়ছিল, সেগুলি হল–গনোরিয়া, সিফিলিস, জেনিটাল হার্পিস, এইডস, ক্লেমিডিয়া, শ্যানক্রয়েড, জিকা ভাইরাস ইত্যাদি।
গনোরিয়া : গনোরিয়া আছে এমন কারোর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হলে গনোরিয়া হতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত মা থেকে নবজাতকের শরীরে এই জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। পুরুষ ও নারী, বিশেষ করে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সিরা গনোরিয়ায় আক্রান্ত হয় বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নিবারণ কেন্দ্র (সিডিসি)। গনোরিয়া হলে মূত্রত্যাগের সময় জ্বালাপোড়া ও যৌনাঙ্গ দিয়ে সাদা, হলুদ ও সবুজ স্রাব বের হতে পারে।