উষা কো-অপারেটিভ এখানেই থেমে থাকেনি। উষা বোঝে আরও অনেক কাজ করতে হবে। যৌনরোগ এড়াতে কন্ডোমের কোনো বিকল্প নেই। বাইরে থেকে কন্ডোম কিনলে খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়। তাই যাতে সুলভে ও সঠিক মানের কন্ডোম তাঁরা যাতে পেতে পারে, সেই উদ্দেশ্য নিয়ে কন্ডোমের সামাজিক বিপণনের ব্যবস্থা শুরু করে। সারা পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীরা এই কন্ডোম ব্যবহার করে। যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করেন এমন। বহু সংস্থাকেও উষা কো-অপারেটিভ কন্ডোম বিক্রি করছে। এছাড়াও স্টেশনারি ব্যাবসা, ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের ব্যবসা, প্রসাধনী ব্যাবসা, কৃষি উৎপাদন ও বিপণন, পশুপালন ও মৎস্য চাষ এবং সেইসঙ্গে ন্যাপকিনের ব্যাবসাও করছে। যৌনকর্মী ও যৌনকর্মীদের সন্তানদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পথ প্রশস্ত করতেই প্রকল্পের উদ্দেশ্য।
চিটফান্ডের কবলে পড়ে উষা কো-অপারেটিভের আমানত লক্ষণীয়ভাবে কমতে শুরু করে দিয়েছিল। বহু যৌনকর্মী বেশি সুদের লোভে উষায় টাকা না-রেখে চিটফান্ডগুলিতে টাকা রাখতে শুরু করে দিয়েছিল। ঘটনায় দেখা গেছে লোভের বশে সোনাগাছি এলাকায় শুধু যৌনকর্মীরাই নয়–যৌনকর্মীর বাবু দালাল, বাড়ির কাজের লোক সবাই এইসব ভুয়ো সংস্থায় অর্থ লগ্নি করেছিলেন। মোট বিনিয়োগ কোটি টাকা ছাপিয়ে যাবে। উষা কো অপরেটিভ নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ক্রমশ সঞ্চয়ী হয়ে উঠছেন এই রাজ্যের যৌনপল্লিগুলির মেয়েরা। পেশায় থাকাকালীন একটি পয়সাও সঞ্চয় না করায় এই রাজ্যের যৌনকর্মীদের ভিতর অনেকেই একটা বয়সের পর ফুটপাথে বসে ভিক্ষা করেছেন অথবা শেষ বয়সে চরম দুর্গতির শিকার হয়েছেন। জীবনের নির্মমতা ক্রমাগত যন্ত্রণা দিয়েছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীর অশক্ত হয়েছে, আকর্ষণ হারাচ্ছে। একে তো সারাটা জীবন সমাজে প্রান্তিক মানুষ হিসাবে জীবন কাটানো। তার ওপর এই সমাজেরও ওঁদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর মানসিকতা ছিটেফোঁটাও ছিল না। ফলে পেশা থেকে সরে যাওয়ার পরের দিনগুলিতে যৌনকর্মীদের একাংশের চরম দুর্গতি অনেক যৌনকর্মীর চোখ খুলে দিয়েছে। ফলে তাঁদের ভাবনা চিন্তায় বৈপ্লবিক বদল ঘটেছে। যৌনকর্মীদের ভিতর সঞ্চয়ের প্রবণতা বেড়েছে। তাঁদের একটা বড়ো অংশ নিয়মিতভাবে সঞ্চয় করছেন। রোজগারের উত্তুঙ্গ সময়ে সঞ্চয় করার অভ্যাসটি যে-কোনো মানুষেরই সুঅভ্যাসের মতো করে অনুশীলন করা উচিত। সারা বাংলার যৌনকর্মীদের ভিতর গরিষ্ঠ সংখ্যকই এখন এমনটি মনে করেন। কিন্তু কলকাতা সহ এই রাজ্যের বিভিন্ন যৌনপল্লিগুলিতে নিয়মিত কিছু কিছু করে টাকা সঞ্চয় সম্পর্কে সচেতনতা জাগানোর কাজটি করতে সময় লেগেছে প্রায় দুটি দশক। এখন তাঁর সুফল ভোগ করছেন অধিকাংশ যৌনকর্মী। এর কৃতিত্ব প্রাপ্য ঊষা মাল্টিপারপাস কো অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের। এটি যৌনকর্মীদের জন্যে তৈরি প্রথম সমবায়। জানা গিয়েছে, সমবায়ের টার্ন ওভার এখন বার্ষিক ২৯ কোটি টাকা।
কলকাতা শহরের সোনাগাছি যৌনপল্লিটি মহানগরীর সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম যৌনপল্লি। এছাড়াও, মহানগরীর পরিচিত যৌনপল্লিগুলির ভিতর রয়েছে রামবাগান, বৌবাজার, ওয়াটগঞ্জ, খিদিরপুর, কালীঘাট এলাকার যৌনপল্লিগুলি। এছাড়াও দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ জুড়ে বিভিন্ন যৌনপল্লিগুলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন যৌনপেশার সঙ্গে যুক্তরা। এঁদের ভিতর একটা বড়ো অংশই ওই যৌনপল্লিগুলিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। কেবলমাত্র সোনাগাছিতেই যৌনকর্মীর সংখ্যা অন্ততপক্ষে ৯ হাজার। ১৯ থেকে ৪৫ বছর বয়স্ক মেয়েরা এখানে যৌনপেশায় যুক্ত। মাথা পিছু দৈনিক রোজগার অবশ্য একেক রকম। জানা গিয়েছে, বয়স্ক মহিলাদের চেয়ে তরুণীদের রোজগার তুলনায় অনেকটাই বেশি। সোনাগাছির বাসিন্দা একজন তরুণী যৌনকর্মী দিনে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত রোজগার করে থাকেন। এখানকার বাসিন্দা যৌনকর্মীদের ন্যূনতম দৈনিক আয় গড়ে ৫০০ টাকা। তবে বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়ের পরিমাণও কমতে শুরু করে।
শেষ করব এমন কয়েকটি কয়েকটি সংগঠনের কথা বলে যাঁরা বহু বছর ধরে যৌনকর্মীদের নিরাপত্তা, অধিকার ও স্বাস্থ্য নিয়ে আন্দোলন ও লড়াই করছেন। গণস্বাস্থ্য কর্মসূচি বর্তমানে বেশ কয়েকটি এনজিও এবং সরকারি সংস্থা এইডস সহ যৌনরোগ প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এনজিও প্রতিষ্ঠান ‘সংলাপ’-এর প্রতিষ্ঠাতাদের দ্বারা রচিত এই ‘গিলটি উইথআউট ট্রায়াল’ যৌনপল্লির শরীর-ব্যাবসার বহু তথ্য জ্ঞাপন করে। ২০০৫ সাল থেকে সোনাগাছি প্রকল্প যৌনকর্মীদের সমবায়। সমবায়টি এই অঞ্চলের যৌনকর্মীদের মধ্যে কাজ করে তাঁদের মধ্যে কন্ডোম ব্যবহার ও মানুষ পাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বিষয়ে সচেতনতার কথা প্রচার করে। ১৯৯২ সালে জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী স্মরজিৎ জানা এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে যৌনকর্মীরাই এই প্রতিষ্ঠানকে সচল রাখেন। এই সংস্থায় কৃতিত্ব যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার ৫ শতাংশ কমিয়ে এনেছে, যা ভারতের অন্যান্য নিষিদ্ধপল্লির তুলনায় বেশ কম। সেইজন্য রাষ্ট্রসংঘের এইডস কর্মসূচিতে এটি ‘বেস্ট প্র্যাকটিস মডেল’ বলে বন্দিত হয়েছে। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি সোনাগাছি প্রকল্প সহ পশ্চিমবঙ্গের ৬৫,০০০ যৌনকর্মী ও তাঁদের সন্তানদের নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা করে থাকে। এঁরা যৌনকর্মীদের অধিকার, স্বীকৃতি ও যৌন-ব্যাবসার বৈধকরণের দাবি জানার। এছাড়াও তাঁরা বিভিন্ন শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের কর্মসূচি পালন করে।