যৌনপেশা ও যৌনকর্মীদের বিরোধীরা মনে করে অ্যামনেস্টি যৌনকর্মী ও দালালদের বৈধ করতে চায়। বলা হচ্ছে বেশ্যালয়ের মালিকানাকে বৈধ করার সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। যৌনপেশাকে পুরোপুরি ‘ডিক্রিমিনালাইজ’ করা, অর্থাৎ অপরাধ হিসেবে গণ্য না-করার সপক্ষে অ্যামনেস্টি। ডাবলিনের ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিলের এক সভায় ৭০টি দেশ থেকে আগত ৪০০ প্রতিনিধির এক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দৃশ্যত প্রস্তাবটি সমর্থন করেন, যদিও ভোটাভুটির কোনো খুঁটিনাটি তথ্য দেওয়া হয়নি।
অ্যামনেস্টি বিভিন্ন যৌনকর্মী সংগঠন ও গোষ্ঠী, এইচআইভি/এইডস ত্রাণকর্মী এবং মানুষ পাচার বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে দু-বছর ধরে কথাবার্তা বলার পর এই সিদ্ধান্তে আসে যে, যৌনকর্মীদের মানবাধিকার রক্ষার শ্রেষ্ঠ পন্থা হল দালালি ও গণিকালয়ের মালিকানা সহ সব ধরনের যৌন-পরিসেবাকে বৈধ ঘোষণা করা। এর ফলে যৌনকর্মীদের মারধোর, যৌন নির্যাতন, অকারণে গ্রেপ্তার, ব্ল্যাকমেল, নারী পাচার ও জোর করে এইডস পরীক্ষার ঘটনা কমবে, বলে অ্যামনেস্টির ধারণা। কাজেই অ্যামনেস্টির মহাসচিব সলিল শেট্টি একটি ‘ঐতিহাসিক দিনের কথা বলেন।
তবে ডাবলিনের এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার আগে থেকেই অ্যামনেস্টির অভিপ্রায় জ্ঞাত ছিল এবং অপরাপর বহু নারী অধিকার গোষ্ঠী সমালেচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘Coalition Against Trafficking in Women’ বা নারী পাচার বিরোধী জোটের কার্যনির্বাহী পরিচালক তাইনা বিয়্যাঁ এইমের মতে, যৌনকর্ম সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যকলাপ অপরাধের তালিকা থেকে অপসারণ করার অর্থ দালালদের Business-man’-এ পরিণত করা, যাতে তাঁরা নির্বিচারে অসহায়দের ‘বেচতে পারে। ডাবলিনের ভোটের আগেই নারী পাচার বিরোধী জোট একটি খোলাচিঠিতে সাবধান করে দিয়েছিল যে, এর ফলে অ্যামনেস্টির ভাবমূর্তি ‘বিশেষভাবে মলিন’ হবে। সিএটিডাব্লিউ-এর অনলাইন পিটিশনে ইতিমধ্যেই হাজার হাজার স্বাক্ষর পড়েছে। যাঁরা স্বাক্ষর করেছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন মেরিল স্ট্রিপ, কেট উইন্সলেট এবং এমা থমসনের মতো হলিউড তারকারাও আছেন।
নারী অধিকার গোষ্ঠী ‘Equality Now’-এর নারী পাচার বিরোধী কর্মসূচির পরিচালক এশোহে আঘাটিসে বলেছেন—“বাণিজ্যিক যৌনসম্ভোগের চাহিদা বাড়ার ফলেই নারী পাচার বাড়ে। তখন হঠাৎ নীতি বদলে বলতে পারে না যে, যাঁরা সেই চাহিদা বাড়াচ্ছে, চলো তাদেরই সুরক্ষা দেওয়া যাক।” তাই বিয়্যাঁ এইমও বলেছিলেন—শোষিতদের রক্ষা করার জন্য শোষণকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। অপরদিকে অ্যামনেস্টি বলছে—‘Forced Labour’ বা বেগার খাটানো কিংবা যৌন শোষণের জন্য নারী পাচার ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
বিষয়টি এমনই বিতর্কিত যে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আইনকানুন চালু আছে। আইসল্যান্ড, সুইডেন এবং নরওয়েতে যৌনকর্মীদের পরিবর্তে তাঁদের গ্রাহকদেরই অপরাধী হিসাবে দেখা হয়। সম্প্রতি ফ্রান্সও যে পন্থা অবলম্বন করার চেষ্টা করছে। ইউরোপের বহু দেশে গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ। অপরদিকে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড এবং আরও কয়েকটি দেশে তা সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রিত।
কলকাতার সোনাগাছিতে ‘ঊষা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। সোনাগাছির যৌনকর্মীদের জন্য এই সংস্থাটিও অভূতপূর্ব কাজ করছে। ঊষা কো-অপারেটিভ সম্পর্কে আরও একটু জেনে রাখা প্রয়োজন আমাদের। এই প্রতিষ্ঠানের একটা ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস জানতে আমাদের একটু পিছন দিকে যেতে হবে। উষা কো-অপারেটিভের যাত্রা শুরু ১৯৯৫ সালের ২১ জুন। শুধু পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতাই নয়, সারা ভারত মায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম যৌনকর্মীদের কো অপরেটিভের বিস্তার। যৌনকর্মী সদস্যদের আর্থিক কল্যাণের উদ্দেশ্য মাথায় রেখেই এ পথ চলা। তার পরের ইতিহাস দীর্ঘ ২৩ বছরের এক উত্থানের ইতিহাস রচিত হয়ে গেল। ১৯৯৫-৯৬ সালে যে সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৯৪ জন, সেই সংখ্যা ২০১২-১৩ সালে এসে দাঁড়াল ১৯ হাজার ৭২২ জন। এই সংখ্যাটা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৯৯২ সালে ‘All India Institute of Hygiene and Public Health’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সহায়তায় সোনাগাছি অঞ্চলে যৌনস্বাস্থ্য প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। উদ্দেশ্য, যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যসচেতন করে তোলা। যৌনকর্মীদের ঘরে ঘরে গিয়ে এইডস সহ বিভিন্ন যৌনরোগ এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা বোঝাতে শুরু করেন। এর সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে শিখল শুধু স্বাস্থ্যসচেতন হলেই চলবে না, প্রয়োজন অর্থনৈতিক সুরক্ষা।
একসময় অভাব-অনটনের সময় কিস্তিওয়ালা সুদখোরদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হত এবং সেই ঋণ শোধ করতে দম বেরিয়ে যেত। পথে বসার উপক্রম হত। এহেন এক পরিস্থিতিতে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সদস্যদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে ‘উষা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি। উষা কো-অপারেটিভ প্রথমদিকে কলকাতা সহ হাওয়ার পৌর এলাকায় কাজ করার অধিকার পেলেও পরে ২০০৯ সালে উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ এই চারটি জেলাতেও কাজ করার অধিকার পায়। অবশ্য ২০০১ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত যৌনকর্মীরাই চাইছিলেন উষার ছায়াতলে ঠাঁই পেতে। নানা আবেদন নিবেদনের পর পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সমবায় মন্ত্রী রবীন্দ্র ঘোষ যৌনপল্লি এলাকায় যৌনকর্মীদের কো-অপরেটিভ গড়ে তোলার অনুমোদন দেন। উষা কো-অপারেটিভ ব্যাংক আজ যৌনকর্মীদের নিজস্ব ব্যাংক। ভুলে গেলে চলবে না, এই কো-অপারেটিভ গড়ে ওঠার আগে কোনো ব্যাংকই যৌনকর্মীদের টাকা জমা রাখত না। পেশা আর ঠিকানাই যৌনকর্মীদের কষ্টার্জিত অর্থ থেকে কিছুটা সঞ্চয় করে রাখার অধিকার দিত না। এখনও সেই অধিকার পাওয়া যায়নি। ফলে প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত অর্থ নিজেদের কাছেই রাখতে হত এবং সেটা খরচও হয়ে যেত। প্রয়োজনের সময় ঋণ করা ছাড়া কোনো উপায়ই থাকত না। উষা কো-অপারেটিভ ব্যাংক যৌনকর্মীদের সেই সমস্যার সুরাহা এনে দেয়। শুধু সঞ্চয়ই নয়, প্রয়োজনের সময় সহজ শর্তে ঋণও পেতে পারে যৌনকর্মীরা। সেভিংস ডিপোজিট (বার্ষিক সুদের হার ৫ শতাংশ), খ্রিফট ফান্ড (বার্ষিক সুদের হার ৭ শতাংশ), রেকারিং ডিপোজিট (বার্ষিক সুদের হার ৯.০৬ শতাংশ), মাসিক আয় প্রকল্প (বার্ষিক সুদের হার ৮ শতাংশ), স্থায়ী জমা প্রকল্পে (৮ বছর ৫ মাসে ডাবল)। ১৯৯৫-৯৬ সালে আমানত জমা পড়েছিল মাত্র ৩ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ সালে এসে আমানত বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়াল ১৬২৫ লাখে।