পশ্চিমবঙ্গে যৌনকর্মীদের সন্তানদের আত্মসম্মান রক্ষার লড়াইয়ের জেরে প্রতি বছর এখন মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক মিলিয়ে ৩০ জনের বেশি সফল হচ্ছেন। যৌনকর্মীদের সন্তানরাও এখন চাকরি করছেন। তেমনই শুধুমাত্র শিক্ষা নয়, তার সঙ্গে ফুটবল সহ বিভিন্ন ধরনের খেলা এবং নাচ-গান-ছবি আঁকা সহ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও পদাতিকের মাধ্যমে যুক্ত আছেন যৌনকর্মীদের সন্তানরা। ডাক্তার স্মরজিৎ জানার কথায়, “আমরা পদাতিকের মতো যৌনকর্মীদের সন্তানদের এত বড়ো মাপের সংগঠন আর কোথাও নেই। তবে সমাজের বিভিন্ন অংশে এখনও বিভিন্ন ধরনের হুঁত্সর্গ রয়েছে। যৌনকর্মীদের সন্তানরাও বিভিন্ন ধরনের হুঁৎমার্গ থেকে মুক্ত নয়। সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যৌনকর্মীদের সন্তানদের যুক্ত হওয়ার বিষয়টি সার্বিকভাবে তখনই সফল হবে, যখন বিভিন্ন ধরনের হুঁৎমার্গ থেকে তাঁরা মুক্ত থাকতে পারবেন।” সাধারণ মানুষের মানসিকতা উন্নত না-হলে, কীভাবে বিভিন্ন ধরনের ছুঁৎমার্গ থেকে মুক্ত হবে সমাজ?
তবে যৌনকর্মীদের সন্তানদের পড়াশোনা শেখানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা অন্য পেশায় যেতে পারে, স্বাবলম্বী হয়। যৌনকর্মীর সন্তানেরা যাতে কোনোভাবে সমাজে নিজেদের অচ্ছুৎ বা অপাংক্তেয় না মনে করতে পারে, সেজন্য খুব জরুরি ছিল এই উদ্যোগ। এখন যৌনকর্মীর সন্তানেরাও মূল ধারার স্কুলে ভর্তি হচ্ছে। তাদের নিজস্ব একটা ফুটবল দল হয়েছে, যে দল গত বছর তৃতীয় ডিভিশনে খেলার পর দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলার যোগ্যতামান পার করেছে।
শিশুর বড়ো হয়ে ওঠার সঙ্গে অনেকগুলো জিনিস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। শিক্ষা তেমন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তেমনই দরকার সঠিক পরিবেশটাও। সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ বা সমাজের সঙ্গে যোগ না-থাকলে শিশুদের বড় হওয়ার সঙ্গে খারাপ সঙ্গ বা ভুল পথে চলে যাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকে বলে মনে করেন চাইল্ড সাইকোলজিস্টরা। যৌনকর্মীদের সন্তানদের ভুল পথে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি থাকে। অনেকেই এমন আছে যারা জানেই তার বাবা কে! কিন্তু মা আছে। পেটের টানে তিনি এমন জায়গায় এসে পড়েছেন যে সেখান থেকে আর বেরোবার জায়গা নেই। দুই কুঠুরির ঘরে ভালো করে বসার জায়গাও থাকে না যৌনকর্মীদের। এর মধ্যেই অহোরাত্র কাস্টমারদের যাতায়াত লেগেই আছে। এর মধ্যে পড়াশোনা শিখে আলোর পথ দেখার সম্ভাবনা কম। এমনটাই জানাচ্ছে দুর্বার সমন্বয় সমিতির প্রধান ডঃ স্মরজিৎ জানা। তার চেষ্টাতেই দুর্বারের বারুইপুর হোমে আরও বড় ঘরে থাকার সুযোগ পাচ্ছে যৌনকর্মীর সন্তানরা। শিশু দিবসে এটাই হতে চলেছে ওদের গিফট। যেমন রফিক মণ্ডল জানাল, “আমাদের পড়াশোনার জায়গা ছিল না, এই হোম পাওয়ার পর আমাদের খুব সুবিধা হয়েছে।” আগে যে জায়গা ছিল সেখানে মাত্র ৩০ জনের থাকার। জায়গা। বারুইপুরের বাড়িতে আরও ৭০ জন যৌনকর্মী সন্তানের থাকার সুযোগ হবে। ওই সব ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের মায়েরা মীনা সর্দার, সুনীতা অধিকারী, আলোরানি বিশ্বাসরাও খুবই খুশি এই সুবিধা পেয়ে।
যৌনকর্মীদের পল্লিতেও স্কুল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হল। যৌনকর্মীদের পল্লি এলাকায় শিশু ও বয়স্কদের স্কুল খোলায় উদ্যোগী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের সমাজ নগরে প্রায় ৫০ জন যৌনকর্মী রয়েছেন। পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় ৩০-৩৫ জন। তাদের জনা পনেরো স্কুল যায় না। তার কারণ যৌনকর্মীর সন্তান হওয়ায় স্কুলে গেলে সহপাঠীদের কাছ থেকে নানা কটুক্তি শুনতে হয়। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির তরফে ২০০৫ সালে বিদ্যাসাগর সর্ব শিক্ষা বিদ্যালয় চালু করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থের অভাবে তা এখন বন্ধ। উদ্যোক্তারা এলাকায় স্কুলের প্রয়োজন আছে। শিশু ও বয়স্করা যাতে পড়াশোনা করতে পারে, সে চেষ্টা করা হবে। সঙ্গে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা রাখা হবে। সে জন্য এলাকায় একটি ঘরের দরকার। তিনি বলেন, “আমার চেষ্টা শুরু করেছি। আশা করছি শীঘ্রই স্কুল চালু করা যাবে।” অভিভাবক মঞ্চের সম্পাদক ল্যারি বসু জানান, “২০০৫ সালে একটি স্কুল শুরু করেছিলেন তাঁরা। অর্থাভাবে তা পরে বন্ধ হয়ে যায়। পরে স্কুল চালু করার প্রতিশ্রুতি দেন।” এলাকার বাসিন্দা তথা দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সদস্য শিপ্রা সিংহ জানান, এই পল্লির অধিকাংশ বাচ্চা বাইরের স্কুলে পড়তে চায় না। তিনি বলেন, “এলাকায় স্কুল হবে শুনে ভালো লাগছে।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যৌনকর্মীরা জানান, “আমাদের সন্তানদের সমাজ ভালো ভাবে নেয় না। হাসি ঠাট্টা করে। এলাকায় স্কুল হলে তারা পড়াশোনা করতে পারবে।”
যৌনকর্মীদের উপর নির্যাতনের শেষ নেই, যা বলে শেষ করার নয়। এমনকি যৌনদস্যুদের অত্যাচারেও গণিকারা অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। বছর ঘুরে আন্তর্জাতিক নারী দিবস আসে যায়। কিন্তু যৌনকর্মীদের জীবনে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের কোনো প্রভাব পড়ে না। দিনদিন যৌনদস্যুদের লাগাতার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে বিভিন্ন যৌনপল্লির যৌনকর্মীরা। যৌনকর্মীদের সুত্রে জানা যায়, পেট বাঁচাতেই তাঁরা এ পেশায় এসেছে। ভ্রাম্যমান যৌনকর্ম করে কোনোমতে তাঁরা দিন যাপন করে। একদল যৌনদস্যু তাঁদেরকে বারবার ঠকিয়ে মানবেতর জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাঁরা জানান ওই সমস্ত যৌনদস্যু খদ্দের সেজে তাঁদের সঙ্গে চুক্তি করে খদ্দেরদের পছন্দমতো স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পরেই ঘটে বিপত্তি। যৌনকর্মীরা জানান, চুক্তি অনুযায়ী যতজন খদ্দের সেখানে থাকার কথা থাকে তার চেয়ে অনেক বেশি। ভুয়ো খদ্দের সেজে যৌনদস্যুরা তাঁদেরকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে মনমতো ভোগ করার পর কখনো নামমাত্র কিছু টাকা দেয়, কখনো-বা খালি হাতে মারপিট করে ফিরিয়ে দিচ্ছে। যৌনকর্মীরা তাঁদের ন্যায্য মূল্য চাইলে তাঁদেরকে এলাকা থেকে উচ্ছেদসহ নানাপ্রকার হুমকি প্রদান করে থাকে। সামাজিকভাবে তাঁদের অবস্থান ক্ষীণ হওয়ায় তাঁরা কারও কাছে বিচার চাইতে গেলে উলটো তাঁদেরকে এলাকা ছাড়তে বলা হয়। এলাকায় ভুয়ো খদ্দের নামক যৌনদস্যুদের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে কে খদ্দের আর কে যৌনদস্যু তা বুঝতে পারছে না যৌনকর্মীরা। একেক বার একেক জন তাঁদের সঙ্গে চুক্তি করলেও ঘটনাস্থলে পরিচিত বেশ কিছু যৌনদস্যুর কবলে তাঁরা বারবার পড়ছে বলে। দেশের বিভিন্ন শহরে যৌনকর্মীদের জীবন মানোন্নয়নে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও মফস্বল এলাকাগুলির যৌনপল্লিতে কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করে না। যৌনকর্মীদের দাবি এলাকার মানুষ যৌনবৃত্তিকে পাপ আর যৌনকর্মীদেরকে পাপী হিসাবে দেখে, ঘৃণা করে। কিন্তু যেসব যৌনদস্যু প্রতারণার মাধ্যমে বিনামুল্যে তাঁদের পাপী শরীরগুলোকে ভোগ করছে সমাজপতিরা তাঁদের দিকে একবারও নজর দিচ্ছে না, বরং এটাকে ভালো কাজ হিসাবেই দেখছে।