চালু এই ব্যবস্থার জন্য চড়া মাসুল মাশুল দিচ্ছেন যৌনকর্মীদের সন্তানরা। কারণ চালু এই ব্যবস্থার জেরেও সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। অথচ এখনও পর্যন্ত তাঁরা সমস্যারই সমাধান করতে পেরেছেন। সেই তুলনায় আবার অনেকে পিছিয়ে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বাইরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের যৌনকর্মীদের সন্তানরা। তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের যৌনকর্মীদের সন্তানরাও যাতে সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন, এ বার সেই প্রচেষ্টাই জারি রাখতে চলেছেন পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীদের সন্তানরা। কোন্ পথে, কীভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের যৌনকর্মীদের সন্তানদের একজোট করা সম্ভব হতে পারে? কীভাবেই-বা সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করানোর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের সামিল করানো সম্ভব হতে পারে সেই ভাবনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীদের অন্যতম সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি। এই সংগঠনের অধীনেই আছে পশ্চিমবাংলা যৌনকর্মীদের সন্তানদের সংগঠন ‘আমরা পদাতিক’। তাঁরা লড়াই জারি রেখেছে। তবে এখনও অনেক পথ চলার বাকি থেকে গিয়েছে। যে কারণে একদিকে যেমন আরও পথ চলার জন্য অঙ্গীকার আছে। তেমনই অন্যদিকে আবার পশ্চিমবঙ্গের বাইরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের যৌনকর্মীদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে পথ চলার স্বপ্ন এবং লড়াইও রয়েছে।
শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ নয়। সমাজের প্রান্তিক অংশের বাসিন্দা হিসাবে অন্যান্য রাজ্যের যৌনকর্মীদের সন্তানদেরও যদি সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করানোর জন্য প্রচেষ্টা জারি রাখা না-হয়, তাহলে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দেশের প্রান্তিক অংশের বাসিন্দারাই। দেশের অন্য রাজ্যগুলির যৌনকর্মীদের সন্তানরাও যাতে পদাতিকের মতো কোনো সংগঠনের অধীনে থেকে সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রয়াস জারি রাখতে পারে, সেই জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে পদাতিক। এখনও অনেক সমস্যা আছে। ওই সব সমস্যার মধ্যে অন্যতম হল সমাজের চালু ব্যবস্থা। এই সংস্কৃতির কারণে সন্তানের পরিচয় হিসাবে প্রথমেই পিতার নাম জানতে চাওয়া হয়। যৌনকর্মীদের সন্তানদের অনেকেই জানেন না তাঁদের পিতার নাম। যে কারণে সমাজের চালু এই ব্যবস্থার জন্য বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে যৌনকর্মীদের সন্তানদের। সেইজন্য স্কুল-কলেজ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কখনও অপমানিত, কখনও আবার হয়রানির শিকার হচ্ছেন যৌনকর্মীদের সন্তানরা। যে কারণে সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে পিতৃপরিচয়ও সমস্যা হিসাবে দেখা দিচ্ছে। সন্তানের পরিচয় হিসাবে পিতা এবং মাতা দুজনের নামই নেওয়া যায়। কিন্তু সমাজের চালু ব্যবস্থার জন্য আগে পিতার নাম জানতে চাওয়া হয়। এই বিষয়টি মোকাবিলার জন্য আইনের বদল প্রয়োজন। আইন বদল করে প্রতিটি ক্ষেত্রে সন্তানের পরিচয় হিসাবে প্রথমে মায়ের নাম নেওয়ার বিষয়টি চালু হওয়া প্রয়োজন। অথবা পিতা বা মাতা যে-কোনো একজনের নামেই চলুক। বিশেষ করে আমাদের দেশ সহ বিশ্বের বহু দেশে সিঙ্গেল মাদার আছেন, তাঁদের সন্তানদেরও মাতার নামই সম্বল। আছে ধর্ষিতার সন্তানেরা, তাঁরা কেন পিতৃপরিচয় দিতে যাবেন? যদি পিতা বা মাতা যে কোনো একজনের নাম উল্লেখ করে সন্তানদের পরিচয় সম্পূর্ণ করতে পারে, তাহলে সার্বিকভাবে সমাজেরই মঙ্গল হবে। কলকাতার বিভিন্ন যৌনপল্লিতে যেভাবে যৌনকর্মীদের সন্তানরা আছেন, সেই তুলনায় আবার বেশি সমস্যায় আছেন কলকাতার বাইরে এ রাজ্যের বিভিন্ন যৌনপল্লির যৌনকর্মীদের সন্তানরা। কারণ ওইসব যৌনপল্লির অধিকাংশ স্থানেই সমাজবিরোধী তথা দুষ্কৃতীদের দৌরাত্মে যৌনকর্মী এবং তাঁদের সন্তানদেরও বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যে কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাড়িতেই সন্তানদের রেখে আসেন ওই সব স্থানের যৌনকর্মীরা।
তবে শুধুমাত্র যে আইন বদলের মাধ্যমে সন্তানের পরিচয় হিসাবে প্রথমে মায়ের নাম নেওয়ার দাবিই জানানো হচ্ছে, তা নয়। কারণ সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যৌনকর্মীদের সন্তানদের যুক্ত করানোর সঙ্গে নীতি-নির্ধারণের বিষয়টিও জড়িত আছে। ডাক্তার স্মরজিৎ জানা বলেন, “বাল্যবিবাহ রোধ এবং শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি সহ বিভিন্ন অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারি নীতি-নির্ধারক কমিটিগুলিতে যৌনকর্মীদের সন্তানদের প্রতিনিধি রাখার জন্য আমাদের দাবি আছে। কারণ নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে যদি যৌনকর্মীদের সন্তানদের তরফে প্রতিনিধি রাখা না-হয়, তাহলে যথাযথ নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রেও সমস্যা বাড়ে বই কমে না।” একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, “আমরা পদাতিক’ শুধুমাত্র যৌনকর্মীদের সন্তানদের স্বার্থরক্ষার কথা বলে না। বরং সার্বিকভাবে শিশুদের অধিকার রক্ষার জন্যই লড়াই জারি রেখেছে এই সংগঠন। বাল্যবিবাহ রোধ সহ বিভিন্ন ধরনের মাদক দ্রব্যের ব্যবহার, শিশুদের উপর হিংসাত্মক ঘটনার বিরুদ্ধে এবং শিশুদের অধিকার রক্ষার বিশ্বজুড়ে আন্দোলনের শরিক ‘আমরা পদাতিক’।