উপরি প্রাপ্তি হিসাবে ভারতের বেশির ভাগ যৌনকর্মী কোনো না-কোনো যৌনরোগে প্রায়ই ভুগতেন। আজকাল তাঁদের অনেককেই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু যৌন-সংসর্গের মাধ্যমে এইচআইভি নামক ভাইরাস শরীরে সংক্রামিত হলে যে মারণরাগ এইডসের উৎপত্তি হয়, তার কোনো প্রতিষেধক টিকা ওষুধ এখনও বেরোয়নি। যৌনকর্মীরাই এইডসের সবচেয়ে বড়ো শিকার। সেই অসুখ ছড়িয়ে পড়ে খদ্দেরদের মধ্যে। কারণ নিছক জীবিকার জন্য তাঁদের অনেক খদ্দেরকে যৌনতৃপ্তি দিতে হয় এবং বেশিরভাগ খদ্দের কণ্ডোম ব্যবহার করতে চান না। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন আর কেউ কন্ডোম ছাড়া যৌনকর্ম করতে পারবে না। ফলে যৌনরোগের প্রাদূর্ভাব অনেকটই কমেছে।
এইডস নিবারণ প্রকল্পের সহায়তায় যেসব যৌনকর্মীরা কন্ডোম ব্যবহারের অপরিহার্যতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন হয়েছেন। তবে দরিদ্র যৌনকর্মীদের মধ্যে দারিদ্রতার কারণে কন্ডোম ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক খদ্দেরকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না। সেজন্য ভারতের কিছু শহরের লালবাতি এলাকায় যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচ আই-ভি/এডসের প্রসার ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে এবং তার ফলে তাঁদের খদ্দেরদের মধ্যেও বাড়ছে। এইচআইভি আক্রান্ত খদ্দেরদের মাধ্যমে তাঁদের স্ত্রীদের শরীরেও এই ভাইরাস সংক্রামিত হচ্ছে। আবার স্ত্রীদের মাধ্যমে তাঁদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সন্তান এই ভাইরাসের শিকার হচ্ছে।
১৯৯০ দশকের প্রথম থেকে ভারতের কিছু শহরের লালবাতি এলাকায় যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি/এইডস নিবারক প্রকল্প কার্যকারী হয়। কলকাতার সোনাগাছি এলাকায় যৌনকর্মীদের মধ্যে শুরু হয় ১৯৯২ সাল থেকে। এই প্রকল্পের একটি অঙ্গ হিসাবে ওই এলাকার কিছু বাছাই করা যৌনকর্মীকে এইচআইভি/এইডস পরীক্ষা, কন্ডোম ব্যবহার ইত্যাদি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়ে পিয়ার এডুকেটর হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। রোজ কিছু সময় অন্যান্য যৌনকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের এইচআইভি/এইডস সম্বন্ধে সচেতন করা ও কন্ডোম ব্যবহারের পদ্ধতি ইত্যাদি শিখিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে একটি মাসোহারা বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পিয়ার এডুকেটররা বুঝতে পারলেন যে, যৌনকর্মীরা তাঁদের খদ্দেরদের সঙ্গে যৌন সংসর্গের সময়ে কন্ডোম ব্যবহার করতে যথেষ্ট আগ্রহী হলেও, খদ্দেররা সাধারণভাবে তা করতে একেবারেই অনিচ্ছুক। এটাও বুঝতে পারলেন যে, কোনো যৌনকর্মী তাঁর কন্ডোম ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক খদ্দেরকে প্রত্যাখ্যান করলে, সেই খদ্দেরের পক্ষে একটু বেশি টাকা খরচ করলে কন্ডোম ব্যবহার না-করেই যৌনকর্মে রাজি এরকম যৌনকর্মীকে আশেপাশেই পাওয়া শক্ত হয় না। ফলে কন্ডোমের ব্যবহারের অনুপাত প্রায় কিছুই বাড়ছিল না। যদিও এই মুহূর্তে যে-কোনো যৌনপল্লিতেই কন্ডোম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। কন্ডোম ছাড়া কোনো যৌনকর্মীই যৌনকর্ম করেন না। ফলে এইডসের প্রাদুর্ভাব এখন অনেকটাই নির্মূল হয়েছে। যৌনপল্লির মেয়েরা এটা বুঝেছে, কন্ডোম শুধু যৌনরোগ থেকেই মুক্তি দেয় না, মুক্তি দেয় অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ থেকে, মুক্তি দেয় ঘনঘন অ্যাবরশন থেকে, মুক্তি দেয় নিয়মিত গর্ভনিরোধক পিল খাওয়া থেকে। এমনকি তাঁদের যৌনাঙ্গের ভিতর-বাইরে পুরুষের বীর্যে মাখামাখি ও ধৌতকরণ থেকেও মুক্তি মিলল।
ডা. স্মরজিৎ জানা, যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটিকে। কিছু সাফল্য অবশ্যই এসেছে। যেমন সোনাগাছির যৌনকর্মীদের যে সমবায় তহবিল, সেই ‘উষা কোঅপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেড’-এ নিবন্ধিকরণ করা গেছে যৌনকর্মীদের নামেই। এটা একটা বিরাট বড়ো সাফল্য, যেহেতু যৌনপেশা এখনও পূর্ণ বৈধ বৃত্তি বলে স্বীকৃত নয় ভারতের আইনে। কিন্তু ওই মূল জায়গাটায় সমস্যা থেকে গেছে। বহু উদ্যোগ সত্ত্বেও যৌনবৃত্তিকে বৈধ পেশায় স্বীকৃতি দেওয়া যায়নি। এ নিয়ে আইন সংশোধনের কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। যেমন যৌনকর্মীর সন্তানদের জন্য বারুইপুরে একটি হোস্টেল চালু হয়েছে, যেখানে থেকে সাধারণ স্কুলে, আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্চার সঙ্গে পড়াশোনা করতে পারবে তারা। আলাদা পরিবেশে থেকে। কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তো এখনও বদলায়নি। ফলে কোনো শিক্ষকই হয়তো ঘুরিয়ে এমন কোনো একটা খোঁচা দিয়ে দিলেন যে, বাচ্চাটির খারাপ লাগল। যে কারণে স্কুল থেকে ‘ড্রপ আউট’-এর সংখ্যাও খুব বেশি।
পিতৃপরিচয় ছাড়া শিশুদের স্কুলে নেওয়া হত না। যৌনকর্মীদের সন্তানদের কোনো পিতৃপরিচয় নেই। একমাত্র মা তাঁদের অভিভাবক। তাহলে কি যৌনকর্মীর সন্তানদের পড়াশোনার অধিকার থাকবে না? পড়াশোনা করে নিজের পছন্দের পেশায় নিযুক্ত হওয়ার অধিকার থাকবে না? সকলের জন্য শিক্ষা’—এই শ্লোগানের মাহাত্ম্য কী? যৌনকর্মীদের সন্তানদের অপরাধ কি কেবল তাঁর মা যৌনকর্মী বলে? পল্লিগুলি বাস করা একজন যৌনকর্মীর তো স্বামী থাকে না। তা ছাড়া সেই সন্তানের প্রকৃত পিতা কে তাও জানা সম্ভব নয়। আর জানা গেলেও সেই পুরুষ পিতৃত্ব স্বীকার করতে বাধ্যও নয়। অবশ্য যাঁরা নিজের বাড়ি থেকে বিশেষত বিবাহিতরা (নিজ সংসার সামলে) যৌনপল্লিতে বা অন্যত্র যৌনকর্ম করেন, তাঁদের পিতৃপরিচয়ের সমস্যা হয় না। কারণ তাঁদের কারোর স্বামী আছে, অথবা বিধবা, অথবা ডিভোের্স। সমস্যা হয় যৌনপল্লিতে স্থায়ীভাবে বাস করা যৌনকর্মীদের।