১৯৯২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স এন্ড পাবলিক হেস্থের একজন জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ডঃ স্মরজিৎ জানা এইচআইভি সম্পর্কিত গবেষণার জন্য সোনাগাছির নিষিদ্ধপল্লি এলাকা পরিদর্শন করেন। একটি সমগোত্রীয় শিক্ষা দল যৌনকর্মীদের মধ্যে থেকে গঠিত হয় এবং তাঁদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। অল্প কিছুদিন পরে গবেষণায় যৌনকর্মীদের মধ্যে যৌন বিষয়ক অধিকার, তাঁদের সন্তানদের শিক্ষা, আর্থিক পরিসেবাগুলির সুবিধা এবং পুলিশ এবং স্থানীয় গুণ্ডাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হওয়ার সমস্যাগুলি উঠে আসে, সঙ্গে নিরাপদ যৌনসঙ্গমের স্বার্থে কন্ডোম ব্যবহারের প্রসার ঘটানো হয়। এভাবে ১৯৯৫ সালে তিনি ১২ জন যৌনকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার মহিলা সমিতি কমিটি’ (ডিএমএসসি) গঠন করেন। ২০১২ সালের মধ্যে ডিএমএসসি পশ্চিমবঙ্গের ৪৮টি শাখার মধ্য থেকে ৬৫ হাজার সদস্যের সদস্যপদ লাভ করে এবং যেগুলি যৌনকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাঁদের সন্তান এবং সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের বোর্ড সদস্য হিসাবে থাকেন। কেবল নারীই যৌনকর্মীই নয়, বরং পুরুষ এবং ট্রান্সজেন্ডার যৌনকর্মীরাও এতে সদস্য হন। গণিকাপেশায় আসতে ইচ্ছুক এমন কোনো মেয়েই এই বোর্ডকে এড়িয়ে তাঁর পেশা শুরু করতে পারবে না। এই বোর্ডেই যাচাই করা হয় বয়স (নাবালিকা কি না। সেক্ষেত্রে ১৮ উপরে বয়স হতে হব। বয়সের প্রমাণপত্র না-থাকলে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে বয়স জেনে নেওয়া হয়), এই পেশায় আসতে কেউ বাধ্য করেছে কি না জানতে চাওয়া হয়, পাচারকৃত কি না জানা হয় ইত্যাদি।
দুর্বার এসটিডি/এইচআইভির ইন্টারভেন্সন প্রোগ্রাম (সাধারণত সোনাগাছি প্রকল্প নামে পরিচিত) ১৯৯৯ সাল থেকে চালু হয়। সোনাগাছি প্রকল্পের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা All India Institute of Hygiene and Public Health’, যেটি কলকাতার অবস্থিত একটি কেন্দ্রীয় সরকারি ‘Public Health Training and Research Institute’, যাঁরা ১৯৯২ সালে এই প্রোগ্রামটি শুরু করে তাঁদের থেকে ডিএমএসসি কর্তৃক গৃহীত হয়। ১৯৯৯ সালে এসটিডি/এইচআইভি ইন্টারভেনশন প্রোগ্রাম নিয়ন্ত্রণ লাভের পর ডিএমএসসি পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য নিষিদ্ধ এলাকায় সোনাগাছি মডেলের অনুসরণ করা শুরু করেন।
‘শ্রমিকের অধিকার চাই’—আন্তর্জাতিক শ্রমদিবসে সোনাগাছিতে এই শ্লোগান তুলে পদযাত্রা করেন কয়েক হাজার যৌনকর্মী। ওই মিছিলে তাঁদের সন্তান ও অন্যান্য সংঠনের সদস্যরাও হাজির থাকেন। প্রতি বছর ১ মে সোনাগাছিতে নিজেদের কাজও বন্ধ রাখেন যৌনকর্মীরা। এই দাবি নিয়েই গত কয়েকবছর ধরে লাগাতার আন্দোলন করে চলেছেন সোনাগাছি সহ রাজ্যের অসংখ্য যৌনপল্লির কর্মীরা। শরিতা দশ বছর ধরে থাকেন মহানগরের এই যৌনপল্লিতে। সোনাগাছির বহু ঘটনার সাক্ষী শরিতা। তিনি অভিযোগ করেন—“এখনও সমাজে নানা ধরনের অত্যাচার আমাদের সহ্য করতে হয়। কখনও চাঁদার জুলুম তো কখনও মাস্তানের চোখরাঙানি। তা ছাড়া পুলিশের বিভিন্ন ধরনের অত্যাচারও আছে। এসব জ্বালাতন সঙ্গে করেই আমাদের চলতে হয়। কিছু ঘটনা অন্তরালেই থেকে যায়। অনেকে পাশে থাকার কথা বললেও লড়াইটা অনেক ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদেরকেই করতে হয়। এত কিছু সত্ত্বেও এখনও আমরা শ্রমের স্বীকৃতি পেলাম না। আমাদের দাবি সরকারি শ্রমদপ্তরে ‘যৌনকর্মী হিসাবে আমাদের নথিভুক্ত করতে হবে। এটা আমাদের অন্যতম মূল দাবি। জানি না কবে মিলবে আমাদের অধিকার”।
আন্দোলনের কিছু ফল যে মেলেনি তা নয়। সোনাগাছি সহ রাজ্যের বিভিন্ন যৌনপল্লির যৌনকর্মীরা সরকারি নানা সুবিধা পাচ্ছেন। আধার কার্ড, রেশন কার্ড, ‘স্বাস্থ্য সাথী’, ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’, ‘সমব্যথী’ ‘সবুজ সাথী’, ‘খাদ্য সাথী’, ‘শিক্ষাশ্রী” সহ অনেক প্রকল্পেরও অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু এখনও শ্রমিকের অধিকার পাননি তাঁরা। এটাই এখন কুরে কুরে খায় যৌনকর্মীদের। এটাই এখন মূল লড়াই তাবৎ যৌনকর্মীদের। তা ছাড়া ইমমরাল ট্রাফিকিং’ আইনের ফাঁদে পড়েও তাঁদের হয়রানির শিকার হতে হয়। যৌনপল্লিগুলির মহল্লায় মহল্লায় যৌনকর্মীদের এই অভিযোগ। তাঁদের বক্তব্য—“এটা আমাদের পেশা। তবু কেন পুলিশ হয়রান করবে? আর কবে এসব বন্ধ হবে?” ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উদ্যাপন হয়। যৌনকর্মীরা কিন্তু এখনও তাঁরা সরকারিভাবে কর্মী হিসাবে নথিভুক্ত নন। বছরের পর বছর শ্রমিকের মর্যাদা চাই’ বলে দাবি করে আসছেন। মর্যাদা পাননি বলে কিন্তু যৌনকর্মীরা ঘরে বসে নেই। লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে শুধু দাবি বা পদযাত্রা নয়, শ্রম দিবসে তাঁরা কাজও বন্ধ রাখেন। সারা বিশ্বে অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে যখন স্বাভাবিক ছুটি যাপন করেন কর্মীরা, তখন যৌনকর্মীরা শ্রমিকের মর্যাদার দাবিতে কাজ বন্ধ রাখেন। এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষে কাজল বসু বলেন, “আমরা ২৫ বছর ধরে সরকারি শ্রমদপ্তরের তালিকায় যৌনকর্মীদের কর্মী হিসাবে নথিভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছি। তা ছাড়া ইমমরাল ট্রাফিকিং অ্যাক্টের বিভিন্ন ধারা বাতিল করতে হবে।”
ভারতে আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ ঘোষিত যৌনকর্মীদের মোটামুটি এই কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়—(১) লালবাতি এলাকার ভিতরে বা বাইরে যৌনপল্লিতে বসবাসকারী যৌনকর্মী, (২) পথচারী বা ভাসমান যৌনকর্মী, (৩) ছোটোবেলায় পারিবারিক দারিদ্রের জন্য দেবদাসী হিসাবে উৎসর্গীকৃত মেয়েরা, যাঁদের বেশিরভাগকেই পরে যৌনকর্মী হতে বাধ্য হয়, (৪) যাযাবর শ্রেণির মেয়েরা, যাঁদের ছোটোবেলা থেকেই যৌনকর্মী হওয়ার তালিম দেওয়া হয় এবং পরে পারিবারিক অভাব মেটানোর জন্য যৌনকর্মে নিযুক্ত করা হয়, (৫) যেসব মেয়েদের পূর্বপুরুষরা প্রথাগতভাবে পারিবারিক ভরণপোষণের জন্য মেয়েদের নাচগান পরিবেশনের উপর নির্ভর করতেন, তাঁদের অনেকে আজকাল বাইজি, নাচনি ইত্যাদি নামে যৌনকর্মে নিযুক্ত থাকেন, (৬) কলগার্ল বা শৌখিন যৌনকর্মী, যাঁদের অনেকেই মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত। যাঁরা নিজেদের জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর জন্য আংশিক বা পুরোভাবে যৌনকার্যে নিযুক্ত থাকেন, (৭) পুরুষ এবং হিজড়ে যৌনকর্মী, যাঁরা টাকার বিনিময়ে প্রধানত মহিলা, সমকামী বা উভয়কামী পুরুষদের যৌনক্ষুধা মেটান এবং (৮) শিশু যৌনকর্মী, যাঁরা কলগার্ল ছাড়া উপরের সব শ্রেণিরই অন্তর্ভুক্ত এবং যাঁদের বেশির ভাগই ট্র্যাফিকিংয়ের মর্মান্তিক শিকার। বস্তুত বেশিরভাগ যৌনকর্মীকেই ছলে-বলে-কৌশলে যৌনকার্যে নিযুক্ত করা হয়েছে। কেউ কেউ নানা দৈব-দুর্বিপাকে এমন এমন পেশায় মুখে পড়েছেন যে, নিছক বেঁচে থাকার তাগিদে যৌনপেশায় যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। যৌনকর্মীদের প্রতি সামাজিক বিরূপতা বা ঘৃণা এত গভীর ও ব্যাপক যে, যাঁর উপর একবার যৌনকর্মীর ছাপ পড়ে যায় তাঁর পক্ষে সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আসার কোনো উপায় থাকে না। ন্যূনতম মানবিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়ে চরম দারিদ্র্যে, জঘন্য পরিবেশে নানাভাবে নিপীড়িত হয়ে তাঁদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়।