কামসূত্ৰমের ‘বৈশিক’ নামে একটি বিস্তৃত অধিকরণে প্রাচীনকালে ভারতীয় গণিকাদের জীবনযাত্রার একটি সুস্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়। এই বিবরণ থেকেই সাধারণের মনে গণিকাদের সম্পর্কে যে অবজ্ঞা, ঘৃণা এবং অশ্রদ্ধার বিরূপ ধারণা আছে বাৎস্যায়নের উল্লিখিত গণিকাদের জীবনযাত্রার বর্ণনা হৃদয়ঙ্গম করলেই সেই বদ্ধমূল ধারণার বদল হতে পারে।
বাৎস্যায়ন গণিকাদের পরিচয় দিতে গিয়ে কামসূত্ৰমের চতুর্থ অধিকরণের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকে বলেছেন–“বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ”। অর্থাৎ “গণিকাদের পুরুষ-ধরা বিদ্যা এবং অর্থ উপার্জন সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসছে”। দ্বিতীয় শ্লোকে বলেছেন–“রতিতঃ প্রবর্তনং স্বাভাবিকং কৃত্রিমমর্থার্থম্”। অর্থাৎ রুচি হল রতির প্রতিশব্দ। রুচি থেকে যে পুরুষ গ্রহণে প্রবৃত্তি সেটা স্বাভাবিক, আর তা থেকে গণিকাদের যে অর্থোপার্জন প্রবৃত্তি সেটা কৃত্রিম”। এবার গণিকাদের উদ্দেশে তৃতীয় শ্লোকটি পড়ুন–“তদপি স্বাভাবিকবপরেৎ কামপরাসু হি পুংসাং বিশ্বাসযোগাৎ”। অর্থাৎ “তুমি যে পুরুষের কাছে ছল করছ, সেটা যেন বুঝতে না পারে। এমন ভাব দেখাবে যে তুমি তাকে ভালোবাসো, তাঁর অনুরাগিণী–এরকম হলে পুরুষ তোমার হাতের মুঠোয় এসে যাবে”। ষষ্ঠ শ্লোকে বলা হয়েছে–“ন চানুপায়েনার্থান সাধয়েদায়তিসংরক্ষণার্থ”। অর্থাৎ, “পুরুষের কাছে অর্থ উপার্জন করবে, কিন্তু খুব কৌশলে”।
এই পরামর্শই বুঝিয়ে দেয় গণিকাবৃত্তির বৈধতা ছিল, নিন্দনীয় নয়। বাৎস্যায়ন পইপই করে বলে দিয়েছেন কোন্ ধরনের পুরুষ একজন গণিকার কাছে চরম কাম্য হওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ সাদা বাংলায় গণিকারা কোন্ ধরনের পুরুষদের সঙ্গ দিলে মোটা টাকা মিলবে। তৎকালীন সময়ে গণিকারা প্রভাবশালী ও ধনীদেরই শয্যাসঙ্গিনী হতেন। এখনও এমন এক গণিকাশ্রেণি আছেন, যাঁরা কেবলমাত্র প্রভাবশালী ও ধনীদের বিলাসবহুল কক্ষে শয্যাসঙ্গিনী হন মোটা অর্থের বিনিময়ে। তবে তা খুব সংগোপনে।
যাই হোক, দেখা যাক বাৎস্যায়ন গণিকাদের কেমন শয্যাসঙ্গী পছন্দ করতে বলেছেন। যেমন–(১) ধনী তো হতেই হবে, সেইসঙ্গে পুরুষটিকে স্বাধীন হতে হবে। অর্থাৎ পিছুটান নেই এমন পুরুষ। (২) যে ব্যক্তি প্রজাদের কাছ থেকে শুল্কাদি আদায় করে। (৩) ধনীক শ্রেণির যৌন-বিকৃত বৃদ্ধ। (৪) সংঘর্ষবন, অর্থাৎ এক গণিকাকে নিয়ে দুজন ধনীর প্রতিদ্বন্দ্বীর কে কত টাকা দিয়ে তাঁকে নিতে পারে। (৫) সবসময় যাদের হাতে টাকা আসে। যেমন–সুদখোর, কুসীদজীবী ইত্যাদি (৬) যে পুরুষ দেখতে কালো কুৎসিত, অথচ নিজেকে সে রূপবান এবং রমণীরঞ্জন মনে করে।(৭) আত্মশ্লাঘার বড়াই করে এমন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা আদায় করা খুব সহজ। (৮) ধনী, অথচ ধ্বজভঙ্গ বা নপুংসক পুরুষ বিবেচ্য। (৯) বাপ-মায়ের অনাদরের ছেলেকে আদরে ভরিয়ে দিলে প্রচুর অর্থ সমাগমের সম্ভাবনা। (১০) সঙ্গদোষে দুষ্ট বখে যাওয়া যুবক। ইত্যাদি।
কোন পুরুষের সঙ্গে গণিকারা যৌনমিলন করবে না, সে বিষয়েও পরামর্শ দিতে ভোলেননি বাৎস্যায়ন।যেমন–(১) যক্ষ্মারোগ (টিউবারকুলাইসিস) হয়েছে এমন পুরুষ। (২) কুষ্ঠরোগাক্রান্ত (লেপ্রসি) পুরুষ। (৩) যে ব্যক্তির বীর্যের সঙ্গে ক্রিমি জাতীয় একপ্রকার ক্ষুদ্র কীট (বোঝাই যাচ্ছে এখানে বিশেষ কোনো যৌনরোগের কথাই বলা হয়েছে) থাকে, যা নারীর যোনির ভিতর দিয়ে জরায়ুতে পৌঁছে নারীকে জরাগ্রস্ত করবে। (৪) কঠোর ও কর্কশভাষী। (৫) কঞ্জুষ বা কিপটে। (৬) নির্মূণ। (৭) গুরুজনের পরিত্যক্ত পুরুষ। (৮) চোর। (৯) বিশ্বাসঘাতক। (১০) যে পুরুষের মুখে দুর্গন্ধ। (১১) যে পুরুষ বশীকরণ জানে। (১২) বঞ্চক ইত্যাদি।
সব ঠিক থাকলে তবেই একজন গণিকা “বর্তমানং নিষ্পীড়িতার্থমুৎস্যজন্তী বিশীর্ণেন সহ সন্ধ্যাৎ”–একজন পুরুষের অর্থ নিঃশেষ করে ছিবড়ে করে তারপর আর-একজন অর্থবান পুরুষকে পাকড়াও করবে। (কামসূত্রম্ ৪/৩/১) বাৎস্যায়ন মনে করেন, একজন গণিকাকে বিভিন্ন রুচির যুবক এবং প্রৌঢ় ব্যক্তির সঙ্গ দিতে হবে। যদি ধনবান হয়, প্রয়োজনে বৃদ্ধের সঙ্গেও শুতে হবে অর্থলাভের তাগিদে। এমনকি গণিকাদের কামশাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করতে হলে সবার আগে ৬৪ কলায় নিপুণতা লাভ করতে হবে। একটু জেনে নেওয়া যাক ৬৪ কলাগুলো কী কী–(১) কণ্ঠসংগীত। (২) যন্ত্রসঙ্গীতে পারদর্শিতা।(৩) নৃত্যকলা (৪) চিত্রাঙ্কন। (৫) কেশ সজ্জা।(৬) পুষ্পশয্যা নির্মাণ। (৭) নানাবিধ বর্ণে গৃহ সুসজ্জিতকরণ। (৮) নিজ পোশাক-পরিচ্ছদ, কেশ, নখ, দন্ত, প্রত্যক্ষ বর্ণের দ্বারা সুসজ্জিতকরণ। (৯) বর্ণাঢ্য প্রস্তর এবং ধাতব পদার্থে ঘর ও শয্যা সুশোভিত করা।(১০) ভিন্ন ভিন্ন উৎসবে বা আনন্দে শয্যা নানাভাবে আস্তরণ দেওয়া। (১১) সাঁতার ও জলকেলি। (১২) প্রিয় লোককে আকর্ষণ করার জন্য মন্ত্র-তন্ত্র অনুশীলন।(১৩) ফুল নিয়ে মালা গাঁথা ও অঙ্গাদি সুশোভিত করা। (১৪) ফুল নিয়ে মালার মুকুট ও বেষ্টন।(১৫) নিজের শোভন বেশভুষা করা—উৎসবে একপ্রকার, অন্য উৎসবে অন্য প্রকার। (১৬) চিত্তহারী প্রথায় কানের দুল পরিধান করা (১৭) সুগন্ধি দ্রব্য তৈরি করা। তৈজসপত্রাদি তৈরি সম্পর্কে শিক্ষা করা। (১৮) নতুন ভূষণ তৈরি বা পুরানো বিভিন্ন ধরনের অলংকার নতুন করে গড়া (১৯) অতিথিচর্যা (২০) পরিচ্ছদ রচনার সুচারুতা। (২১) হাতের কাজ।(২২) রন্ধনকলা। (২৩) পানীয় দ্রব্য, বিবিধ মিষ্টান্ন, আচার, চাটনি, ইত্যাদি তৈরিতে পারদর্শিতা। (২৪) সেলাই ও দেহের বস্ত্রাবরণ করতে সুদক্ষতা। (২৫) বস্ত্রখণ্ড ও সুতো দিয়ে পাখি, পাতা, ফুল ইত্যাদি তৈরি করা। (২৬) বীণা ও ডমরুর শব্দ অনুকরণ। (২৭) নানাবিধ হেঁয়ালিপূর্ণ আচরণ।(২৮) তাৎক্ষণিক কাব্যরচনা ও আবৃত্তি। (২৯) কঠিন অর্থপূর্ণ দুরূহ শব্দের অর্থ নিরূপণ করা। (৩০) সুমধুর কণ্ঠে শাস্ত্রীয় শ্লোক আবৃত্তি। (৩১) নাটক, অভিনয়, দর্শন ও নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের প্রকৃত সমালোচনা। (৩২) কোনো কবিতার হারানো পঙক্তির পুনরুদ্ধার করা বা তা পুনরায় নতুন করে লেখা। (৩৩) বেত বা তৃণ থেকে নানাবিধ নতুন নতুন আসবাবপত্র রচনা বা বোনা। (৩৪) কাঠ থেকে কুঁদে ছবি বা দৃশ্য রচনা। (৩৫) কাঠমিস্ত্রির কাজ, এবং বাড়িঘর নির্মাণ। (৩৬) সোনা, রূপা ও দামি পাথর বসিয়ে নানা কাজ করা। (৩৭) রসায়ন বা ধাতব শাস্ত্র অধ্যয়ন। (৩৮) উজ্জ্বল পাথর ও দামি ধাতুর বস্তু রচনা। (৩৯) কানন রচনা ও পুষ্পবিন্যাস। (৪০) ভেড়া, মোরগ এবং পায়রাদের নিয়ে কৌতুকপূর্ণ খেলা করার উৎসাহ দান। (৪১) শুক, ময়না প্রভৃতি পাখিকে কথা শেখানো ও তাদের দিয়ে মজাদার কাজ করানো। (৪২) গাত্র মর্দন করতে শেখা, বেশভূষা রচনা করা, কাজের শিল্প শিক্ষা করা। (৪৩) সংবাদ প্রাপ্তির নমুনাস্বরূপ আঙ্গুলের দাগ বোঝা।(৪৪) গুপ্ত সংকেত শেখা ও ব্যবহার। (৪৫) বিভিন্ন দেশের লিখিত ভাষা ও কথাবার্তা বোঝ। (৪৬) ঘোড়া, হাতি ও যানবাহন সুসজ্জিত করা। (৪৭) সংকেত চিহ্ন বা গুপ্ত বার্তা বোঝা (৪৮) নানা ধরনের যন্ত্রে জ্ঞানলাভ করা। (৪৯) স্মৃতিশক্তি বা স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করার অভ্যাস। (৫০) নানাবিধ পুস্তক পাঠ। (৫১) নানাবিধ পুস্তক রচনা। (৫২) অভিধান ও বিশ্বকোশ সংগ্রহ।(৫৩) ছন্দের নিয়ম এবং বক্তৃতা শিল্প শিক্ষা। (৫৪) লুকানোর শিল্প, তুলো রচিত দ্রব্যকে পশমরূপে রূপদান, সাধারণ দ্রব্যকে চিত্তাকর্ষক করে তোলা। নানা বস্ত্র পরিধান করা। (৫৫) দাবা খেলা ও পাশা খেলায় দক্ষতা (৫৬) বস্ত্র পরিচ্ছদ পরিধান করে নিজেকে অন্যের চোখে আকর্ষণীয় করে তোলা। (৫৭) শিশুদের মতো পুতুল ও গোলাকার সব বস্তু নিয়ে খেলা করা।(৫৮) নানা প্রকার শারীরিক ব্যায়াম ও কলাকৌশল শিক্ষা করা।(৫৯) রাজনীতি শিক্ষা করা।(৬০) সামরিক রীতিনীতি সম্পর্কে জ্ঞান (৬১) মুখ দেখে মানুষের চরিত্র আন্দাজকরণ।(৬২) কৃত্রিম পুষ্প তৈরি ৷(৬৩) কাদা বা নরম মাটি দিয়ে পুতুল, মূর্তি নির্মাণ (৬৪) গণিত বিষয়ে জ্ঞান লাভ।