নারী দুর্বল, নারী অবলা–এই তকমাগুলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই তৈরি করা। নারীকে দুর্বল থেকে আরও দুর্বলতর করে রাখার জন্যেই এই তকমা। সেই পুরুষতান্ত্রিক তকমাগুলো বেশিরভাগ নারী তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগও পছন্দ করে। এতে অনেক সুবিধা আছে। অনেক দায়িত্ব থেকে গা বাঁচিয়ে ফেলা যায়। কিছু দিন আগে গোটা দেশে লক ডাউন হল। আমাদের রাজ্যেও হল। এমতাবস্থায় এক মহিলা রাস্তায় ওলায় চেপে বেরোলে কলকাতা পুলিশ বাধা দেয়। মহিলাটি গাড়ি থেমে নেমে ছুটি এসে এক পুলিস অফিসারের পেটে কামড় বসিয়ে দেয় এবং সাদা জামায় লাল লিপস্টিক লাগিয়ে দেয়। মহিলাটি কেন এটা করতে সাহস পেল? কারণ মহিলাটি জানে উলটোদিক থেকে কোনো প্রতিরোধ আসবে না। কারণ সেখানে কোনো মহিলা পুলিস ছিল না। এটা কিন্তু কোনো পুরুষ করতে সাহস পেত না। কারণ পুরুষটি জানে এটা করলে তাঁর হাড়গোড় ভেঙে পুলিশ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিত সেই মুহূর্তেই। আর-একটি ঘটনা বলি। মধ্যরাতে এক দম্পতি নিজের গাড়ি থেকে নেমে বহুক্ষণ ধরে কলকাতার রাজপথে বেলাল্লাপনা করছিল। পুরুষসঙ্গীটি গাড়িতেই ছিল, মহিলাটি রাস্তায় নেমে বাওয়াল করছিল। রাত-পাহারায় পুলিশ রাস্তাতেই ছিল। এক বয়স্ক পুলিশ মহিলাটিকে বাড়ি চলে যেতে বললে মহিলাটি ওই পুলিশকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে থাকে। পুলিশ অসহায়। এই দৃশ্যের ভিডিও সোস্যাল মিডিয়া ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। এই কাজটা যদি কোনো পুরুষ কোনো মহিলা পুলিশকে করতে পারত? তখন পুরুষ পুলিশরা এসে তাঁকে মেরে হাড়গোড় ভেঙে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিত সেই মুহূর্তেই। কারণ ওই বেহেড মাতাল মহিলাটি জানে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো প্রত্যাঘাত আসবে না। এরকম ঘটনা বলে শেষ করা যাবে না। নিজেরা দুর্বল এটা ভাবিয়ে যেতে পছন্দ করে অনেকে। আস্তে লেডিজ’ বলে যখন বাস-কন্ডাক্টার যখন বাস দাঁড় করার তখন কোনো নারীবাদী মহিলাকেও প্রতিবাদ করতে দেখিনি। অতএব যেমন চলছে, চলুক। অসুবিধা তো নেই, বরং সুবিধাই বেশি। কোনো মহিলা পকেটমার ট্রেনের জেনারেল কম্পার্টমেন্ট থেকে ধরা পড়ে সামান্য তিরস্কার করে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারে যাত্রীরা। কিন্তু মেরে চামড়া গুটিয়ে দেবে না। আর মেয়েটা যদি কোনোক্রমে বলে ফেলতে পারে ঘরে তাঁর অসুস্থ স্বামী তিনটে ছোটো বাচ্চার সংসারে বাধ্য হয়ে এই পথ বাধ্য হয়েছি। তাহলে তো আর দেখতে হবে না। চোখের জলে ভাসতে থাকবে উপস্থিত মানুষরা। সেই পথেই যৌনবৃত্তি করতে গিয়ে ধরা পড়লে সে তাঁর অসহায়ত্বের কথা শোনায়। সেইসঙ্গে পুরুষদেরও কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়। আত্মরক্ষার অতি সহজ পথ।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সেই মধ্যযুগেই পড়ে আছে। পৃথিবীর সব বদলে যাচ্ছে, কিছু নারী ‘অবলা’ থেকে ‘সবলা’ হয়ে উঠতে চাইছে না। নারী তখনই সবলা হয় যখন নারী কারোর প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। বছর কয়েক আগে এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় যাচ্ছেতাই কাণ্ড করেছিল। সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এক মহিলার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। টাকাপয়সার গণ্ডগোলে সেই মেয়েটি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কিছু সেক্সচুয়াল অ্যাক্টিভিটির ভিডিও সোস্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেয়। উদ্দেশ্য, সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক কেরিয়ার ধ্বংস করে দেওয়া। নারী যেহেতু অবলা, তাই সোস্যাল মিডিয়ায় সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধেই ঢি ঢি পড়ে যায়। দল তাঁকে বহিষ্কার করে। নারী অবলা, তাই নারী স্বামী ও স্বামীর আত্মীয়স্বজনদের বিরুদ্ধে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মামলা এনে জেলের ঘানি টানাতে পারে। অথচ কত কত যে পুরুষ ‘অবলা’ দ্বারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত, সেই খবর কেউ রাখে না। কারণ পুরুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্তই ‘সবল’। নারী যত ভয়ংকর অপরাধই করুক না-কেন, আপনি তাঁকে একটা চড় কষিয়ে দিতে পারবেন না। তা করলেই আপনি অপরাধী। আপনার বিরুদ্ধে সবাই দাঁড়িয়ে পড়বে। কিন্তু কোনো অপরাধ না-করলেও কোনো মহিলা এসে আপনার গালে সপাটে চড় মারতে পারে, তখনও মহিলাটির বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলবে না। কারণ ততক্ষণে মহিলাটি বলে ফেলতে পেরেছে আপনি মহিলাটির সঙ্গে ‘অসভ্যতামি’ করেছেন।
মহিলাদের নিয়ে এত কথা বললাম কেন? এই ‘অবলা’, ‘অসহায়’ শব্দগুলি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চাপিয়ে দিয়েছে, যা ‘অপরাধপ্রবণ’ মহিলারা অস্ত্র হিসাবে কাজে লাগায়। আজ যদি কোনো রাষ্ট্র যৌনপেশাকে বৈধতা দিয়ে দেয়, তখন কিন্তু কেউ বলবে না ‘পেটের দায়ে’ ‘অভাবের তাড়নায়’ এ পেশায় এসেছি। তখন পুরুষদেরও কাঠগোড়ায় তোলার কথা ভাববে না। যতদিন এই পেশায় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সমর্থন থাকবে না, ততদিন ৩৫ বর্ষীয়া যৌনকর্মীও ‘অবলা’ ও নাবালিকার মতো বলবে ‘চাপে পড়ে এ পেশায় এসেছি।
যৌনপেশায় তাঁরা যদি সত্যিই ‘চাপে পড়ে’ আসত, তাহলে যৌনকর্মী হিসাবে প্রকৃত না-খেতে পাওয়া দরিদ্র আদিবাসীদের মধ্যেই দেখা যেত। কারণ এঁরা দারিদ্র্যসীমার অত্যন্ত নীচে অতি কষ্টে জীবনধারণ করে বেঁচে থাকে। প্রকৃত আদিবাসীদের মধ্যে যৌনকর্মী নেই বললেই চলে। এটা আমি নই, এটা নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞানীদের বক্তব্য। পাচারকৃত বা বিক্রি হওয়া নারীরা সত্যিই খুব অসহায়। কিন্তু তাঁরা কখনো যৌনকর্ম করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে না। কারণ তাঁরা নির্দিষ্ট এলাকায় (গণিকাপল্লি) বসবাস করে যৌনকর্ম চালায়। পুলিশও সেখানে ঢোকে না। তাঁদের বলতেও হয় না অভাবের তাড়নায়’ এ পেশায় এসেছি। বলার সেই সুযোগও নেই। কারা বলার সুযোগ পায়? তাঁরাই এসব সুযোগ পায়, যাঁরা হোটেল, রিসোর্ট, ফ্ল্যাট বা কারোর বাড়িতে যৌনকর্ম করতে গিয়ে ধরা খায়। এঁরা বেশিরভাগই সচ্ছল পরিবারের মহিলা। এমনকি তাঁরা সমাজের উঁচুতলারও হতে পারে। হতে পারে তাঁরা সমাজের প্রতিষ্ঠিত পুরুষদের স্ত্রী বা কন্যা। এইসব গণিকাদের সঙ্গে কথা বলে যেটা জানতে পেরেছি, সেটা হল বেশিরভাগ যৌনকর্মীরাই শহুরে বা শহরতলির। গ্রাম থেকে আসা মেয়েদের সংখ্যা অতি নগণ্য। গোরাচাঁদ কুণ্ডুর লেখা একটা আর্টিকেলের অংশ প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি, অংশটা এখানে উল্লেখ করি–“গণিকা পেশা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং কামজ পরিস্থিতির চরম পরিণতি নয়। নারী প্রকৃতির দুর্বোধ্য কিছু কারণেই অনেক নারী পরোক্ষ পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে। মাতা’ এবং তার বিপরীত ‘পতিতা’–দুটিরই প্রত্যাশিত ফল পাওয়ার সম্ভাবনা সমস্ত নারীর মধ্যেই থাকে। মাতা এবং তদস্থানীয় নারীর মার্জিত শিক্ষা, দীক্ষা, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি যদি শৈশবকাল থেকেই শিশুকন্যার মধ্যে মাতা প্রতিরূপকে (মাদার ইমেজকে) শক্তিশালী করতে সাহায্য করে, তাহলে শত দুর্বিপাকেও নারী পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে না। জোরজুলুম করেও তাঁকে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করানো যায় না। পতিতাদের আত্মহত্যার ঘটনার কারণও অধিকাংশ ক্ষেত্রে জুলুমের কাছে নতি স্বীকার না করার দৃঢ় মানসিকতা। সমাজের দায় অবশ্য এঁদেরই রক্ষা করা। এবং বাঁচার অধিকারে প্রতিষ্ঠা করা। পক্ষান্তরে, পতিতা-প্রবণ মানসিকতার নারীদের মধ্যে থাকে সুপ্ত সেক্স পলিটিক্সের প্রবণতা, এই প্রবণতাই উগ্র হয়ে কখনো-বা পরিণত হয় বৃত্তিতে।” বেশ কয়েক বছর আগে এক ভদ্রলোকের একটা লেখা পড়েছিলাম, তাতে লেখা ছিল–“সেই দিন আসন্ন, যেদিন পুরুষগণ সেক্সের জন্য মেয়েদের পিছন পিছন ভাদ্র মাসের কুকুরের মতো ছুটবে।” আসলে এটাই সেক্স পলিটিক্স। আপনার সামনে মেয়েরা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে বডি পেইন্ট করাবে। বহু দেশে শুরু হয়ে গেছে। ভারতেও এখন হামাগুড়ি প্র্যাকটিস চলছে, যাকে বলে নেট প্র্যাকটিস শুরু হয়ে গেছে।
২৪. গণিকাবৃত্তির অধিকারের লড়াই, নিশ্চয়তা, নিরাপত্তায় স্বেচ্ছাসেবী
বিশ্বজুড়ে যৌনকর্মীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন চলছে। গোটা ভারতে চলছে। কলকাতাও বাদ নেই। দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি পশ্চিমবঙ্গের ৬৫ হাজার যৌনকর্মীর সমষ্টিগত দল। ১৯৯২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার সবচেয়ে বড়ো নিষিদ্ধপল্লি সোনাগাছিতে প্রতিষ্ঠিত দুর্বার, ভারতের লক্ষ লক্ষ যৌনকর্মীর সঙ্গে নারী অধিকার, যৌনকর্মীদের অধিকার সমর্থন, মানব পাচার বিরোধী এবং এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করছে। ফোর্ড ফাউন্ডেশন এবং ন্যাশনাল এডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (এনএসিও), ইত্যাদি সংস্থাগুলির সাহায্যে পশ্চিমবঙ্গে যৌনকর্মীদের জন্য ৫১টি বিনামূল্যের ক্লিনিক চালানো হয়, যারা নেটওয়ার্কিং, অধিকার সুরক্ষা এবং যৌনকর্মীদের জন্য বিকল্প জীবিকা তৈরির মতো উদ্যোগেও সহায়তা করে। গণিকাবৃত্তিকে বৈধ পেশা এবং যৌনকর্মীদের কর্মী হিসাবে স্বীকৃতির লড়াইয়ের জন্য এবং যৌনকর্মীদের তথা তাঁদের সন্তানদের জন্য নিরাপদ সামাজিক অস্তিত্বের জন্য দলটির লক্ষ্যমাত্রায় স্পষ্টত রাজনৈতিক। তাঁরা গণিকাবৃত্তি বৈধকরণের জন্য কাজ করে এবং আইন সংস্কারের চেষ্টা করে, যা যৌন মানবাধিকারকে সীমাবদ্ধ করে।