এছাড়া প্রচলিত বিশ্বাস আছে যে, মানুষের কামনা, বাসনা, লালসা, লোভ, কদর্যতাকে গণিকারা নিজের মধ্যে ধারণ করে নিজেকে অশুদ্ধ, অপবিত্র করে সমাজকে পবিত্র, পরিশুদ্ধ রাখে, সমাজের নৈতিকতাকে তাঁরা একভাবে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাই দেবী পুজোর মূর্তি তৈরিতে গণিকাপল্লির (সমাজের) মাটি গ্রহণ করা আদতে তাঁদেরই খানিক সম্মান দেখানো! তা ছাড়া হিন্দুপুরাণে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে, গণিকাদের ক্ষমতা নাকি দেবতাদের থেকেও বেশি। কারণ ঋষি বিশ্বামিত্র যখন ইন্দ্রত্ব লাভের জন্য কঠোর তপস্যায় ব্রতী হয়েছিলেন, তখন তাঁর ধ্যানভঙ্গ করার জন্য দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গগণিকা মেনকাকে পাঠান। মেনকার নৃত্যের ফলে বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভঙ্গ হয়। ফলে দেবরাজ ইন্দ্র সর্বশক্তিমান হয়েও যা পারলেন না, মেনকা সামান্য নারী হয়ে তা হেলায় করে ফেললেন।
২৩. যৌনকর্মীরা কি বাধ্য হয়েই যৌনপেশায়?
মেয়েরা পেটের জ্বালায়, চরম দারিদ্র্যতায় যৌনপেশায় আসে। সাধ করে আসে না, বাধ্য হয়েই আসে। যৌনকর্মীদের সিনেমা-সাহিত্য-প্রবন্ধে-নিবন্ধে সর্বত্র একই দুঃখভরা কাহিনি শোনা যায়। আসলে দুঃখ ও দারিদ্রতা ভালো দামে বিক্রি হয়। দরিদ্রতায় সহানুভূতি আদায় করে কাজকে জাস্টিফাই করা হয়। যে মেয়েটি ক্লায়েন্টের কাছ প্রতি রাতে পাঁচ লক্ষ টাকা আর করে তাঁরও পেটের দায়! যাঁরা বলেন পেটের দায়ে মেয়েরা যৌনপেশায় আসে, তাঁদের বলি, আমরা সকলেই কিন্তু পেটের দায়েই বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হই। সবসময়ই সেই পেশা ভলো লাগে, তা তো নয়। তবুও করতে হয়। তা ছাড়া দীর্ঘদিন একই কাজ করতে একঘেঁয়েমিও আসে। তবু করতে বাধ্য হয় মানুষ। দারিদ্র্যতা থাকলেও করতে হয়, সচ্ছলতা থাকলেও করতে হয়। হ্যাঁ, বাধ্য হয়েই করতে হয়।
যৌনপেশা বৈধ হোক বা অবৈধ হোক, সেটা দরিদ্রতা, অভাব, পেটের দায় অজুহাত দিয়ে জাস্টিফাই করতে হবে! যাঁরা পাচার হয়ে, প্রতারিত হয়ে, বিক্রি হয়ে এ পেশায় আসে, তাঁদের নিশ্চয়ই বাধ্য হয়েই এ পেশাটা চালিয়ে যেতে হয়। তবে এঁদের অনেকেই যৌবন থাকাকালীন অন্য পেশায় টেনে আনা যায় না। বর্তমান রাজ্য সরকার চেষ্টা করেছিল এঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার, চেষ্টা করেছিল নতুন পেশায় নিযুক্ত করতে। কিন্তু বিশেষ ফল পাওয়া যায়নি। তাঁরা নতুন পেশায় আগ্রহ বোধ করেনি। কারণ তাঁদের যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী নতুন পেশায় প্রচুর রোজগার পাইয়ে দেওয়া তো সম্ভব নয়। যৌনপেশায় অল্প পরিশ্রমে যে কাঁচা পয়সা রোজগার করা যায়, সেটা তো অন্য পেশায় করা যায় না। পুনর্বাসন চাই, পুনর্বাসন চাই’ বলে যাঁরা চিৎকার করে, তাঁদের বেশিরভাগ পড়ন্ত যৌবনা, বাজারদর প্রায় ফুরিয়ে আসা মহিলারা। উত্তুঙ্গু বাজার থেকে তুলে আনা খুবই কঠিন কাজ। তবে কেউ কেউ কোনো ক্লায়েন্টের প্রেমে পড়ে পল্লি ছেড়ে বেরিয়ে আসে বটে। সেগুলি অবশ্যই বিরল ঘটনা। কোটিতে গুটি। একবার যে অর্থের স্বাদ একবার পেয়েছে তাঁর হাত থেকে অর্থ কেড়ে নিয়ে অন্যের অধীন করানো অত সহজ কাজ নয়। আজকাল বহু মেয়ে-বউরাও স্বেচ্ছায় এ পেশা বেছে নিচ্ছে অতিরিক্ত রোজগারের জন্য। সেই রোজগার করে গাড়ি-বাড়ি করে ফেলছে। ব্যাংক ব্যালান্স করছে। এ লাইনে নতুন এসেছি’ বলে এঁরা সবসময়ই বাজারদর উঁচুতে রাখতে সক্ষম হয়।
যৌনকর্ম করতে গিয়ে কোনো হোটেল থেকে কোনো যৌনকর্মী যদি পুলিশের খপ্পরে পড়ে যায়, তখন সকলেই একটা বুলি–“অভাবের তাড়নায় এ পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছি।” সহানুভূতি উপচে পড়ে মানুষের। অমনি সেলিব্রেটিরা সেই মেয়েটির পক্ষে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করে দেয়–“যে পুরুষরা ওদের কাছে আসে তাঁদের কেন ‘বেশ্যা’ বলা হবে না?” দোকান খুলবেন আপনি, দোকান খুলে পণ্য বেচবেন আপনি, খরিদ্দার গেলেই দোষী? আপনি দোকান খুললে আপনি বেচছেন এটাই তো আহ্বান। আপনি কমার্শিয়াল পারপাসের গাড়ি বের করলে যাত্রী সেই গাড়িতে উঠবেই এবং সেই যাত্রীকে গন্তব্য স্থলে পৌঁছে দিতে আপনি বাধ্য, যদি যাত্রী ন্যায্য ভাড়া দেয়। কোনো খরিদ্দার জোর করে আপনাকে ভোগ করছে না, করে না। আপনি ড্রিল করেছেন, তবেই আপনার কাছে কোনো পুরুষ গিয়েছে। আপনি আহ্বান করেছেন।
আর অভাবের তাড়নায় কথা যদি বলেন, তাহলে বলব, ভারতের ৮০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, যাঁদের ২ টাকা কেজি করে চাল খাওয়ায় ভারত সরকার। যদি অভাবের তাড়নায় যৌনপেশায় আসার অন্যতম কারণ হয়, গোটা ভারতে যৌনকর্মীর সংখ্যা আকাশছোঁয়া হত। গোটা দেশই গণিকালয়ে পরিণত হয়ে যেত। তাহলে চাহিদার চেয়ে জোগান বৃদ্ধি হয়ে যৌনকর্মীদের রেটও তলানিতে এসে ঠেকত। তা হয়নি। যা হয়, তা হল কত মানুষ অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা পর্যন্ত করে, কিন্তু যৌনপেশায় কখনোই আসে না। কত মহিলা স্বামীকে সাহায্য করতে কায়িক পরিশ্রম করছে, ভারী ভারী মাল টানছে, ইটভাটায় কাজ করছে, রাজমিস্ত্রীর সহযোগী হচ্ছে, নানারকম কঠোর পরিশ্রম করে–তা সত্ত্বেও তাঁরা যৌনপেশায় আসে না। বরং পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি বহু অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে-বউরাও এ পেশায় আসছেন অতিরিক্ত রোজগারের জন্য। মডেল, চলচ্চিত্র, সিরিয়ালের সেলিব্রেটিরাও আসছে। উঁচুতলার যৌনকর্মীরা উঁচুতলার মানুষদের মনোরঞ্জন করে। সচিব, মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা, আমলা প্রমুখদের তো আর যৌনপল্লিতে গিয়ে যৌন-বিনোদন সম্ভব নয়। তাই ধোপদূরস্ত নামী-দামি যৌনকর্মীরাই পৌঁছে যায় তাঁদের ঘরে।