‘বেশ্যা’ শব্দটির বর্ণভিত্তিক অর্থ ব্যাখ্যা করলে এই তত্ত্ব খানিকটা পরিষ্কার হবে। বেশ্যা’ শব্দটির বর্ণ বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়–ব + ঋ + এ + ঋ + শ + ঋ + য + ঋ + আ। শ্রীপঞ্চানন শাস্ত্রী সম্পাদিত ‘তন্ত্রাভিধান’ গ্রন্থের ‘বর্ণাভিধান’ অধ্যায়ে আমরা ‘বেশ্যা’ শব্দটির বর্ণগত বিশ্লেষণ করব। শাস্ত্রে ‘ব’ বর্ণটি বাল বা নব (নতুন) অর্থে বোঝায়। এ-কারে ‘এ’ অর্থে শক্তি। শ’ অর্থে হয় বৃষগ্ন। শাস্ত্রে বৃষ বা ষাঁড়কে ধর্মস্বরূপ জ্ঞান করা হয়। তাহলে ‘বৃষ’ অর্থ দাঁড়াল ধর্মহানি। য-ফলার ‘য’ অর্থে কালী এবং আ-কারের ‘আ’ অর্থে প্রতিষ্ঠা। তাহলে ‘বেশ্যা’ শব্দের অর্থ দাঁড়াল–বালশক্তি বা নবজাতক সাধনশক্তি সহায়ে ধর্মহানি (দূর করে) কালীতত্ত্বে প্রতিষ্ঠাতা সাধিকা, এটাই হল বেশ্যা।
‘বেশ্যা’ শব্দের আর-একরকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। অন্য ব্যাখ্যায় ‘ব’ অর্থ মাতা। ‘এ’ অর্থে ভগবতী। শ’ অর্থে বৃষ বা ধর্মবাধা। ‘য’ অর্থে সর্বেশ্বরী এবং ‘আ’ অর্থে প্রতিষ্ঠা। এখানে শব্দগুলি জুড়ে দাঁড়াল—মাতা ভগবতীর ইচ্ছায় ধর্মবাধা জয় করে সর্বেশ্বরীত্বে প্রতিষ্ঠাতা সাধিকা, অর্থাৎ এটাই বেশ্যা।
বৈষ্ণবাচার্য শ্রীমন্ মধ্ব বিরচিত একটি মাতৃকা-নির্ঘণ্ট আছে। এবার এই মাতৃকা-নির্ঘণ্ট অবলম্বনে ‘বেশ্যা’ শব্দের অর্থোদ্ধার করতে পারি। শ্ৰীমন্ মধ্বের মতে ‘ব’ অর্থে পুরুষোত্তম। ‘এ’ অর্থে দামোদর’ ‘শ’ অর্থে লক্ষ্মীশ।‘ য’ অর্থে বাগীশ’ ‘আ’ অর্থে বাসুদেব। অর্থাৎ, শ্ৰীমন্ মধ্বের মতে বেশ্যা শব্দের অর্থ দাঁড়াল–ভগবান মহিমময় পুরুষোত্তম রূপে, দর্পহারী দামোদর রূপে, ধনৈশ্বৰ্য্যদায়ী লক্ষ্মীশ রূপে, জ্ঞানৈশ্বৰ্য্যদায়ী বাগীশ রূপে এবং পরম প্রেমময় বাসুদেব রূপে যাঁর হৃদয়কন্দরে সতত বিরাজমান, তিনিই বেশ্যা। (শ্রীমৎ স্বামী পরমাত্মানন্দনাথ ভৈরব গিরি)।
সংস্কৃত শব্দের অর্থ না-জানার ফলে বিভ্রান্তিতে পড়ছে অনেকে। “অভিষিক্তা ভবেৎ বেশ্যা ন বেশ্যা কুলটা প্রিয়ে”–মহানির্বাণ তন্ত্র। “পূর্ণাভিষেকো দেবেশি দশ বিদ্যাবিধোস্মৃত”—দশ মহাবিদ্যার উপাসকগণই পূর্ণাভিষেকে অধিকারি অন্যে নহে।–কুলার্ণব তন্ত্র। দীক্ষা পুরশ্চরণঃ পূর্ণাভিষেক মন্ত্রচৈতন্য হওয়ার ফলে যিনি দেবত্বে উন্নিত হয়েছেন, এরকম অভিষিক্তাকে বেশ্যা বলা হয়েছে। আর উনারা যেখানে বাস করেন সেই দ্বারের মাটিকে বলা হয়েছে। বর্তমান সমাজের কুলটা’ বারবনিতা’ পতিতালয়ের মাটি বলা হয়নি। এই ঘৃণিত মহাপাপকে শাস্ত্র কখনও প্রশ্রয় দেয়নি, বরং প্রায়শ্চিত্ত করতে বলেছে। বৈদিক যুগে এই আদ্যা ব্রহ্মশক্তির কথা আবার কোনো উপনিষদেও উমা-হৈমবতীরূপে আমরা জেনেছি। সেখানে তিনি জ্যোতিঃস্বরূপ সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মকে দেবতাদের বুঝিয়েছেন। করুণাময়ী জননী মূর্তিতে ইন্দ্রাদি দেবতাদের অহংকার নাশ করে তাঁদের ব্রহ্মজ্ঞান তত্ত্ব উপলব্ধিতে সাহায্য করেছেন। অহংকারই জীবের অজ্ঞানের কারণ। এই অহং নাশ হলে তবেই তত্ত্বোপলব্ধি হয়। আর আদি জননীর কৃপাতেই দেবসন্তানদের সেই অহং নাশ হয়ে ব্রহ্ম সম্পর্কে ধারণা জন্মায়। ঋকবেদের রাত্রিসূক্তের পরিশিষ্টের দ্বাদশ ঋকে একটি মন্ত্র আছে, সেটি হল–“তামগ্নিবর্ণা তপসাজ্বলন্তীং বৈরোচনী কর্মফলেষু জুষ্টা। দুর্গাং দেবিং শরণমহম্ প্রপদ্যে সুতরসি তরসে নমঃ।” দেবীর স্বরূপ বলা হচ্ছে যিনি অগ্নিবর্ণা ও স্বকীয় তপঃশক্তিতে উজ্জ্বল, চতুর্বর্গ ফলদাত্রী, পরিত্রাণকারিণী। সংসার সাগর পার হওয়ার জন্য সেই দুর্গাদেবীর আমি শরণ নিচ্ছি। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে নবম অনুবাকে দুর্গা-গায়ত্রী আছে–“কাত্যায়নায় বিদ্মহে কন্যা কুমারিং ধীমহি তন্নোদুর্গি-প্রচোদ্দয়াৎ।” এই মন্ত্র দ্বারা স্বর্ণবর্ণা, শিরে চন্দ্রকলাশোভিতা বেদপ্ৰসিদ্ধা দেবী ভগবতীর কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। যিনি কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে প্রকাশিতা সেই আদি কুমারী দুর্গা দেবীর কাছে জ্ঞান লাভের জন্য প্রার্থনা করা হচ্ছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে শাস্ত্রের কোনো অংশে বেশ্যা মানে ‘পতিত’ নারীর কথা বোঝাচ্ছে না, যাঁরা যৌনপেশার মাধ্যমে অর্থ রোজগার করে এবং জীবনধারণ করে। তাহলে শাস্ত্র বহির্ভূত হয়ে কবে থেকে ‘বেশ্যা’ অর্থে পতিতালয়ের মাটি বা ‘বেশ্যাদ্বারের মাটি হয়ে উঠল? না, সাল-তারিখ-উদ্দেশ্য কিছুই জানা যায় না। তবে মনে হয় গণিকালয় যে একটি পবিত্র জায়গা, এটা সাব্যস্ত করতেই তৎকালীন সমাজপতিদের এহেন অপব্যাখ্যা। এর ফলে গণিকাগমন কোনো অপরাধ হয় না। পাপ কাজ বা কোনো ঘৃণ্য কাজ রূপে পরিগণিত হয় না। সেকালে এখনকার মত গণিকাবৃত্তি ও গণিকাগমন মোটেই ঘৃণ্য ছিল না। আর একটা কারণও হতে পারে। এমনটাও অনেকে মনে করে—একটা পুরুষ যখন গণিকার বাড়ি গিয়ে অবৈধ যৌনাচার করে তখন ওই পুরুষের জীবনের সমস্ত পুণ্য গণিকার বাড়ির মাটিতে পতিত হয় বা পুণ্য তাঁকে ত্যাগ করে, বিনিময়ে ওই পুরুষ গণিকার ঘর থেকে নিয়ে আসে সমস্ত পাপ। এরূপ বহু পুরুষের অর্জিত সমস্ত পুণ্য ত্যাগে গণিকাদের ঘরের মাটি পূণ্যময় হয় বলে মনে করা হয়, তাই গণিকার ঘরের মাটি প্রয়োজন হয়। এ থেকে শিক্ষা লাভ করা যায় যে, গণিকার ঘরে গিয়ে অবৈধ যৌনাচার করে নিজের জীবনের সমস্ত পুণ্য বিসর্জন দিও না। নারী কখনো অপবিত্র হয় না। নারীকে গণিকা বানায় পুরুষরাই। তাই ওই পুরুষরাও অপবিত্র। মায়ের প্রতিমা তৈরিতে গণিকালয়ের মাটি দিতে হয়। এর মাধ্যমে এটাই বোঝানো হয়েছে যে, তাঁরা পরিস্থিতির শিকার, তাঁদের সন্মান করতে হবে। নারী কখনও অপবিত্র হতে পারে না (নিজের ইচ্ছেতে যে নারী নিজেকে বিকিয়ে দেন তাঁরা ছাড়া), যেসব পুরুষ ওই নারীদের গণিকা হতে বাধ্য করেছে, সেই সব পুরুষরাই অপবিত্র। শরৎকালে হয় দেবীর অকালবোধন। এই সময় মহামায়া ৯টি রূপে (এই নবকন্যা হলেন (১) নর্তকী, অভিনেত্রী, (২) কাঁপালিক, (৩) ধোপানি, (৪) নাপিতানি, (৫) ব্রাহ্মণী, (৬) শূদ্রাণী, (৭) গোয়ালিনী, (৮) মালিনী ও (৯) গণিকা) পূজিত হন। এই নবম রূপটিই আসলে গণিকালয়ের প্রতিনিধি। মনে করা হয়, সে কারণেও এই রীতির জন্ম হয়েছে। দেবী দুর্গা যেহেতু সমগ্র নারীশক্তিরই প্রতীক, তাই গণিকাকেও এখানে সমগ্র নারীজাতিরই এক অঙ্গ হিসাবে দেখা হয়। তাই দুর্গাপুজোয় অষ্টকন্যার ঘরের মাটি নেওয়ার পর নবম কন্যা হিসাবে গণিকালয়ের মাটি মূর্তি তৈরির সময় ব্যবহার করা হয়। আর দুর্গাপুজোয় মূল উদ্দেশ্য যেহেতু সমস্ত নারীজাতিকেই সম্মান দেখানো, তাই গণিকাকেও এখানে সম্মান দেখানোর রীতি চলে আসছে।