বাংলাদেশী বিশিষ্ট গবেষক এবং লেখক আখতার হামিদ খান একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত যৌনকর্মীদের গণিকালয়ে আসার কারণ নিয়ে লেখা “কেন এরা এ পথে আসে” শিরোনামের একটি প্রবন্ধে বাংলাদেশী পুরুষদের যৌনকর্মীদের কাছে যাওয়ার তিনটি কারণ উল্লেখ করেন। কারণ তিনটি হচ্ছে—(১) ব্লু-ফিল্ম, পর্নোসাহিত্য ও অশ্লীল ম্যাগাজিন পুরুষদের যৌন উত্তেজনার অন্যতম কারণ। ব্লু-ফিল্ম, অশ্লীল ম্যাগাজিন ও তথাকথিত যৌন উত্তেজক গল্প-উপন্যাস এবং বিদেশি যৌন উত্তেজক ছায়াছবির ব্যাপক ছড়াছড়ি যুবকদের দেহমনে কামনার আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তখনোই তাঁরা অবৈধ নারী সংসর্গ কামনায় পাগলপারা হয়ে ওঠে। যে কোনো উপায়ে নারী ধর্ষণের চেষ্টা করে, না-পারলে ছোটে যৌনকর্মীর সন্ধানে। প্রশ্ন উঠতে পায়ে, বহু আগে যখন ব্লু-ফিল্ম আবিষ্কার হয়নি, তখনও তো যৌনপল্লি ছিল। প্রথমত তখন ব্লু-ফিল্ম না-থাকলেও পর্নোসাহিত্য, যৌন উত্তেজক পেইটিং ও চারুশিল্পের অস্তিত্ব ছিল। শত শত বছর আগের উলঙ্গ ভাস্কর্য, নগ্ন নারী চিত্র ও নারী-পুরুষের যৌন মিলনের বহু চিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। দ্বিতীয়, পর্নোছবি ছাড়াও তখন যৌন উত্তেজক অন্যান্য কারণগুলো তখনও ছিল। কেননা জৈবিক তাড়না তো প্রকৃতিগত। (২) দেরিতে বিয়ে করা বা হওয়াও একটি কারণ। যৌবনের তাড়না স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতিগত। এ জন্যই বিয়ের ব্যবস্থা। কিন্তু যে-কোনো কারণে হোক বিয়ে করতে দেরি হলে বয়সের দাবি তো তার অধিকার ছাড়বে না। তাই যৌবনের স্বাভাবিক তাড়নায় যুবকরা বাধ্য হয় যৌনকর্মীর সন্ধান করতে করতে যৌনপল্লিতে পৌঁছে যাওয়া ছাত্র, যুবক ও স্ত্রীসঙ্গহীন পুরুষরাই অধিকহারে গণিকাগমন করে থাকে। (৩) যে কারণই থাক, যত কারণই থাক ধর্মহীনতা ও নৈতিকতার অবক্ষয় সকল অপকর্মের মূল কারণ। তা যেমন যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। মজার ব্যাপার হল, অনেকে আছেন, যারা গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বেড়ান, আবার তাঁরাই রাতের আঁধারে খদ্দের হয়ে ভেজা বেড়ালের মতো মাথা গুঁজে ঢোকেন যৌনপল্লিতে অথবা হোটেলে বা অন্য কোনোখানে।
২২. বেশ্যাদ্বারের মাটি : গূঢ়তত্ত্ব
বাঙালির দুর্গাপুজোয় গণিকাঘরের মাটির (বেশ্যাদ্বারের মাটি) প্রয়োজন হয়। গণিকা ও গণিকালয় নির্মূল করে দিলে এ মাটি আসবে কোথা থেকে? ‘বেশ্যাবাড়ির মাটি ছাড়া কি দুর্গাপুজো হবে? দুর্গাপুজো হবে কি হবে না, সেই ভিত্তিতে গণিকাবৃত্তিকে সমর্থন করব কি করব না সেটা নির্ভর করে না। একসময় নীলকণ্ঠ পাখি না ওড়ালে জমিদাররা দেবী বিসর্জন স্বপ্নেও ভাবতে পারত না। এখন ভাবতে পারে। একসময় পশুবলি ছাড়া দুর্গাপুজো করার কথা ভাবতেই পারত না। এখন কিন্তু পশুবলি ছাড়াই পুজোপার্বণ হচ্ছে। অতএব চাইলে ‘বেশ্যাবাড়ির মাটি ছাড়াও দুর্গাপুজো হতে পারে। সে কথা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন সত্যিই কি দুর্গাপুজোয় ‘বেশ্যাবাড়ির মাটি’ লাগে? ব্যাপারটা কীভাবে সম্পন্ন হয়? তার আগে জেনে নেব দুর্গাপুজোয় যে ‘বেশ্যাবাড়ির মাটি’ লাগে, তা কতটা শাস্ত্রসম্মত?
কী বলছে শাস্ত্র? হিন্দুশাস্ত্র লিঙ্গপুরাণে দুর্গাপুজোকে ‘চতুষ্কর্মময়ী’ বলা হয়েছে। চতুষ্কর্ম বলতে–(১) মহাস্নান, (২) ষোড়শোপচার পুজো, (৩) বলিদান এবং (৪) হোম। দুর্গাদেবীর স্নান একটি অত্যাবশ্যকীয় পূজাঙ্গ। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিথিতে দেবীকে বহুবিধ উপাচার সহযোগে স্নান করানো হয়। উপাচারগুলি কী আমরা এবার জেনে নিতে পারি। এই উপাচারগুলির মধ্যে ১২ টি মাটির উল্লেখ পাওয়া যায়–(১) রাজবাড়ির দুয়ারের মাটি, (২) চার মাথার মোড়ের মাটি, (৩) গঙ্গার মাটি, (৪) ষাঁড়ের শৃঙ্গ মাটি, (৫) নদীর দুই কূলের মাটি, (৬) সর্বতীর্থের মাটি, (৭) উইঢিবির মাটি, (৮) সাগরের মাটি, (৯) বুনো শুয়োরের দন্তলগ্ন মাটি, (১০) গোষ্ঠের মাটি, (১১) দেবদুয়ারের মাটি এবং (১২) বেশ্যাদ্বারের মাটি।
দুর্গাপুজোয় বেশ্যাদ্বারের মাটির ব্যবহার প্রায় সর্বত্র প্রচলিত। তবে এই ব্যবহার শাস্ত্রসম্মত নয়। কারণ ‘বেশ্যা’ শব্দটি সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে ‘পতিতা’ অর্থে। কিন্তু বিভিন্ন শাস্ত্রে ‘বেশ্যা’ একটি ভিন্নার্থক পারিভাষিক শব্দ। আমরা লোকপ্রচলিত অর্থকে শাস্ত্র ব্যাখ্যার সময় গ্রহণ করার বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকার অর্থ গণিকালয়ের মাটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এর সপক্ষে কোনো কোনো পণ্ডিত বলেছেন যে, বেশ্যাদ্বার পুণ্যশোষী। যে পুরুষ বেশ্যালয়ে প্রবেশ করে তাঁর সমস্ত পুণ্যবল ওই বেশদ্বার শোষণ করে নেয়। বেশ্যাগামী পুরুষ পুণ্যরিক্ত হয়ে পাপগৃহে প্রবেশ করে। যেহেতু বেশ্যাদ্বার সমস্ত পুরুষের পুণ্য শোষণ করে নেয়, তাই ওই ‘দ্বার’ সংলগ্ন মাটি পবিত্র। এবং অবশ্যই মহামায়ার স্নানের উপযোগী। খুবই বোকা বোকা ব্যাখ্যা! ব্যাখ্যাটি ‘তৃপ্তিদায়ক’ হলেও মোটেই শাস্ত্রসম্মত নয়। কেননা পুণ্যবান ব্যক্তির পুণ্যফল কোনো তরল পদার্থ নয় যে, বেশ্যাদ্বারে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়বে। পাপ ও পুণ্য মানুষের জন্মজন্মার্জিত কর্মফল বাহিত সূক্ষ্ম ধারণা বা সংস্কার। বাস্তবিকই সেটিকে কোনো কিছুর দ্বারাই শোষণ করা সম্ভব নয়। বেশ্যাদ্বারে কোনো ব্লটিং পেপার থাকে না, যা শোষণ করার ক্ষমতা রাখে। অর্থাৎ ভাবনাটা অযৌক্তিক। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।