পৃথিবী জুড়ে আজও এঁরা আছে। কেবল পদ্ধতি পালটে গেছে। অন্য রূপে। অন্য ভাবে। যেমন ধরুন হাতের কাছে হানি ট্র্যাপ। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল হানি ট্র্যাপের কাছে ঘায়েল হওয়ার। এরা সেইসব নারী, যাঁদের আন্তরিক আহ্বান, সহজ-সরল চোখদুটিকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা খুব কম পুরুষেরই আছে। এঁরা পুরুষদের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে গোপন তথ্য বের করে আনে। ১৯১০ সালে বার্লিন থেকে প্যারিস সারা ইউরোপ জুড়ে দাপিয়ে বেড়াত মাতা হারি নামে এক গণিকা গুপ্তচর। পামেলা বোর্দেও ছিল এমনই এক গণিকা গুপ্তচর। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের চর ডামিনি ম্যাকনট নামে এক লাস্যময়ী নারীর ফাঁদে পা দেন বিমান বাহিনীর ওই অফিসার। তিনি নাকি বাহিনীর রণকৌশল পাচার করেছিলেন। সিআইএ, মোসাদ, র, হামাস, কেজিবি, আইএসআই সব গোয়েন্দা সংস্থার তূণে আছে এই গণিকা গুপ্তচর। ‘হানি ট্র্যাপ’ মানেই যে ‘মধুর ফাঁদ’। এই মধুর ফাঁদে শত শত রাঘব বোয়াল ধরা দেবেন এ আর নতুন কথা কী।
০৫. বাৎস্যায়নের চোখে গণিকা
প্রাচীন যুগে গণিকাদের বিবরণ দিতে চাইব, অথচ বাৎস্যায়নের কামসূত্রম’ উল্লেখ করব না, তাই হয় নাকি? কামসূত্রম আলোচনা করার আগে গ্রন্থের রচয়িতা বাৎস্যায়নকে না-জানলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মল্লনাগ বাৎস্যায়ন ছিলেন বেদজ্ঞ ভারতীয় দার্শনিক। ধারণা করা হয় তিনি গুপ্তযুগে চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী ভারতে বর্তমান ছিলেন। কামসূত্রম ও গৌতমের ন্যায়সূত্র গ্রন্থের টীকা ‘ন্যায়সূত্ৰভাষ্য’-এর রচয়িতা রূপে তাঁর নাম পাওয়া যায়। তবে সম্ভবত, বাৎস্যায়ন নামক কোনো একক ব্যক্তি এই দুই গ্রন্থ রচনা করেননি। তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মল্লিনাগ বা মৃল্লান। বাৎস্যায়ন ছিল তার বংশনাম বা পদবি। নিজ গ্রন্থের শেষে তিনি যে আত্মপরিচয় দান করেছেন তা এরকম–“বাভ্রব্য ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থকারদের রচনা পড়িয়া তদনুসারে এবং তাঁহাদিগের দ্বারা প্রদত্ত অর্থবিধান পর্যালোচনা করিবার পর পবিত্র আদেশানুসারে জগতের কল্যাণার্থে বারাণসীর চতুষ্পঠীর ছাত্র ও দেবসেবক বাৎস্যায়ন কর্তৃক এই সন্দৰ্ভটি রচিত হইয়াছে। ইহা আমাদিগের কামনাবাসনা চরিতার্থ করিবার পুস্তক নহে। যে ব্যক্তি এই বিজ্ঞান সম্পর্কে সম্যক অবহিত, যিনি নিজ ধর্ম, অর্থ ও কাম রক্ষা করিয়া এবং লোকাঁচার মানিয়া চলেন, কেবল তিনিই তাঁর ইন্দ্রিয় জয়ে সক্ষম। সংক্ষেপে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তি ধর্ম ও অর্থের অধিকারী হইলে কামেরও অধিকারী হইবেন। তজ্জন্য তাঁহাকে তাঁহার কামনা বাসনার ক্রীতদাসত্ব করিতে হইবে না। তিনি যাহাই করিবেন তাহাতেই সাফল্য পাইবেন।”
বাৎস্যায়নের জীবন বা রচনার সঠিক সময়কাল নির্ধারণ করা অসম্ভব। সম্ভবত খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো একসময়ে তিনি বিদ্যমান ছিলেন। তাঁর রচনায় আছে, কুন্তলরাজ সাতকর্ণী সাতবাহন কামান্ধ হয়ে কর্তারি নামক অস্ত্রের সাহায্যে নিজ পত্নী মাল্যবতাঁকে হত্যা করেন। এই ঘটনা উল্লেখ করে বাৎস্যায়ন সর্বসাধারণকে সতর্ক করে দেখিয়ে দেন যে কামান্ধ হয়ে নারীকে আঘাত করার মতো প্রাচীন প্রথা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। এই কুন্তলরাজ খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে বিদ্যমান ছিলেন। অর্থাৎ, বাৎস্যায়নের সময়কাল প্রথম শতাব্দীর পরে। আবার বরাহমিহির রচিত ‘বৃহৎসংহিতা’ গ্রন্থের অষ্টাদশ অধ্যায়টিও কামকলা সংক্রান্ত। এর বিষয়বস্তু মূলত বাৎস্যায়নের গ্রন্থ থেকে গৃহীত। বরাহমিহিরের সময়কাল খ্রিস্ট্রীয় ষষ্ঠ শতাব্দী। অর্থাৎ, বাৎস্যায়ন যেহেতু বরাহমিহিরের পূর্বে তাঁর গ্রন্থ রচনা করেন, সেইহেতু তিনি প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে বিদ্যমান ছিলেন।
বাৎস্যায়ন ছিলেন কোনো ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তান। কেউ কেউ মনে করেন তাঁর বাল্যকাল কেটেছিল এক গণিকালয়ে, যেখানে তাঁর প্রিয় মাসি কাজ করতেন। এখান থেকেই তিনি কামকলা সংক্রান্ত প্রথম জ্ঞান লাভ করেছিলেন। বাৎস্যায়নের কামসূত্রম পাঠ করলে বোঝা যায়, ওইরূপ কামবিলাসসম্পন্ন পুরুষ ও নারীদের যুগে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। কোথায় এবং কোন্ দেশে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাঁর ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত বিশেষ পাওয়া যায় না। তবে মনে হয়, তিনি গুপ্ত সম্রাটদের সময়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই গুপ্ত সম্রাটদের সময়েই মহাকবি কালিদাস, জ্যোতির্বিদ বরাহ মিহির ইত্যাদি মনীষা সম্পন্ন ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাৎস্যায়নের সাহিত্যের মতো তাঁদের সাহিত্যে ও অনেক অধুনা সমাজ বিরুদ্ধ ও তথা কথিত বর্তমান ‘অশ্লীল’ আখ্যা বিশিষ্ট কবিতা ও লেখা দেখতে পাওয়া যায়। নাট্যলেখক শূদ্রক রাজা ও ওই সময়ে তাঁর ‘মৃচ্ছকটিক’ নামে সংস্কৃত নাটক লেখেন। তবে অনেকে বলেন বাৎস্যায়ন খ্রিস্টপূর্ব যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন খ্রিস্টজন্মের পরবর্তী যুগে তিনি জন্মগ্রহণ করেন দাক্ষিণাত্য দেশে। এ বিষয়ে অনেক মতানৈক্য আছে। তবে আমরা একথা অনেকটা বিশ্বাস করি যে, মহর্ষি বাৎস্যায়ন গুপ্তরাজাদের সময়কালেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বহুদেশ বিদেশ ঘুরে যৌনক্রিয়ার বিভিন্ন প্রচলন দেখে জ্ঞান লাভ করে কামসূত্রম’ নামে গ্রন্থটি রচনা করেন।