প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত তিন চিকিৎসক হলেন–চরক, সুশ্রুত ও ভাগবত। এঁরা তাঁদের রচিত গ্রন্থে বিষকন্যাদের কথা লিখে গেছেন। সেখানে বলা হয়েছে বিষকন্যাদের চেনার সহজ উপায়–(১) অকারণ হাসি, (২) চুলে আঙুল চালানো, (৩) সন্দেহজনক আচরণ, (৪) অতিরিক্ত কথা বলা, (৫) মাটি আঁচড়ানো, (৬) ঘনঘন পিছন ফিরে দরজা দেখা, (৭) কোনো প্রশ্ন করলে নীরব থাকা ইত্যাদি।
বিষকন্যার বিষের সঙ্গে কীভাবে রক্ষা পেতে হবে, সেই উপায়ও বাতলে দিয়েছেন চিকিৎসক সুশ্রুত। কীভাবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে সে কথাও বলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন মেয়েদের অন্ন, দাঁত মাজার সামগ্রী, চুলের তেল, জামাকাপড়, স্নানের জল, চোখের পথ্য, অলংকার, প্রসাধনী দ্রব্য ইত্যাদিতে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রাচীন যুগে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই বিষকন্যাদের ব্যবহার ছিল। বোহেমিয়ার রাজা দ্বিতীয় ওয়েনচেসলাউসের মৃত্যু হয় বিষকন্যাদের সংসর্গেই। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতের রাজনীতিতে বিষকন্যাদের দাপট ছিল ব্যাপক। অঙ্গ, কোশল, কাঞ্চী, অবন্তী সহ একাধিক রাজাদের পরাজিত করে মগধের উত্থান হয়েছিল এই বিষকন্যাদের সংসর্গে। মুদ্রারাক্ষস, অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে সেইসব রোমহর্ষক কাহিনি পাওয়া যায়। নন্দবংশের শাসনামলে বিষকন্যা কর্তৃক রাজা ও রাজপুরুষদের গুপ্তহত্যা প্রবলভাবে বেড়ে যায়। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা একবার মরতে মরতে বেঁচে যান চাণক্যের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে। মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে মগধসম্রাট ধননন্দের সঙ্গে বিরোধ ছিল। দাম্ভিক, প্ৰজাবিদ্বেষী রাজা ধননন্দের ভয়ে চন্দ্রগুপ্ত জঙ্গলে আত্মগোপন আছেন। প্রজ্ঞা ও চতুর কৌশলে চাণক্য আভাস পাচ্ছিলেন চারপাশে চন্দ্রগুপ্তকে হত্যার চক্রান্ত চলছে, তার মধ্যে বিষকন্যা কর্তৃক বিষের আক্রমণের সম্ভাবনাই ছিল প্রবল। তাই চন্দ্রগুপ্তের খাবারে তিনি গোপনে প্রতিদিন বিষ মিশিয়ে দিতেন। বিষের স্পর্শ থেকে বাঁচাতে চাণক্য এইভাবেই চন্দ্রগুপ্তের শরীরকে তৈরি করতে থাকলেন। যুদ্ধে ধননন্দের মৃত্যু হলেও ধননন্দের রাক্ষস নামক মন্ত্রী চন্দ্রগুপ্তের কাছে এক লাস্যময়ী বিষকন্যাকে পাঠিয়ে দিলেন। মৌর্যসম্রাটের ছায়াসঙ্গী চাণক্য সেই বিষকন্যাকে দ্রুত চিনে ফেললেন। তিনি সেই বিষকন্যাকে চন্দ্রগুপ্তের ত্রিসীমানায় ঢুকতে দিলেন না। বিষকন্যাকে পাঠিয়ে দিলেন পর্বতকের কাছে। পর্বতক ধননন্দের পুত্র। পর্তক চন্দ্রগুপ্তের প্রতিদ্বন্দ্বী। চন্দ্রগুপ্তের পথের কাঁটা হয়ে তিনিও গোপনে ষড়যন্ত্র রচনা করছিলেন। চন্দ্রগুপ্তকে পাঠানো বিষকন্যার ছোবলেই পর্বতকের মৃত্যু হয়।
তবে এমন শোনা যায় যে, বিষকন্যারা একবার কারোর মৃত্যুর কারণ হলে তাঁর শরীর থেকে বিষ শেষ হয়ে যেত। তাই একই সঙ্গে দুজনের মৃত্যু ঘটানো সম্ভব হত না, যতক্ষণ-না নতুন করে তাঁদেরকে বিষের জোগান দেওয়া হত। বিষ হজম করে বড় হতে থাকা মেয়েদের উপর চলত বিশেষ প্রশিক্ষণ। রাজ্যের বিশিষ্ট গণিকা, নর্তকীদের তত্ত্বাবধানে চলত এঁদের শিক্ষাদীক্ষা। শরীরের প্রতিটি অঙ্গের ব্যবহার কীভাবে সুচারুভাবে করতে হয়, তার শিক্ষা নিতে হত। শিখতে হত মোহময় বাক্যজাল বিস্তার। পুরুষকে আকর্ষণ করার সমস্ত ছলাকলাই শিখতে হত। এর সঙ্গে শিখতে হত ছদ্মবেশ ধারণ করা ও কামকলা। তাঁদের চলনে, বলনে, শরীরী কটাক্ষে ঝরে পড়তে হবে উত্তেজক যৌনতা। সেই যৌনতায় খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে তাবড় রাজা-মহারাজা বীরপুরুষরা।
এইসব বিষকন্যাদের মতো হত্যাকারিণীদের কি কোনো শাস্তির বিধান ছিল? না, এমন কোনো বিধান বা নির্দেশ ছিল না। তবে কোনো মেয়েকে বিষকন্যা বলে টের পেলে তাঁর শরীর তলোয়ার দিয়ে টুকরো টুকরো কেটে ফেলা হত। তারপর মাটিতে পুঁতে দেওয়া কিংবা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হত। আমি আগেই উল্লেখ করেছি আলেকজান্ডারও তলোয়ার দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করেছিল গুপ্তঘাতিনী লাস্যময়ী বিষকন্যাকে। তারপর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কেটে দু-টুকরো করে দেওয়াই হোক বা মাটিতে পুঁতে ফেলাই হোক, আগুনে পুড়িয়ে দেওয়াই হোক–কী যায় আসে! এই অভাগাদের জীবন কি জীবন! মৃত্যুতেই এই অভাগা নারীদের মুক্তি। সেই শৈশবকাল থেকেই তাঁদের নিয়মিত বিষপান করতে হত রাজাদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায়। নিজের শরীরে বিষ প্রতিরোধ করার সক্ষমতা এলে মানুষ মারার উপযুক্ত হয়ে উঠলে সেই মেয়েদের পাঠানো হত বিভিন্ন রাজার দরবারে। সব মেয়েই বিষ প্রতিরোধ করতে পারত না। অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন। হত অকালমৃত্যু। ভাগ্যক্রমে বেঁচে থাকলে কোনো রাজার বিশ্বাসভাজন হয়ে থাকতে হত শরীরে বিষের জ্বালা নিয়ে। সেই রাজা যখন মনে করত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিপক্ষ রাজাকে হত্যা করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, তখন এইসব মেয়েদের পাঠিয়ে দেওয়া হত সংশ্লিষ্ট রাজার বিলাসভবনে।এঁদের প্রথম কাজ ছিল রাজার খাবারে বিষ মিশিয়ে খাওয়ানো। তবে রাজাকে সন্দেহমুক্ত করার জন্য নিজেকেও সেই বিষ মেশানো খাবার খেতে হত। এরপর রাজা সেই বিষ-খাবার খেয়ে মারা যেত, কিন্তু বিষকন্যাদের কিছু হত না। রাজাদের সাম্রাজ্যগ্রাসের কুটিল রাজনীতিতে বিষই হয়ে উঠেছিল বিষকন্যাদের জীবনের একমাত্র পরিচয়, যাকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করত সেকালের ধুরন্ধর রাষ্ট্রনেতা, সমরবিদরা।