শৈশবকাল থেকেই সুন্দরী কন্যাসন্তানদের শরীরে অল্প অল্প করে বিষ প্রয়োগ করে তাঁদের শরীরকে বিষ সহনীয় করে তোলা হত। এই প্রক্রিয়াকালে অনেক কন্যাসন্তান বিষের প্রভাবে মারাও যেত। যাঁরা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যেত, তাঁদের শরীর জুড়ে বিষের প্রবাহ। এইসব মেয়েরা পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে উঠলে শত্রু কবজা করতে পাঠিয়ে দেওয়া হত। এঁরা শরীরী-ছলনায় কামুক পুরুষদের দখল নিত। যে পুরুষ যৌনকামকে জয় করতে পারত, তাঁকে কবজা করা জটিল হয়ে পড়ত।যে জয় করতে পারত না, তাঁর মৃত্যু অনিবার্য।
মোট কথা, ক্ষমতাবান শত্রুকে ধ্বংস করার জন্য বিষকন্যা পাঠানোর রেওয়াজ ছিলই। মৌযযুগেও এমন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। নন্দরাজার এক মন্ত্রী চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাছে বিষকন্যা পাঠিয়েছিল। চাণক্যের কুট-বিচক্ষণতায় সেই বিষকন্যাকে পর্বতক নামে এক ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পর্বতক বিষকন্যায় শরীরী ছলনায় আত্মসমর্পণ করলে তাঁর মৃত্যু হয়। ভারতবর্ষে ‘বিষকন্যা’ গণিকাদের বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়েই। বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকের প্রথম ও দ্বিতীয়াংশে বিষকন্যাদের উল্লেখ আছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও বিষকন্যার হদিস পাওয়া যায়। কল্কিপুরাণে সুলোচনা (সুলোচনা ছিলেন গন্ধর্ব চিত্রগ্রীবের স্ত্রী) নামে এক বিষকন্যার কথা জানা যায়। এইসব বিষকন্যার নজরে কোনো পুরুষ পড়লেই পুরুষটি মারা যায়।
তৎকালীন রাজারাও বিষকন্যাদের নিয়োগ করতেন শক্রনিধনের স্বার্থে। এহেন বিষকন্যারা একদিকে যেমন বহুপুরুষগামী, অপরদিকে হত্যাকারী। জিশুর জন্মের ৩২৭ বছর আগে আটাশ বর্ষীয় এক শক্তিশালী গ্রিক রাজার কথা জানতে পাই। তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল পশ্চিম ইউরোপ থেকে পারস্য পর্যন্ত। এই রাজা পারস্যরাজ দরায়ুসকে পরাজিত করে পৌঁছোলেন ভারত ভূখণ্ডে এবং ভারত জয় করে নিলেন। পুষ্কলাবতীর রাজা অষ্টক, অশ্বক জাতির রাজারা একে একে তাঁর কাছে পরাজিত হলেন। তক্ষশীলার রাজাও আত্মসমর্পণ করলেন। অর্ধেক পৃথিবীর ‘রাজা’ তৃতীয় আলেকজান্ডারের শিবিরে বহুমূল্যের উপঢৌকন পাঠালেন ভারতীয় রাজ্যের রাজা সিকান্দার। সঙ্গে পাঠালেন পাঁচ অপরূপ সুন্দরী লাস্যময়ী নারী। সেই ক্ষীণকটির রূপবৈভবে মুগ্ধ হয়ে গেলেন গ্রিক শিবির। নারীর প্রতি যে আলেকজান্ডারের আসক্তি ছিল, সে কথা ততদিনে ভারতে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই আসক্তিকেই সুচারুভাবে কাজে লাগালেন ভারতীয় রাজা। আলেকজান্ডারও ঘুণাক্ষরে টের পেলেন না ভারতীয় রাজার কৌশল। লুব্ধ দৃষ্টিতে মোহিত হয়ে লাস্যময়ী নারীর দিকে এগোতে থাকলেন আলেকজান্ডার। ভারতীয় রাজা এই সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আত্মসমর্পণের বদলা নিতেই রাজা লাস্যময়ীদের পাঠিয়েছিলেন। গ্রিকশিবিরের আলেকজান্ডারের সঙ্গে ছিলেন অ্যারিস্টটল। আলেকজান্ডারের গুরু। লাস্যময়ীর নৃত্যে আলেকজান্ডার মোহিত হয়ে গেলেও অ্যারিস্টটল সতর্ক ছিলেন। তিনি আলেকজান্ডারকে সতর্ক করে বললেন–“আর এগিয়ো না বৎস। এই লাস্যময়ী বিষকন্যা”। আলেকজান্ডার বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না গুরুকে।গুরু অ্যারাস্টটলের দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকাতেই গুরু বললেন–“অপেক্ষা করো বেটা। আমি প্রমাণ দিচ্ছি”। অ্যারিস্টটল ঈশারায় দুজন দাসকে কাছে ডাকলেন এবং আদেশ দিয়ে বললেন–“ওই নারীর ওষ্ঠে চুম্বন করো”।
চুম্বন করবে কী! তাঁরা সেই লাস্যময়ী নারী শরীর স্পর্শ করামাত্রই দুজন দাসই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এখানেই শেষ নয় পরীক্ষার। তিনি সেই নারীকে আলেকজান্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ঘোড়াকে স্পর্শ করতে বললেন। নারীর স্পর্শে নিমেষে তেজি ঘোড়া নিস্তেজ হয়ে গেল। এবার আলেকজান্ডারের মোহ ভাঙল এবং তলোয়ার দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে দিল এই গুপ্তঘাতিনী লাস্যময়ী নারীকে। তারপর বিষকন্যাকে পুড়িয়ে দেওয়া হল। এ কাহিনি পাওয়া যায় কবি গুইলাম ডি চেরভেরা রচিত ‘রোমানিয়া গ্রন্থ থেকে। এ কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছিল ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি পর্যন্ত। এছাড়া আলেকজান্ডারের যেসব উপদেশ অ্যারিস্টটল দিয়েছিলেন, তার একটা সংকলন প্রকাশিত হয়। সংকলনটির নাম ‘সিক্রেটা সিক্রেটোরাম’। সিক্রেট সিক্রেটোরামে অ্যারিস্টটল ভারতের বিষকন্যাদের থেকে শত হস্তে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন আলেকজান্ডারকে। অ্যারিস্টটল এটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন, অতীতে বহু রাজা খতম হয়েছেন এই বিষকন্যাদের সংসর্গে। ভারতের মতোই আকর্ষণীয় ভারতের বিষকন্যাদের কাহিনি। এই বিষকন্যারা গণিকা হিসাবে পরিচিত হলেও তাঁর সঙ্গে যৌনসংসর্গ করে উঠত পারত না শিকার। কারণ তাঁদের সামান্য স্পর্শেই শিকারের মৃত্যু অনিবার্য। সেই কারণেই বিনা যুদ্ধে শত্রুবিনাশে এই অপ্সরা-সুন্দরীদের ব্যবহার করত রাজা, মহারাজা, সম্রাটরা।
যে পদ্ধতিতে বিষকন্যাদের বিষসহনে অভ্যস্ত করা হত তার নাম মিথ্রিডেটিজম। গ্রিসের পন্টাসের রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডেটস নিজের শক্তিশালী শত্রুদের দমন করার জন্য প্রথম বিষকন্যাদের বিষময় করে তোলার পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তিনি ভীত ছিলেন এই ভেবে যে, তাঁর মা তাঁকে বিষ দিয়ে হত্যা করবে। সেই ভয়ে তিনি জঙ্গলে পালিয়ে যান। সেখানে গিয়ে বনচরদের কাছ থেকে শিখে নেন কীভাবে অল্প পরিমাণ বিষাক্ত পদার্থ শরীরে প্রবেশ করিয়ে বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করা যায়। বিষকন্যারা তাঁদের রূপের জালে রাজা বা রাজপুরুষ বা বণিকদের ফাঁসিয়ে গুপ্তহত্যার চেষ্টা করত প্রতিপক্ষ। শক্তিশালী শত্রু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মানবঘাতক বিষকন্যাদের ব্যবহার করার সবথেকে বড়ো সুবিধা হল, তাঁদের বিষকন্যা হিসাবে চেনা অত সহজ ছিল না। ভোগলালসা নারীসঙ্গে ডুবে থাকা রাজারা খুব সহজেই গণিকা বিষকন্যাদের সৌন্দর্য ও লাস্যের ফাঁদে পড়ে মৃত্যুর দেশে পৌঁছে যেত নিমেষের মধ্যেই। বিষকন্যাদের যে চেন যেত না, তা কিন্তু নয়। অভিজ্ঞরা অবশ্যই চিনতে পারতেন।