মহাভারতের যুগে এমন জনা পাঁচেক মুনি-ঋষির নাম পড়ে পড়ছে, যাঁরা গণিকাদের শরীরী ছলনায় বশীভূত হয়ে কামার্ত হয়ে যৌন-সংসর্গ করেছিলেন। এঁরা হলেন–বিশ্বামিত্র, শরদ্বান, ভরদ্বাজ, ব্যাস, বশিষ্ঠ, পরাশর, দীর্ঘতমা প্রমুখ। মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মানজনক বৃত্তিগুলির মধ্যে গণিকাবৃত্তি ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে গণিকাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। এঁরা মনোহর রত্ন, সোনা ও মণিমুক্তাখচিত অলংকারাদি ও মহামূল্য পোশাকে আচ্ছাদিত হয়ে রাজপথে অবাধে বিচরণ করতেন। যে-কোনো অনুষ্ঠানে ও শোভাযাত্রায় আয়োজন হলে পুরোভাগে বস্ত্রালংকার শোভিত সুন্দরী গণিকারা থাকতেন।
শুধু সুরলোকেই নয়, অন্যত্র গণিকাদের প্রয়োজনীয়তা ছিল যথেষ্ট, উপস্থিতিও ছিল লক্ষ্যণীয়। মহাভারতে তৃষ্টা নামক এক ঋষির কথা জানা যায়। ত্বষ্টার পুত্র ছিলেন ত্রিশিরা। ত্রিশিরা ছিলেন মদ্যপ ও নিষ্ঠাবান ধার্মিক। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল স্বর্গলোক জয়। যেহেতু স্বর্গলোকের চৌকিদার স্বয়ং ইন্দ্র, সেইহেতু ইন্দ্রের ভয়ের কারণ হল ত্রিশিরা। উপায় খুঁজতে রূপবতী গণিকাদের শরণাপন্ন হলেন পুরন্দর ইন্দ্র। ত্রিশিরার তপস্যা ভঙ্গ করতে সুন্দরী গণিকাদের কাজে লাগালেন দেবরাজ। এখনকার মতো মহাভারতের যুগেও সমরসম্ভারের সঙ্গে সৈন্যশিবিরে সুন্দরী গণিকাদের স্থান দেওয়া হত। সেনাদের একঘেয়েমি নিবারণ ও যৌনক্ষুধা মেটানোর জন্য এঁদের মজুত রাখা হত। যুযুধান দুইপক্ষ পাণ্ডব ও কৌরব সেনাশিবিরে অসংখ্য সৈন্যদের বিনোদন ও মনোরঞ্জনের জন্য শত সহস্র গণিকা নিয়োগ করা হয়েছিল। পাণ্ডব সেনাশিবিরে যেসব ‘বেশস্ত্রী’ অর্থাৎ বেশ্যা বা গণিকা নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁদের সুযোগসুবিধা যা কিছু দেখভালের দায়িত্ব সবই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের উপর ন্যস্ত ছিল। রামায়ণে রামচন্দ্রের জন্য যে স্বতন্ত্র সৈন্যবাহিনী গঠন করা হয়েছিল, সেই বাহিনীতে বিবিধ সমরসম্ভারেও অজস্র যৌবনবতী গণিকা নিয়োগ করা হয়েছিল।
শুধু হিন্দুধর্মেই নয়, আমরা ইসলাম ধর্মেও স্বৰ্গবেশ্যাদের কথা জানতে পারি, যাদের হুরপরি বলা হয়। বেহেশতকামীদের লোভ দেখাতেই এই স্বৰ্গবেশ্যাদের উপস্থাপনা। যাদের সঙ্গে বেহেশতবাসী পুরুষরা অনন্তকাল সেক্স করতে পারবে। মাসের পর মাস তাঁরা সেক্স করবে, কিন্তু সেই সেক্স কোনোদিন শেষ হবে না। তাঁরা ক্লান্ত হবে না, সেই বেশ্যারাও ক্লান্ত হবে না। কেমন হবে সেই গণিকারা? কেমন বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সব বেশ্যাদের? স্বৰ্গবেশ্যাদের শারীরিক বর্ণনা যা পাওয়া যায়, তা হচ্ছে অনেকটা এরকম–
প্রত্যেক বেহেশতবাসীকে দেওয়া হবে ৭২টি অনিন্দ্য সুন্দরী হুরপরি তাঁদের ভোগের জন্য। বেহেশতবাসীরা যে কোনো বয়সেই মারা যাক না-কেন, তাঁরা যখন বেহেশতে প্রবেশ করবে তখন তাঁদের বয়স হবে ৩০ বছরের যুবকের মতো এবং তাঁদের বয়সের আর কোনো পরিবর্তন হবে না; আর প্রত্যেক বেহেশতবাসীকে ১০০টি শক্তিশালী পুরুষের সমান যৌনশক্তি দান করা হবে (তিরমিজি, অধ্যায় ২, পৃষ্ঠা ১৩৮)। হজরত আলি বর্ণনা করেছেন, নবি বলেছেন যে বেহেশতে একটি মস্ত বড় খোলা বাজার থাকবে, যেখানে কোনো কেনাবেচা হবে না। সেখানে শুধুই থাকবে অতিসুন্দরী উন্নবক্ষা হুরপরিরা, যাঁরা ফলের দোকানের মতো সেজেগুজে বসে থাকবে বেহেশতবাসীদেরকে আকর্ষণ করার জন্য। বেহেশতবাসীদের পছন্দ হলেই তৎক্ষণাৎ তাঁরা সেই হুরির সঙ্গে যৌনকর্ম শুরু করে দেবে ঠিক সেখানেই (সহি হাদিস, অধ্যায় ৪, পৃষ্ঠা ১৭২, নং ৩৪)। হুরপরিরা এত বেশি সুন্দরী ও রূপসী হবে যে, তাঁরা যদি আকাশের জানালা দিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকায়, তাহলে সমস্ত দুনিয়া আলোকিত হবে এবং সুঘ্রাণে ভরে যাবে আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানের সব জায়গা। একজন হুরির মুখমণ্ডল হবে আয়নার চেয়েও মসৃণ বা পরিষ্কার, যাতে নিজ চেহারা দেখতে পাবে এবং হুরির পায়ের মজ্জা দেখা যাবে খালি চোখে (মিসকাত অধ্যায় ৩, পৃষ্ঠা ৮৩-৯৭)। একজন হুরি অনিন্দ্যসুন্দরী যুবতী, যাঁর শরীর হবে আয়নার মত স্বচ্ছ বা মসৃণ। তাঁর পায়ের হাড়ের ভেতরের মজ্জা দেখতে পাওয়া যাবে যেন মণি-মুক্তোর ভিতরে রেখার মতো। তাঁকে মনে হবে একটি সাদা গ্লাসে রাখা লাল মদের মতো। সে হবে সাদা রঙের দুধে আলতা মিশানো এবং তাঁর কখনো হায়েজ (মাসিক), মলমুত্র ত্যাগ, গর্ভবতী হওয়া ইত্যাদি কিছুই হবে না। হুরি হবে অল্পবয়স্কা, যাঁর স্তনযুগল হবে বড়ো বড়ো ও গোলাকার, যা কখনোই ঝুলে পড়বে না; সবসময় তীরের মতো তীক্ষ্ণ থাকবে। এসব হুরিরা থাকবেন এক অতি উজ্জ্বল এবং জৌলুসপূর্ণ জায়গায় (তিরমিজি, অধ্যায় ২, পৃষ্ঠা ৩৫ ৪০)।
আবু ওমামা বলেছেন যে, আল্লাহর রসুল বলেছেন—“আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহেশতে স্থান দেবেন এবং প্রতিটি বেহেশতবাসীকে বিবাহ দেবেন ৭২ জন অনিন্দ্যসুন্দরী রমণীয় সঙ্গে; যাঁদের মধ্যে দুইজন হবে চিরকুমারী আয়তলোচনা এবং বড়ো বড়ো চোখওয়ালা হুরি এবং বাকি ৭০ জন হবে উত্তরাধিকার, যা সে লাভ করবে জাহান্নমবাসীদের গনিমতের মাল থেকে। প্রত্যেকটি সুন্দরী রমণীর থাকবে খুব সুখদায়ক যৌনাঙ্গ এবং বেহেশতি পুরুষের যৌনাঙ্গ সর্বদাই শক্ত ও খাড়া হয়ে থাকবে, কখনো বাঁকা হবে না যৌনতার সময়। অর্থাৎ মূলত পুরুষাঙ্গটি সবসময়ই হুরপরিদের যোনির ভিতরে প্রবিষ্ট থাকবে পালাক্রমে একের পর এক প্রায় ৭০ বছর ধরে (হাদিস নং ৪৩৩৭ ইবনে মাজাহ, ভলিউম ৫, পৃষ্ঠা ৫৪৭)। আবু উমামা কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসুল বলেছেন–“আল্লাহ যাঁদের জান্নাতে প্রেরণ করবেন, তাঁদের প্রত্যেককে ৭২ জন হুরির সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হবে; যাঁর দুটি হুরি এবং বাকি সত্তরখানা হবে জাহান্নামবাসীদের সম্পত্তির। তাঁদের সকলের থাকবে কামুক যৌনাঙ্গ এবং তাঁর লিঙ্গ থাকবে অনন্তকাল উত্থিত [সুনান ইবনে মাজা, যুহদ (Book of Abstinence) ৩৯]। দারাজ ইবনে আবি হাতিম কর্তৃক উল্লেখিত, আবু সাইদ আল-খুদরির কাছ থেকে প্রাপ্ত, আবু আল-হায়থাম আবদুল্লাহ ইবনে ওহাব কর্তৃক বর্ণিত, যিনি শুনেছেন, নবি বলেছেন–“জান্নাতের সবচেয়ে ছোটো পুরস্কার হবে একটি প্রাকৃতিক ঘর, যেখানে আট হাজার ভৃত্য এবং ৭২ জন হুরি থাকবে, যার গম্বুজ থাকবে মুক্তো, পান্না ও চুনি দ্বারা সজ্জিত, এবং যা প্রশ্বস্ত হবে আল-জাবিয়াহ থেকে সানার মধ্যকার দুরত্বের সমান (আল-তিরমিজি, ভল্যুম ৪, চ্যাপ্টার ২১, নাম্বার ২৬৮৭)। একজন হুরির সঙ্গে প্রতিবার শয্যাগ্রহণকালে আমরা তাঁকে কুমারী হিসেবে পাব। তাছাড়া জান্নাতিদের লিঙ্গ কখনো নমনীয় হবে না। এই লিঙ্গোত্থান হবে অনন্তকালের জন্য; প্রতিবার তোমরা যে আনন্দ উপভোগ করবে, তা হবে পরম তৃপ্তিদায়ক যা এই দুনিয়ার কেউ পায়নি, এবং তোমরা যদি সেই পুলক দুনিয়াতে থেকে লাভ করতে তাহলে অজ্ঞান হয়ে যেতে। নির্বাচিত প্রতিটি মুসলিম বান্দা তাঁদের পৃথিবীর স্ত্রীদের ছাড়া আরও ৭০ খানা হুরির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হইবে, এবং তাঁদের সকলের থাকবে অত্যন্ত কামুক যোনি। (আল-ইতকান ফি উলুম আল-কুরান, পৃষ্ঠা ৩৫১)
০৪. গণিকাবৃত্তির এক করুণ রূপ বিষকন্যা
মহাভারতের যুগে ‘বিষকন্যা’ নামক এক শ্রেণির সুন্দরী গণিকাদের কথা জানা যায়। এঁরা খুনে গুপ্তচর বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তাঁদের কাজ ছিল যৌনসম্ভোগকালে ওষ্ঠ-চুম্বনে অথবা দন্তদংশনে এরা হত্যার জন্য প্রেরিত ব্যক্তির শরীরে বিষ ঢেলে দিত। সেই ব্যক্তি জ্ঞান হারালে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করত এবং তাঁর পুরুষাঙ্গটিও কেটে ফেলা হত। মহাভারতের চতুর্দশ অধ্যায়ের বিষয়ই বিষকন্যা পাঠিয়ে গুপ্তহত্যা। শ্রীসুখময় ভট্টাচার্য তাঁর ‘মহাভারতের সমাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন–“অনেক সময় শত্রুপক্ষ সুন্দর যুবতীকে উপঢৌকন স্বরূপ পাঠাইয়া থাকেন। পরিমিত মাত্রায় বিষ হজম করাইয়া সেই সকল কন্যাকে এমনভাবে তৈয়ারি করা হয় যে, তাহাদের স্পর্শমাত্রই অপর প্রাণী মৃত্যুমুখে পতিত হইয়া থাকে। সেই সকল কন্যাকে ‘বিষকন্যা’ বলে। গুপ্তচরের মুখে সমস্ত বার্তা অবগত হইয়া অতিশয় সাবধানে বাস করিবে। এই সকল প্রলোভন হইতে নিজেকে রক্ষা করিতে না পারিলে বিনাশ সুনিশ্চিত।”