- বইয়ের নামঃ গণিকা-দর্শন
- লেখকের নামঃ অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০. মুখবন্ধ (গণিকা-দর্শন)
গণিকা-দর্শন (প্রাপ্তমনস্কদের জন্য) – অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
.
উৎসর্গ : কবি অলোক বিশ্বাসকে
এক শীতের সকালে যে আমাকে ভাবিয়েছিল, চাইলে আমিও লিখতে পারি
.
সূচিপত্র
- মুখবন্ধ
- বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ
- গণিকা এবং চৌষট্টি কলার সমম্বয়
- স্বর্গের বেশ্যা যাঁহারা = স্বৰ্গবেশ্যা
- গণিকাবৃত্তির এক করুণ রূপ বিষকন্যা
- বাৎস্যায়নের চোখে গণিকা
- প্রাচীন সাহিত্যে গণিকা
- দেবদাসীর অন্য নাম গণিকা
- প্রাক-আধুনিক ও আধুনিক সাহিত্যে গণিকা
- বাবুবিলাসীদের গণিকাযাপন
- ভারতের বাঈজি-সংস্কৃতি ও গণিকাবৃত্তি
- ব্রিটিশ-ভারতে গণিকাদের সামাজিক অবস্থা
- অন্য দেশ : প্রাচীন সভ্যতায় গণিকাবৃত্তি
- যাত্রা-থিয়েটার-চলচ্চিত্রে গণিকা
- স্বাধীনতা সংগ্রামে গণিকা
- গণিকাবৃত্তি নানা রূপে
- দেশে দেশে গণিকাবৃত্তি
- পুরুষ যৌনকর্মীর বাজার
- গণিকাবৃত্তির বিশ্ব-অর্থনীতি
- গণিকালয়ের নাম সোনাগাছি
- উত্তরণ : বেশ্যা থেকে যৌনকর্মী
- পুরুষরা কেন যৌনকর্মীদের সাহচর্য চায়
- বেশ্যাদ্বারের মাটি : গূঢ়তত্ত্ব
- যৌনকর্মীরা কি বাধ্য হয়েই যৌনপেশায়?
- গণিকাবৃত্তির অধিকারের লড়াই, নিশ্চয়তা, নিরাপত্তায় স্বেচ্ছাসেবী
- গণিকাগমন এবং গনোরিয়া, সিফিলিস ও এইডস
.
মুখবন্ধ (গণিকা-দর্শন)
যৌনপেশা সাধারণত দুটো ভাগে ভাগ করে নেওয়া যায়–(১) রেড লাইট এরিয়া এবং (২) নন-রেড লাইট এরিয়া। রেড লাইট এরিয়ায় মূলত বিক্রি হয়ে, পাচার ও প্রতারিত হয়ে আসা মেয়েরা বাধ্য হয়ে যৌনপেশায় যুক্ত থাকে। এঁরা সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন। নন-রেড লাইট এরিয়ার গণিকারা স্বেচ্ছায় যৌনপেশা বেছে নেয়। অতিরিক্ত রোজগারে আশায় এ পেশায় আসে। এঁরা কেউ স্বাধীন, কেউ-বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করে। এঁরা সমাজের মূলস্রোতে বুক ফুলিয়েই থাকে। চাকরির মতো সকালে সেজেগুজে বেরয়, রাতে বাড়ি ফেরে।
গণিকাবৃত্তি বা বেশ্যাবৃত্তি বা যৌনপেশা আমাদের মনুষ্য সমাজে দুটি নজরে বা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়। সর্বাপেক্ষা প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিটি হল নোংরামি, অনৈতিক এবং দণ্ডনীয়। অর্থাৎ গণিকাবৃত্তিকে দেখা হয় পাপকর্ম বা পাপাচার হিসাবে। অপর দৃষ্টিভঙ্গিটি হল সেফটি ভালব, মানুষের যৌন অবদমন থেকে মুক্তিদাত্রী। নারীদের গণিকাবৃত্তিকে সেফটি ভালব হিসাবে দেখার কারণ বিবাহের সীমার মধ্যে যেসব পুরুষের অধরা যৌনবাসনা পূরণ না-হয়, তাঁদের সেই কামনা চরিতার্থ করতেই সমাজে গণিকাবৃত্তির প্রয়োজন। গণিকারা যেন নীলকণ্ঠ, সমাজের পুরুষ-বিষ ধারণ করবে সে–এরকম একটা ট্যাবু।
অন্দরমহলে নারীর মূলত প্রধান দুটি ভূমিকা–একটি স্ত্রী, অন্যটি মাতা। দুটি সম্পর্কেই যত দ্বন্দ্ব! দুটি ভূমিকাই প্রজন্মের প্রজনন কর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রজনন প্রশ্নে অবশ্যই আসবে যৌনতা। যৌনতা বলতে গোদা বাংলায় অবশ্যই যৌনক্রিয়া বা ইন্টারকোর্স বোঝায়। যেহেতু নারীর যৌনতাকে কেবলমাত্র বিবাহের মাধ্যমেই বৈধতা দেওয়া হয়েছে, তাই বিবাহের মধ্যেই যৌনতাকে সংগঠিত করা হয়। বৈবাহিক জীবনে নারীর যৌনতা একটি গৃহস্থালী দায়িত্ব ও কর্তব্যে পর্যবসিত হয়ে যায়। স্বামীর যৌনক্ষুধা নিবারণ ও সন্তান উৎপাদনের জন্য উৎসর্গীকৃত নারী। স্বামী-স্ত্রীর এই সম্পর্কে যদি স্ত্রীর কামনা-বাসনা কিছুটাও পরিতৃপ্ত হয়, তা সত্ত্বেও বিবাহ নামক এই প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছে সন্তান উৎপাদন ও স্বামীর যৌনক্ষুধা নিবারণ করতে। নারীর যৌনক্ষুধার তৃপ্তি মিটুক বা না-মিটুক বংশরক্ষার কারণে নারীকে অবশ্যই যৌনকর্ম করতে হবে। পুরুষকেও কেবলমাত্র স্ত্রীর সঙ্গেই যৌনকর্ম করতে হবে। তবে পুরুষ স্ত্রীসঙ্গ ছাড়া অন্য নারীর সঙ্গও পেতে পারে। বিশাল বাজার তাঁর জন্য খোলা আছে। চাইলেই বহুগামী মনকে বিকশিত করতে পারে। অথবা যৌন অবদমন থেকে মুক্তি পেতে পারে। কিন্তু আর্থ-সামাজিক কারণে তেমন সুযোগ হয়তো কম। সেই কম সুযোগটাকেও অনেক সাহসী নারী কাজে লাগিয়ে থাকে। স্বামী বা স্ত্রী ব্যতীত অন্য নারী বা পুরুষের সঙ্গে যৌনাচার করতে সাহস তো লাগেই। তাই নারী যৌনকর্মীদের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ যৌনকর্মীদের বাজারও আছে। দেহ বিক্রির বাজার না-নারী না-পুরুষদের জন্যেও আছে, যাদের আমরা সমকামী ও রূপান্তরকামী বলে থাকি।
গণিকাবৃত্তির যদি কেবলই নেতিবাচক প্রভাব থাকত, তবে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সমাজে বা রাষ্ট্রে এই পেশা বিদ্যমান থাকত না হাজার হাজার বছর ধরে। কবেই নির্মূল হয়ে যেত। আসলে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এর বহু ইতিবাচক প্রভাব আছে। পেশাগত দিক থেকেও লাভজনক। ইকোসিস্টেমে যেমন পৃথিবীর কোনো প্রাণীকেই অপ্রয়োজনীয় ভাবতে পারি না, তেমনি কোনো পেশাকেই অপ্রয়োজনীয় ভাবার কোনো অর্থ নেই। কেউ যদি স্বেচ্ছায় কোনো পেশা বেছে নিয়ে নিজের মতো করে, তাতে তো কারোর আপত্তি থাকার কথা নয়। সারা দেশে বেকারত্বের সংখ্যা উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি সর্বত্র কর্মসংস্থানের হাহাকার। উচ্চমেধাদের জন্য কিছু ব্যবস্থা থাকলেও মধ্যমেধা আর নিন্মমেধাদের জন্য আর কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। চতুর্দিকে যে হারে অটোমেশন ঢুকে পড়েছে, ভবিষ্যতে মধ্যমেধা আর নিন্মমেধারা ভয়ানকভাবে সংকটে পড়বে। এখনই পরিলক্ষিত হচ্ছে এমএ পাশ পিএইচডি করা ছেলেমেয়েরা চতুর্থ শ্রেণি বা ডোমের পেশার মতো জায়গায় আবেদন করছে। যাঁরা বিশেষ কোনো কাজে দক্ষ নয়, তাঁরা নির্বিবাদে বেছে নিচ্ছে অন্য পেশা। তার মধ্যে যৌনপেশাও আছে–নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। কী বললেন? যৌনপেশা সম্মানজনক পেশা নয়? সমাজ যৌনকর্মীদের ঘৃণা করে? একদম ঠিক বলেছেন। যৌনপেশা ছাড়া গোটা পৃথিবী সহ আমাদের দেশেও অসংখ্য মানুষ নিজের পেশা লুকিয়ে জীবন অতিবাহিত করে। কী পুরুষ, কী নারী। কারণ সেই পেশা সমাজে সম্মানজনক নয়। সমাজের এক শ্রেণির মানুষ সেই পেশাকে ‘ছোটো কাজ’ বলে ঘৃণা করে। তাঁর প্রতি সম্বোধনই বদলে যায়। তবুও মানুষকে সেই পেশাকেই বেছে নিতে ভরা পেটে বেঁচে থাকার জন্য। পাথরপ্রতিমায় আমার এক পরিচিতের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে রিকশা চালাচ্ছিল। আমার ক্লাসমেট ছিল। ও বনগাঁ থেকে প্রতিদিন সকালে স্যুটেড বুটেড হয়ে হাতে অফিস ব্যাগ নিয়ে ট্রেন ধরত। সবাই জানত সে কোনো অফিসে কাজ করে। পাথরপ্রতিমায় এসে নিজের পোশাক খুলে রিকশার সিটের নীচে ঢুকিয়ে রেখে সস্তার পোশাক পরে নিত। তারপর রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়।