মূর একদা বলেছিলেন, ভাববাদীর মতে যে-হেতু অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ বস্তুর সত্তা থাকতে পারে না, সেইহেতু মানতে হবে, ট্রেন একবার প্লাটফর্ম ছাড়বার পরই তার চাকা উবে যায়, কেননা চলন্ত ট্রেনে বসে ট্রেনের চাকা তো চোখে দেখা যায় না। কিন্তু এই বিদ্রুপের ভাববাদী জবাব অতি সরল; চলন্ত ট্রেনের চাকাকে অযথার্থ মনে করা ভুল হবে, কেননা তা অভিজ্ঞতারই বিষয়; কেবল এই অভিজ্ঞতা বাস্তব অভিজ্ঞতা নয়, “সম্ভব”। অভিজ্ঞতা মাত্র। “যে টেবিলের উপর আমি এখন লিখছি”, বার্কলি বলেছিলেন, “সে টেবিলের অস্তিত্ব আছে; অর্থাৎ আমি একে দেখতে পাই, অনুভব করতে পারি; এবং আমি যদি পড়ার ঘরের বাইরে যৌতুম, তাহলেও আমি বলতুম, এর অস্তিত্ব আছে; অর্থাৎ পড়ার ঘরে থাকলে আমি তাকে অনুভব করতে পারতুম; কিংবা অন্য কোন আত্মা বাস্তবিকই তাকে অনুভব করছে।”
সাম্প্রতিক বস্তম্বাতন্ত্র্যবাদীর ভাববাদ খণ্ডন যে কীরকম পঙ্গু ও অথর্ব, আর একটি দৃষ্টান্ত দেখিয়ে এ আলোচনা শেষ করব। আলেকজাণ্ডার হলেন সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের আর একজন দিকপাল দার্শনিক। বিশ্বের সমস্ত সত্তাকে তিনি দুভাগে ভাগ করেছেন, মন আর বহির্বস্তু। এক ভাগের একটির সঙ্গে অপর ভাগের আর একটির সংযোগ ঘটলে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার জন্ম হয়। ভেবে দেখতে হবে, এই সংযোগঠিক কোন জাতের। আলেকজাণ্ডার বলেন, এই সংযোগ-বিচারে ভাববাদীর দল মনকে অযথা প্ৰাধান্য দিয়ে বসে, মনে করে, এই সংযোগের ক্ষেত্রে জ্ঞানের বিষয় নির্ভর করে জ্ঞানের উপর। আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়, এ সংযোগ অতি সাধারণ একত্র-সমাবেশ মাত্র, যে রকম একত্ৰসমাবেশ ডিশের সঙ্গে টেবিলের ৭ ডিশের উপর টেবিলের সত্তা নির্ভর করে। না, টেবিলের উপর ডিশের সত্তাও নয়। মনের উপর বিষয়ের সত্তা নির্ভর করবে। কেন? কিন্তু শুধু এই কথা বলে থেমে যাওয়া যায় না, জ্ঞান নামক একত্র-সমাবেশের অন্তত একটা কোনো বৈশিষ্ট্য তো মানতেই হয়, কেননা যে-কোনো একত্ৰ-সমাবেশের বেলায় তো জ্ঞান হয় না! আলোকজাণ্ডার বলছেন, এ বৈশিষ্ট্য সমাবেশের বৈশিষ্ট্য নয়, সমাধিত এক উপাদানের বৈশিষ্টা মাত্র। অর্থাৎ অন্যান্য সমাবেশের বেলায় উভয় উপাদানই বহির্বস্তু, জ্ঞানের বেলায় একটি উপাদান হলো মন বা জ্ঞাতা। এই কথা শুনে ভাববাদী নিশ্চয়ই বিক্রম করে বলতে পারেন–অর্থাৎ আলেকজাণ্ডারের মতে “জ্ঞান” হলো এমন এক একত্ৰ-সমাবেশ, যার একটি উপাদানের মধ্যে “জ্ঞান” বর্তমান; এবং ন্যায়শাস্ত্রের অতি সাধারণ ছাত্রও জানে, এই জাতীয় সংজ্ঞা petitio principii নামের এক সরল অনুপপত্তি।
০৩. বুদ্ধি দিয়ে, তর্ক করে, ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না
বুদ্ধি দিয়ে, তর্ক করে, ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না; এ প্রচেষ্টা স্বয়ংবিরুদ্ধ, আত্মঘাতী। কেননা, এই পথে এগুতে গেলে বুদ্ধির দাবিকে, চেতনার দাবিকেই চরম দাবি বলে মেনে নিতে হয়,–আর সেটিকুই তো ভাববাদের আসল কথা। তাই, দিকপাল দার্শনিকও ভাববাদকেই খণ্ডন করতে এগিয়ে শেষ পর্যন্ত ভাববাদের জালেই জড়িয়ে পড়েছেন-দর্শনের ইতিহাসে এ যেন এক গোলকধাঁধাই। যুগে যুগে বারবার মানুষের চরম বুদ্ধি, চরম মনন-মনীষা ভাববাদকে অসম্ভব বলে চিনতে চেয়েছে, তবুও মুক্তি পায়নি তার সম্মোহিনী দাসত্ব থেকে। যেন মৃত্যুর পরই পৌরাণিক দেবতার পুনরুজ্জীবন, আর দর্শনের মন্দিরে আপাত তেত্রিশকোটি দেব-দেবীর মধ্যে এই দেবতার উদ্দেশ্যেই প্ৰায় তৈলধারার মতো অবিচ্ছিন্ন উপাসনা।
ভাববাদী তো উল্লাস করে বলবেনই; ভাববাদ খণ্ডনের সমস্ত প্ৰচেষ্টাই বৃথা। এ যেন ভাইয়ে-ভাইয়ে মামলাবাজি (কেয়ার্ড), কেননা দর্শন আর ভাববাদ নেহাতই তো সহোদর। কিংবা, যা একই কথা, যা কিছু বুদ্ধিসহ, তাকেই যথাৰ্থ বলে মানতে হবে, আবার যা কিছু যথার্থ, তাকেই বুদ্ধিসহ বলতে হবে (হেগেল)। সত্তা আর চেতনা যেন একই কাচের উত্তল আর অবতল দুটো দিক, যেন একই চুম্বকের দুই মেরুকেন্দ্র। একটিকে বাদ দিয়ে আর একটির কথা ভাবাই যায় না, যেমন ভাবা যায় না। একটা ছড়ির কথা, যে-ছড়ির মাত্র একটি প্রান্ত! দর্শন যদি সত্তা-সন্ধানী হয়, এবং সত্তার রূপ যদি আনিবাৰ্যভাবেই চেতন-নির্ভর হয়, তাহলে ভাববাদ ছাড়া দর্শনের পক্ষে আর কী গতি হতে পারে? ভাববাদ সমস্ত দর্শনেরই যে আনিবাৰ্য পরিণাম শুধু তাই নয়, দার্শনিক প্রচেষ্টারই নামান্তরমাত্র।
হেগেল-কেয়ার্ড-এর এই যে কথা, একদিক থেকে দর্শনের অতীত ইতিহাসের এমন নিখুঁত বর্ণনা একান্তই বিরল। আবার অন্যদিক থেকে, অসত্যের এমন চূড়ান্ত দৃষ্টান্তও দুর্লভ কম নয়।
দর্শনের অতীত ইতিহাসটুকুর আশ্চৰ্য নিখুঁত বৰ্ণনা। কেননা যাকে আমরা এতদিন ধরে দর্শন বলে জেনেছি, তার চূড়ান্ত আবেদন শেষ পৰ্যন্ত বিশুদ্ধ চেতনার কাছেই–তৰ্কশাস্ত্রের হাজার রকম জটিল আলিগলি ঘুরে বিশুদ্ধ বুদ্ধির আর বিচারের দাবি অনুসারেই দার্শনিক আলোচনার শেষ সিদ্ধান্ত সন্ধান করা হয়েছে। এক কথায়, চেতনাকেই মেনে নেওয়া হয়েছে দর্শনের চরম কষ্টিপাথর বলে।
অবশ্য তাই বলে বিপরীত মতবাদ–অচেতনকারণবাদ বা বস্তুবাদ—মাঝে মাঝে মাথা তোলবার চেষ্টা যে করেনি, তা নয়। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত–অর্থাৎ আধুনিক যুগে আধুনিক বস্তুবাদের প্রতিষ্ঠা হবার আগে পর্যন্ত–তার পরমায়ু নেহাতই ক্ষীণ, তার পদক্ষেপ দ্বিধাবিড়ম্বিত, আত্মনিশ্চয়তার অভাবে সে এগিয়েছে আত্মঘাতের পথে, এমন-কী বিরুদ্ধ আবহাওয়ায় পড়ে সে অনেক সময় একটা রফা করে নিতে চেয়েছে বিরুদ্ধ মতবাদের সঙ্গেই-চেতনকারণবাদের সঙ্গেই। এই বস্তুবাদ সম্বন্ধে সাধারণ দার্শনিক সমাজের ভঙ্গিটাও লক্ষ করবার মতো; সাদর সম্ভাষণ তার কপালে কোনোদিনই জোটেনি, বরং জুটেছে শুধু প্ৰতিবন্ধ আর বিড়ম্বনা। যখন সে দুঃসাহসীর মতো বড় বেশি দুবিনীত হইচই শুরু করেছে, তখন তাকে দর্শনের আঙিনার এক কোনায় বড়জোর একটুখানি আসন করে দেওয়া হয়েছে অম্পশ্যের মতো, কিন্তু সেই সঙ্গেই চক্রান্ত-পরামর্শ চলেছে, কেমন করে তাকে একেবারে একঘরে করে তার ভিটেমাটি পর্যন্ত উচ্ছেদ করা যায়। কখনো বা তাকে খোলাখুলি গালাগালি করে একেবারে উচ্ছন্নে পাঠাবার ব্যবস্থা, কখনো বা তাকে সংস্কার করে জাতে তুলে নেবার অজুহাতে একেবারে সর্বস্বাস্ত করে দেবার কৌশল। খোলাখুলি গালাগালি করবার দৃষ্টান্ত সংখ্যায় বহুলতর, এমন-কী অনেকসময় ‘বস্তুবাদ’ শব্দটি দার্শনিক অপচেষ্টার নামান্তর হিসেবে ব্যবহৃত। কিন্তু এ জাতীয় দৃষ্টান্ত অনেক স্থূল, অনেক ভোতা। এর মধ্যে চিত্তাকর্ষণ কম। বরং, সংস্কার করবার নামে সর্বস্বাস্ত করবার উদ্যম দৃষ্টান্ত হিসেবে অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক। এ-উদ্যমের উদাহরণ সর্বদেশে, সর্বযুগে; অতীতের ভারতবর্ষে, প্ৰাচীন গ্রীসে, আধুনিক ও সাম্প্রতিক য়ুরোপে-প্ৰায় সর্বত্রই। আমাদের দেশে চার্বাকের দেহাত্মবাদ দেবগুরু বৃহস্পতির কৃটি অভিসন্ধি বলে প্রচারিত; সাংখ্য দর্শনের মধ্যে প্ৰধানকারণবাদের রেশটুকুকে সংস্কার করতে করতে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানভিক্ষু এর মধ্যে এমন-কী ঈশ্বরের জন্যও জায়গা করে ফেললেন; বুদ্ধদেবের দেহত্যাগের পর বৈভাসিক ও সৌত্ৰিাস্তিকদের মধ্যে বস্তুবাদের যতটুকু ভগ্নাংশ পড়েছিল, সেটুকুকে উপহাস করে মাধ্যমিক আর যোগাচাররা প্রচার করলেন-তথ্যাগতের পক্ষে ওটুকু নেহাতই মন্দবুদ্ধির মানুষকে প্ৰবোধ দেবার প্ৰচেষ্টা। বিদেশের দর্শনেও একই কথা। গ্ৰীক যুগে ডিমক্রিটাস-কে সংস্কার করলেন এ্যানেক্সাগোরাস, আবার এ্যানেক্সাগোরাস-কে সোফিস্ট, আর সোফিস্টদের সংস্কার করলেন সক্রেটস-দুৰ্জয় বস্তুবাদ থেকে চেতনকারণবাদে পৌছবার যেন সোজা-সড়ক বেরিয়ে গেল। আধুনিক ইংলণ্ডেও এ উদাহরণের ব্যতিক্রম নেই।–বেকনা-হবাস-এর বস্তুবাদকে শুধরে নিলেন লক, আবার লককে শুধরে নিলেন বার্কলি-হিউম, শোধরানোর মানে দাড়ালো বস্তুবাদের শবদেহের উপর ভাববাদী প্রেতসাধনা। আবার এদিকে দেকার্ত, বস্তুবাদের সঙ্গে তিনি আপাস করেছেন। দ্বিধাভারা ভাববাদের। দেকার্ত-এর পর পিনোজা, দি তবুও পরমার্থিক ভাববাদের মধ্যে ব্যবহারিক বস্তুবাদকে ঠাই দিয়েছেন। (“পিটারের মন পিটারের দেহ” ইত্যাদি); আর তারপর লাইবনিৎস, বস্তুবাদের ক্ষীণতম স্বাক্ষরটুকুও তিনি লোপ করে দিলেন, জড় হল চিৎপরমাণুর প্ৰতিভাস-মাত্রে।