- বইয়ের নামঃ অতনুর দেশ
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
০১. ওগো সুন্দর, তুমি আসিবে বলিয়া
যৌবনের তীর্থক্ষেত্রে অতনুর দেশে তরুণ-তরুণীর নিত্য সমারোহ। কারও চোখে জল, কারও চোখে জ্বালা; কারও হাতে ফুল, কারও বুকে কাঁটা; কারোর হৃদয়ে অমৃত, কারোর হৃদয়ে বিষ। এই মহা-তীর্থে তনুতে তনুতে অতনু দেবতার ক্ষণভঙ্গুর দেউল, কামনার ধূপ সেখানে নিত্য জ্বলছে, ঝরাফুল মরা-হৃদয় স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে আছে তার পায়ের তলে। যে তরুণী বুকে আশার বাতি জ্বালিয়ে এই তীর্থে এল, সে গেয়ে ওঠে–
(গান)
ওগো সুন্দর, তুমি আসিবে বলিয়া
বন-পথে পড়ে ঝুরি
রাঙা অশোকের মঞ্জরি।
হাসে বন-দেবী বেণিতে জড়ায়ে
মালতীর বল্লরি
নব কিশলয় পরি॥
কুমুদী-কলিকা ঈষৎ হেলিয়া
চাঁদেরে নেহারি হাসে মুচকিয়া,
মহুয়ার বনে ভ্রমর-ভ্রমরী
ফিরিতেছে গুঞ্জরি॥
যাহা কিছু হেরি ভালো লাগে আজ
লুকাইতে নারি হাসি,
কাজ করি আর শুনি যেন বাজে
মিঠে পাহাড়িয়া বাঁশি।
এক শাড়ি খুলে পরি আর শাড়ি,
বারে বারে মুখ মুকুরে নেহারি,
দুরুদুরু হিয়া ওঠে চমকিয়া,
অকারণে লাজে মরি॥
০২. আমার কথা লুকিয়ে থাকে
হৃদয়ের এই তীর্থ-ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিস্ময়কর দৃশ্য উদাসীন পুরুষ আর বিরহিণী নারীর অশ্রুমতী নদীর তীরে মিলন। নিবিড় বিরহের বেদনায় পুরুষ হয় নির্মম, উদাসীন বৈরাগী; সেই নিবিড় বিরহ নারীকে করে প্রেমময়ী। পুরুষ যে বিরহে হয় মরুভূমি, নারী সেই বিরহে হয় যমুনা। তরুণ প্রেম-পথযাত্রী সেই বিরহ-যমুনার কূলে দাঁড়িয়ে গায়–
(গান)
আমার কথা লুকিয়ে থাকে
আমার গানের আড়ালে।
সেই কথাটি জানার লাগি
কে গো এসে দাঁড়ালে॥
শূন্য মনের নাই কেহ মোর সাথি,
গান গেয়ে তাই কাটাই দিবারাতি,
সেই হৃদয়ের গভীর বনে
কে তুমি পথ হারালে॥
হৃদয় নিয়ে নিদয় খেলার
হয় যেখানে অভিনয়,
চেয়ো না সেই হাটের মাঝে
আমার মনের পরিচয়।
যে বেদনার আগুন বুকে লয়ে
জ্বলি আমি প্রদীপ-শিখা হয়ে,
সেই বেদনা জুড়াতে মোর
কে তুমি হাত বাড়ালে॥
০৩. চাঁদের মতো নীরবে এসো প্রিয় নিশীথ রাতে
এই তীর্থ-ভূমির গোপন বেদনা-কুঞ্জে বসে ভীরু কিশোরী ডাকে তার প্রিয়তমকে–রাতের রজনিগন্ধা যেমন করে ডাকে আকাশের চাঁদকে। সবাই যখন ঘুমায়, সে তখন জাগে। সবাই যখন জাগে, তার প্রেম তখন লজ্জার অবগুণ্ঠন টেনে লুকিয়ে থাকে। নীরব আধোরাতে শোনা যায় তার কুণ্ঠিত কণ্ঠের সুর–
(গান)
চাঁদের মতো নীরবে এসো প্রিয় নিশীথ রাতে।
ঘুম হয়ে পরশ দিয়ো হে প্রিয়, নয়ন-পাতে॥
তব তরে বাহির-দুয়ার মম
খুলিবে না এ-জনমে প্রিয়তম,
মনের দুয়ার খুলি গোপন এসে,
বিজড়িত রহিয়ো স্মৃতির সাথে॥
কুসুম-সুরভি হয়ে এসো নিশি-পবনে
রাতের পাপিয়া হয়ে পিয়া পিয়া ডাকিয়া বন-ভবনে।
আঁখি-জল হয়ে আঁখিতে আসিয়ো,
বেণুকার সুর হয়ে শ্রবণে ভাসিয়ো,
বিরহ হয়ে এসো হে চির-বিরহী
আমার অন্তর-বেদনাতে॥
০৪. কথা কও, কথা কও, থাকিয়ো না চুপ করে
অতনুর এই রসলোকে বয়ে যায় অনন্ত রসের প্রবাহিণী। মুখে হাসি, চোখে জল–যেন রোদে রোদে বৃষ্টি। অন্তরে অনুরাগ, বাহিরে রাগ–যেন সাপে-মানিকে জড়াজড়ি। ব্রীড়া-সংকুচিতা বধূকে কথা কওয়াবার সাধনায় কোনো তরুণের কণ্ঠে সকরুণ মিনতি ফুটে ওঠে–
(গান)
কথা কও, কথা কও, থাকিয়ো না চুপ করে।
মৌন গগনে হেরো কথার বৃষ্টি ঝরে।
থাকিয়ো না চুপ করে॥
ধীর সমীরণ নাহি যদি কহে কথা,
ফোটে না কুসুম, নাহি দোলে বন-লতা,
কমল মেলে না দল, যদি ভ্রমর না গুঞ্জরে।
থাকিয়ো না চুপ করে॥
শোনো, কপোতের কাছে কপোতী কি কথা কহে,
পাহাড়ের ধ্যান ভাঙি মুখর ঝরনা বহে।
আমার কথার লঘু মেঘগুলি, হায়!
জমে হিম হয়ে যায় তোমার নীরবতায়,
এসো আরও কাছে এসো কথার নূপুর পরে!
থাকিয়ো না চুপ করে॥
০৫. শুনিতে চেয়ো না আমার মনের কথা
মৃদুভাষিণী তরুণী মৃদু মৃদু হাসে আর বলে–
(গান)
শুনিতে চেয়ো না আমার মনের কথা।
দখিনা বাতাস ইঙ্গিতে বোঝে
কহে যাহা বন-লতা॥
চুপ করে চাঁদ সুদূর গগনে
মহা-সাগরের ক্রন্দন শোনে,
ভ্রমর কাঁদিয়া ভাঙিতে পারে না
কুসুমের নীরবতা॥
মনের কথা কি মুখে সব বলা যায়?
রাতের আঁধারে যত তারা ফোটে
আঁখি কি দেখিতে পায়?
পাখায় পাখায় বাঁধা যবে রয়
বিহগ-মিথুন কথা নাহি কয়,
মধুকর যবে ফুলে মধু পায়
রহে না চঞ্চলতা ॥
০৬. আমায় নহে গো, ভালোবাসো মোর গান
অভিমানী সুরের কবি অকারণে অকরুণ হয়ে ওঠে মনে মনে। তার কেবলই মনে হয়, হৃদয়ের এই জলাভূমিতে নিশীথ-রাতে যে আলো দেখা যায় তা আলো নয়–আলেয়া। এই প্রেম-তীর্থে সে তাই বসে থাকে উদাসীন সন্ন্যাসীর মতো। অর্ঘ্য নিয়ে আসে যদি কোনো নিবেদিতা – তাকে সে দেয় ফিরিয়ে। সে যেন বলতে চায়–
(গান)
আমায় নহে গো, ভালোবাসো মোর গান।
গানের পাখিরে কে চিনে রাখে
গান হলে অবসান॥
চাঁদেরে কে চায়, জোছনা সবাই যাচে,
গীত শেষে বীণা পড়ে থাকে পা-র কাছে
তুমি বুঝিবে না, আলো দিতে কত
পোড়ে প্রদীপের প্রাণ॥
যে কাঁটা-লতার আঁখিজল হায়
ফুল হয়ে ফুটে ওঠে
ফুল ছিঁড়ে তারে দিয়েছ কি কিছু
শূন্য পত্রপুটে?
সবাই তৃষ্ণা মিটায় নদীর জলে,
কী তৃষ্ণা জাগে সে নদীর হিয়া-তলে
বেদনায় মহা সাগরের কাছে
করো তার সন্ধান॥
০৭. আমি জানি তব মন, আমি বুঝি তব ভাষা
কঠিন গিরিমাটির তলে ফল্লুধারার মতো উদাসীন পুরুষের গৈরিক বসনের অন্তরালে যে বেদনার ঝরনা-ধারা, তাকেই লক্ষ করে গেয়ে ওঠে নিবেদিতা নারী–
(গান)
আমি জানি তব মন, আমি বুঝি তব ভাষা।
(তব) কঠিন হিয়া-তলে কী গভীর ভালোবাসা॥
ওগো উদাসীন আমি জানি তব ব্যথা
আহত পাখির বুকে বাণ বিঁধে কোথা,
কোন অভিমানে ভুলিয়াছ তুমি
ভালোবাসিবার আশা॥
তুমি কেন হানো অবহেলা অকারণে আপনাকে।
বঁধু যে হৃদয়ে থাকে বিষ, সেই হৃদয়ে অমৃত থাকে।
(তব) যে বুকে জাগে প্রলয়-ঝড়ের জ্বালা,
(আমি) দেখেছি যে সেথা সজল মেঘের মালা,
ওগো ক্ষুধাতুর! আমাকে আহুতি দিলে
মিটিবে কি তব আগুনের পিপাসা॥
০৮. যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
এই তীর্থধামে মিলনের ব্রজে বেজে ওঠে মাথুরের বিদায়-বাঁশি। যে-বিরহ আনে অশ্রু, সেই বিরহই জ্বালায় আগুন। যে-মেঘ ফুল ফোটায়, সেই মেঘেই থাকে অশনি। বিরহের তপস্যা যে-পুরুষকে করেছে উদাসীন সন্ন্যাসী, মিলনের বিলাস-কুঞ্জে সে তার প্রিয়ার মৃত্যু কামনা করতে পারে না। তাই নির্মম হয়ে সে চলে যায় নিরুদ্দেশের পথে। পথের প্রান্তে লুটিয়ে কাঁদে তার বিরহিণী প্রিয়ার মতো তার গানের সুর–
(গান)
যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখ তারে?
ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে॥
আমি গান গাই আপনার দুখে,
তুমি কেন আসি দাঁড়াও সুমুখে,
আলেয়ার মতো ডাকিয়ো না আর
নিশীথ-অন্ধকারে॥
দয়া করো মোরে দয়া করো,
আর আমারে লইয়া খেলো না নিঠুর খেলা;
শত কাঁদিলেও ফিরিবে না আর
সেই শুভ লগনের বেলা।
আমি ফিরি পথে, তাহে কার ক্ষতি,
তব চোখে কেন সজল মিনতি?
আমি কি ভুলেও কোনোদিন এসে
দাঁড়ায়েছি তব দ্বারে॥
ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে