- বইয়ের নামঃ ঈদজ্জোহা
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
০১. ঈদজ্জোহার তকবির শোন ঈদগাহে
(প্রথমে দূরাগত আজানের ধবনি–Fade in আজান Fade out–)
(গান)
ঈদজ্জোহার তকবির শোন ঈদগাহে।
(তার) কোরবানির সামান নিয়ে চল রাহে॥
কোরবানির রঙে রঙিন পর লেবাস
পিরাহানে মাখ রে ত্যাগের গুল-সুবাস
দে মোবারকবাদ দীনের বাদশাহে॥
খোদারে দে প্রাণের প্রিয়, শোন এ ঈদের মাজেরা,
যেমন পুত্রে বিলিয়ে দিলেন খোদার নামে হাজেরা,
ওরে কৃপণ দিসনে ফাঁকি আল্লাহে॥
তোর পাশের ঘরে গরিব কাঙাল কাঁদছে যে
তুই তারে ফেলে ইদগাহে যাস সং সেজে,
তাই চাঁদ উঠল এল না ঈদ
নাই হিম্মত নাই উম্মিদ
শোন কেঁদে কেঁদে বেহেশ্ত হতে
হজরত আজ কী চাহে॥
আজ ইদজ্জোহা – বকরীদ। আজ পরম ত্যাগের পরম উৎসব। হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হিস্সালামের আবির্ভাবের সহস্রাধিক বৎসর পূর্বে হজরত ইব্রাহিম আলায়হিস্সালাম নবুয়ত পান – অর্থাৎ আল্লাহ কতৃর্ক নবিরূপে প্রেরিত হন। আল্লাহের নামের তিনি তাঁর অন্তরের বাইরের সব-কিছু সমর্থন করেন বলে তাঁকে খলিলুল্লাহ বা আল্লার বন্ধু–সখা বলা হয়। তাঁকে এই পরম গৌরবে গৌরবান্বিত করা হয় দেখে বেহেশ্তের ফেরেশতারা আল্লাহ কে নিবেদন করেন – ‘হে পরম প্রভু, ইব্রাহিম এমন কী পুণ্য অর্জন করেছেন যে, তোমার সখা বলে তিনি অভিনন্দিত হলেন?’ ‘আল্লাহ বললেন – তার আমার উপরে কী নির্ভরতা, কত পরম ত্যাগী সে তোমরা দেখো। এই বলে ইব্রাহিমকে স্বপ্নে বললেন, ‘ইব্রাহিম আল্লাহের নামে কোরবানি দাও!’ হজরত ইব্রাহিম তার পরদিবস তাঁর উটগুলি কোরবানি দিয়ে গরিব দুঃখীদের বিলিয়ে দিলেন। আল্লাহ আবার স্বপ্নে বললেন, ‘ইব্রাহিম উৎসর্গ করো!’ ইব্রাহিম আবার উট কোরবানি দিলেন। আল্লাহ্ আবার স্বপ্নে ইব্রাহিমকে বললেন ‘ইব্রাহিম! তোমার সবচেয়ে প্রিয় যে তাকে আল্লার নামে কোরবানি দাও!’ ইব্রাহিম বুঝলেন – তাঁর একমাত্র পুত্রই এই দুনিয়ায় তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। ইসমাইল তখন তাঁর মাতা হাজেরার সাথে বর্তমান কাবার কাছে প্রায় বনবাসীর জীবনযাপন করছেন।
০২. নাই হল মা বসন ভূষণ এই ঈদে আমার
ইব্রহিম গিয়ে তাঁর পুত্রকে আল্লাহের আদেশ শোনাতেই ইসমাইল আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ‘আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ আমার পরম সৌভাগ্য যে, আল্লাহ তাঁর এই বান্দাকে তাঁর পবিত্র নামে কোরবান হওয়ার জন্য কবুল করেছেন’। ইসমাইলের মাতা বিবি হাজেরাও অশ্রু-সজল নেত্রে আল্লাহ্কে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন, ‘আমিও সত্যই পরম সৌভাগ্যবতী, নইলে আল্লাহ্ তাঁর এই বাঁদির পুত্রকে কেন তাঁর নামে উৎসর্গ করার জন্য মঞ্জুর করলেন?’ মা কাঁদতে কাঁদতে পুত্রকে তার পিতার হাতে দিলেন। ইব্রাহিম ইসমাইলকে আল্লার রাহে কোরবানি দেওয়ার জন্য পর্বত শিখরে উঠে তাঁর হাত পা বেঁধে বিসমিল্লাহ্ বলে কণ্ঠদেশে ছুরি চালালেন। আল্লার আরশ কুরসি লওহ কলম কেঁপে উঠল। ফেরেশতা হুরপরি সোলেমান মারহাবা-মারহাবা করে কেঁদে উঠল – সাত আশমান টলতে লাগল। সূর্য মেঘের নেকাবে মুখ ঢাকল। মহামৌনী মহাধ্যানী ইসরাফিলের ধ্যান ভেঙে গেল। ইব্রাহিম ছুরি যত চালান ইসমাইলের কণ্ঠের একটি লোপকূপও ভেদ করতে পারেন না। তখন ইসমাইল তাঁর পিতাকে বললেন, ‘পিতঃ বোধ হয় স্নেহবশত আপনার হাত দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাই হাত চলছে না। আপনি কাপড় দিয়ে আপনার চোখ বন্ধ করে ছুরি চালান’। ইব্রাহিম পুত্রের কথায় আনন্দিত হয়ে নিজের চোখ বেঁধে ছুরি চালালেন। এইবার ছুরি কণ্ঠ ভেদ করল। আল্লাহ্কে ধন্যবাদ দিয়ে চোখের কাপড় খুলে ইব্রাহিম দেখলেন – যাকে কোরবানি করেছেন – যার কণ্ঠ ভেদ করে তাঁর ছুরি চলেছে – সে ইসমাইল নয় – সে একটি দুম্বা মেষ। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে হাসছেন বন্ধন মুক্ত ইসমাইল ও হজরত জিবরাইল। আল্লার বাণী-বাহক ফেরেশতা হজরত জিবরাইল বললেন– ‘আল্লাহ্ তোমার কোরবানি কবুল করেছেন –‘ওই দেখো সাত আকাশ জুড়ে সমস্ত ফেরেশতা হুরপরি তোমায় মোবারকবাদ দিচ্ছেন। আজ থেকে তোমার পুত্রের নাম হল ইসমাইল জবিহুল্লাহ্–!’ এমনই বকরীদের চাঁদে এমনই দিনে হজরত ইব্রাহিম তাঁর প্রিয়তম পুত্রকে আল্লার নামে উৎসর্গ করেছিলেন। আজ এই বকরীদে কে আছে মুসলমান – যে মুসলমান মানে আল্লার নামে যিনি তাঁর সর্বস্ব সমর্পণ করেছেন – উৎসর্গ করেছেন – কোথা সেই আত্মত্যাগী মুসলমান যিনি তাঁর সবকিছু রাহে ফিল্লাহ্ বিলিয়ে দিয়ে আল্লার প্রিয় হয়েছেন? ঘরে ঘরে আজ গরিব কাঙাল নিরন্ন বস্ত্রহীন আশ্রয়হারা। তাদেরই পাশে আমার দালান বাড়ি, খেত খামার শস্যে ফসলে পূর্ণ, উদৃবৃত্ত অর্থে আমার বাক্স প্যাঁটরা পূর্ণ! জেওরে লেবাসে আমার পুত্র কন্যার অঙ্গ ঝলমল করছে – আর পাশের বাড়িতে কাঙালিনি মেয়ে কাঁদছে –
(গান)
নাই হল মা বসন ভূষণ এই ঈদে আমার।
আল্লা আমার মাথার মুকুট, রসুল গলার হার॥
নামাজ রোজার ওড়না শাড়ি
ওতেই আমায় মানায় ভারী
কলমা আমার কপালে টিপ, নাই তুলনা তার॥
হেরা গুহার হিরার তাবিজ কোরান বুকে দোলে
হাদিস ফেকা বাজুবন্দ, দেখে পরান ভোলে।
হাতে সোনার চুড়ি যে মা
হাসান হোসেন মা ফাতেমা
মোর অঙ্গুলিতে অঙ্গুরী মা, নবির বার ইয়ার॥
০৩. ছয় লতিফার ঊর্ধ্বে আমার আরফাত ময়দান
এই ইদজ্জোহার চাঁদে যে পশু কোরবানি দেওয়ার কথা আল্লাহ্ বলেছেন – সে পশু কেমন কোরআন – মজিদের সুরা বকরায় অষ্টম রুকুতে তার ইঙ্গিত আছে। যে গোরু বা পশু উজ্জ্বল স্বর্ণবর্ণ, নিষ্কলঙ্ক, যে গোরু কখনও ভূমি কর্ষণ করে না, জল সেচন করে না –ইত্যাদি। এই পশু কোরবানি দিলে পুলসেরাত পার হয়ে আল্লাহের দিদার হয়। এই গো অর্থে ঐশ্বর্য, বিভূতি, জ্ঞান । এই দুনিয়ায় গো কোরবানি করে পুণ্য অর্জন হয়, কিন্তু আল্লাহের দিদার মেলে না। এই দুনিয়াতেই যাঁরা আল্লাহের দিদার চান, সেই সুফিরা জানেন, সুরা বকরার এই গো – সুফি বা সাধক যে যোগৈশ্বর্য পান, এবং তাঁর দেহে স্বর্ণ জ্যোতির আভাস ফুটে ওঠে, যে শক্তি-বলে তিনি বহু মাজেজা দেখাতে পারেন সেই জ্যোতি ও শক্তি বা বিভূতি– তাকেই আল্লাহের নামে উৎসর্গ করা হয় তা হলে পুলসেরাত বা সেরাতুল মোস্তাকিমের শেষ বাধা পার হয়ে আল্লাহের দিদার পাওয়া যায়। এই দুনিয়ার কাবায় হজ করার নিশ্চয়ই প্রয়োজন আছে, কারণ ইহা ফরজ্ কিন্তু – যেখানে গেলে আল্লাহ্র দিদার হয় – সেই আসল কাবা শরিফের ঊর্ধ্বতম দেশে – ব্রহ্মরন্ধ্রে ছয় লতিফার ঊর্ধ্বে! তার নাম ফানাফির রসুল, ফানাফিল্লাহ্।
(গান)
ছয় লতিফার ঊর্ধ্বে আমার আরফাত ময়দান।
তারই মাঝে কাবা – জানেন বুজর্গান॥
যবে হজরতের নাম জপি ভাই –
হাজার হজের আনন্দ পাই,
মোর জীবন মরণ দুই উটে ভাই দিই সেথা কোরবান॥
আমি তূর পাহাড়ে সুর শুনে ভাই প্রেমানন্দে গলি
ফানাফির রসুলে আমি হেরার পথে চলি
হজরতের কদম চুমি হিজরে আসওয়াদ
ইব্রাহিমের কোলে চড়ে দেখি ঈদের চাঁদ।
মোরে খোৎবা শোনান ইমাম হয়ে
জিব্রিল কোরআন॥
যাদের সম্বল দেননি হজে যাবার – তাদের দীন আত্মা ভিখারিনির
মতো আজ আল্লার না – দেখা কাবার দুয়ার ধরে যেন কাঁদছে –
০৪. আমি হজে যেতে পাইনি বলে কেঁদেছিলাম রাতে
আমি হজে যেতে পাইনি বলে কেঁদেছিলাম রাতে।
তাই হজরত এসে স্বপ্নে মাগো ধরেছিলেন হাতে॥
যেদিন বাবা গেলেন কাবার হজে, বলেছিলেন কাঁদি –
ধরে নবির কবর, বলো, কি দোষ করেছে এ বাঁদি
মোর মদিনা-মোহন হঠাৎ শুনলেন কী সেই মুনাজাত
তাই খাবে এসে বলেছিলেন, ‘যাবে কি মোর সাথ!’
যেন জয়তুন গাছের ডাল ধরে মা বললেন আঁখিজলে–
‘দেখবে কাবা আমায় পাবে, (এই)কল্পতরুতলে।’
মা হঠাৎ এল শুভ্রজ্যোতি, আঁধার হল আলা,
যেন নীল সাগরের ঢেউয়ে দোলে লাখো মোতির মালা।
মোর সকল জ্বালা জুড়িয়ে গেল সেই কাবা আরফাতে॥
০৫. ঈদ মোবারক হো! ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক ঈদ
এই কাবায় গেলে আজও হজরতের দিদার পাওয়া যায় – এবং হজরতের শাফায়ত পেলে আল্লার দিদার পাওয়া যায়। এই আরফাতে নিত্য মিলন, নিত্য আনন্দ, সেখানে মৃত্যু নাই, কেবল অমৃত। দুনিয়ার আরফাতের ময়দানে সে মহা-মিলনের আভাস পাই, তা সেই পরম কাবা ঘরের পরমানন্দের ঈষৎ ছায়া মাত্র। আমরা আজ ঈদে যেন ভাইয়ে ভাইয়ে সকল বিদ্বেষ, হিংসা হানাহানি ভুলে – সকল কাম-ক্রোধাদি ষড়রিপুর পশুকে কোরবানি দিয়ে কতলগাহকেই ঈদগাহে পরিণত করে প্রেমের সেই ঈদগাহে গলাগলি করে গাইতে পারি : –
(গান) [কোরাস]
ঈদ মোবারক হো! ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক ঈদ!
রাহে লিল্লাহ্ যে আপনারে বিলিয়ে দিল, যে হল শহিদ॥
যে কোরবানি আজ দিল খোদায় দৌলত ও হাশমত
যার নিজের বলে রইল শুধু আল্লা ও হজরত
যে রিক্ত হয়ে পেল আজি অমৃত তৌহিদ ॥
যে খোদার রাহে বিলিয়ে দিল পুত্র ও কন্যায়
যে আমি না, আমি না বলে মিলল আমিনায়।
ওরে তারই কোলে আসার লাগি নাই নবিজির নিঁদ॥
যে আপন পুত্রে খোদারে দেয় শহিদ হওয়ার তরে
কাবাতে সে যায় না রে ভাই, নিজেই কাবা গড়ে
সে যেখানে যায় জাগে সেথায় কাবার উম্মিদ॥
(তকবির-ধ্বনি ও ঈদ মোবারক ধ্বনি)